গ্রীষ্মের কোনো এক দুপুরে প্রখর রোদের তাপ উপেক্ষা করে রাকিব তাঁর দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা গ্রাহকদের প্রচণ্ড ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। মাথার ওপর ঝোলানো ফ্যানটিও কাজ করছে না, বাতিটাও নিবু নিবু অবস্থা। রাকিবের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙার উপক্রম। এর মধ্যে তাঁর নিয়মিত এক গ্রাহকের আবদার—এ মাসেও তাঁকে বাকিতে পণ্য দিতে হবে। রাকিব তাঁর হালখাতা খুলে দেখেন, কালিতে পুরোটা লেপ্টে গেছে। তিনি বাকিতে দেওয়ার কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে গ্রাহককে জানিয়ে দেন, এ মাসে আর বাকি হবে না। এতে ভদ্রমহিলা ভীষণ রেগে বিরক্ত হয়ে চলে যান। রাকিবের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। এই নিত্যনৈমিত্তিক সাধারণ ঘটনাগুলো রাকিবের মতো আরও হাজারো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর জন্য শুধু পীড়াদায়কই নয়, আর্থিকভাবে ক্ষতির কারণও বটে।
আপাতদৃষ্টিতে এ সমস্যাগুলো বিচ্ছিন্ন মনে হলেও বাস্তবে এগুলো অনেক সামগ্রিক সমস্যা বয়ে আনে। ফ্যান ঠিক করে দেওয়ার জন্য ইলেকট্রিশিয়ানকে বিকাশ অ্যাকাউন্ট থেকে ক্যাশ আউট করে টাকা দেওয়ার মতো সময় রাকিবের হাতে নেই। তা ছাড়া রাকিব অ্যাপের মাধ্যমেও টাকা পাঠাতে পারবেন না। হাল খাতায় লিখে রাখা লেপ্টে যাওয়া হিসাব বেহাল। রাকিবের পক্ষে একই সঙ্গে কাস্টমারের নগদ-বাকির হিসাব আর তাঁদের হাতে প্রয়োজনমতো পণ্য তুলে দেওয়ার সময় নেই। সঠিক সময়ে সব দিক সামাল দেওয়ার মতো একটি প্রযুক্তির অভাব রাকিবের ব্যবসাকে অস্তিত্বের সম্মুখীন করে তুলেছে। রাকিবের মতো বাংলাদেশে এমন আরও লাখ লাখ মানুষ এখন এমন এক প্রযুক্তির প্রয়োজন অনুভব করছেন, যা তাঁদের জীবন ও ব্যবসাকে আরও সহজ করে তুলতে পারে।
বাংলাদেশে বেড়ে ওঠা স্টার্টআপ ব্যবসার ভিড়ে কোনটি সত্যিকার অর্থে আমাদের জন্য সুফল বয়ে আনছে, তার হিসাব রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। বাহ্বা, কৃতিত্ব আর পুরস্কারের আশায় আমরা এ জাতীয় চিন্তাভাবনা বা প্রযুক্তির আমদানি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি, যা আমাদের কেবল ছোটখাটো সমস্যার সমাধান দিতে পারে। আপনি হয়তো রাইড শেয়ারিংয়ের আরও উন্নত প্রযুক্তিভিত্তিক কোনো অ্যাপ, নতুন কোনো ওটিটি বা আধুনিক মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে পারেন, কিন্তু কেউ যদি এটি কীভাবে ব্যবহার করতে হয় তা না জানেন, তাহলে এই উদ্ভাবনের কোনো মূল্যই নেই। বাংলাদেশে ডিজিটাল সাক্ষরতার হার যদিও ২৩%, তবে সার্বিক ডিজিটাল সাক্ষরতার হার এ ক্ষেত্রে ৬%-এর কিছু বেশি। এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে কোনো অ্যাপের ইউজার ইন্টারফেস যত আধুনিক হোক না কেন, সবার কাছে এর ব্যবহারযোগ্যতা শূন্যের কোঠাতেই থেকে যাবে।
বিষয়টির গুরুত্ব ২০১৪ সালে জাপানে বসবাসরত ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট যুবায়ের আহমেদকে উৎসাহী করে তোলে। প্রবাসজীবনের আরাম-আয়েশের মোহ ভুলে যুবায়ের বিষয়টি নিয়ে আরও গভীরভাবে কাজ করতে দেশে ফিরে আসেন। একজন ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট হিসেবে প্রযুক্তিগত সমাধানের প্রতি আগ্রহী, বুদ্ধিদীপ্ত, চৌকস যুবায়ের তাঁর সহজাত প্রবৃত্তিতে বিষয়টি বুঝতে পারেন যে ডিজিটাল সাক্ষরতা নিয়ে চলমান বিভ্রান্তি থেকে উত্তরণের পথ হচ্ছে মোবাইল নেটওয়ার্ক চালিত একটি ভয়েস প্রযুক্তি, যা হবে বাংলায়। গুগল, অ্যামাজন আর অ্যাপলের মতো বিশ্বখ্যাত প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো যখন সমস্যা সমাধানে উঠেপড়ে লেগেছে, যুবায়েরও তখন যোগ দিলেন সে অসাধ্যসাধনের প্রতিযোগিতায়। আর এভাবেই জন্ম নিল ‘হিসাব’। এ যাত্রায় সাফল্য অর্জনের আশা উচ্চাভিলাষী হলেও তা মোটেই অসম্ভব নয়।
বাংলাদেশি কোম্পানিগুলো যেখানে ভয়েস প্রযুক্তির মতো উদ্ভাবিত প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে, সেখানে প্রতিবেশী ভারত ও জাপানের মতো উন্নত প্রযুক্তির দেশে অনেকটাই এগিয়ে গেছে। ২০২২ সালে ‘হিসাব’ ভারতের সর্ববৃহৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠান স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ‘হাই-পে’ ও হাই-পস’ নামে দুটি পাইলট প্রকল্প শুরু করে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ২৭টি দোকানে আনুষ্ঠানিক যাত্রার পর তিন সপ্তাহের মধ্যে ‘হিসাব’-এর কর্মকাণ্ড ২০ হাজারের বেশি দোকানে ছড়িয়ে পড়ে, যা কোনো প্রচারণা ছাড়াই ১০ হাজার গুণ প্রবৃদ্ধি।
সাফল্য এল ৯ বছর পর, ২০২৩ সালে। গোটা বিশ্ব যখন চ্যাটজিপিটি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সক্ষমতা নিয়ে উন্মত্ততায় ব্যস্ত, যুবায়ের তখন নিজেকে মগ্ন রাখলেন লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল (এলএলএম) প্রযুক্তি নিয়ে। যুবায়ের ও হিসাব নিয়ে কাজ করা তাঁর কর্মী বাহিনী সমস্যা সমাধানের পথগুলো নিজেদের চোখেই দেখতে পেলেন। এখন যেমন আমরা মোবাইলে সহজেই অ্যাপলের ‘সিরি’ বা অ্যামাজনের ‘এলেক্সা’র সহায়তা পাই, হিসাবও তেমনই ভয়েসের মাধ্যমে দৈনন্দিন অনেক বিষয়ের সমস্যার সমাধান পাওয়াকে বাস্তবসম্মত ও সহজলভ্য করে তুলেছে। মোবাইল নেটওয়ার্কের ওপর নির্ভর করে চালিত হিসাবের পেটেন্ট করা কথোপকথনমূলক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি এই কৃতিত্বের দাবিদার। মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী যে কেউ এখন বাংলায় একজন বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন ব্যক্তিগত সহকারীর সহায়তা পেতে পারেন যার সংক্ষিপ্ত রূপ হলো ‘পিআইএ’ বা পার্সোনাল ইনফরমেশন অ্যাসিস্ট্যান্ট।
প্রশ্ন হলো, পিআইএর কী করার সক্ষমতা আছে? কম কথায় বলতে গেলে, আপনার কণ্ঠস্বর বা কথায় হাতের মোবাইল ফোনটি যা করতে পারে, তা-ই হলো পিআইএ। হিসাবের মূল প্রোডাক্ট হচ্ছে পেমেন্টস এবং পিওএস সলিউশন যথাক্রমে হাই-পে ও হাই-পস। মোবাইলে কল করে বা একটি নির্দিষ্ট নম্বর থেকে কল রিসিভ করার মধ্য দিয়ে যে কেউ টাকা পাঠাতে পারেন বা একটি ভার্চ্যুয়াল কল অ্যাসিস্ট্যান্টের সঙ্গে কথা বলে অ্যাকাউন্টের তথ্য সংশোধন বা পরিবর্তন করতে পারেন। একটি নির্ধারিত নম্বরে কল করে রাকিবের মতো দোকানমালিকেরা তাঁদের হাল খাতাকে ডিজিটাল খাতায় পরিণত করতে পারেন। লেনদেনের তথ্য কথোপকথনের মাধ্যমে রেকর্ড করে দোকানমালিক ও গ্রাহক উভয়ের জন্য আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা অনেক সহজ হয়েছে।
বাংলাদেশি কোম্পানিগুলো যেখানে ভয়েস প্রযুক্তির মতো উদ্ভাবিত প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে, সেখানে প্রতিবেশী ভারত ও জাপানের মতো উন্নত প্রযুক্তির দেশে অনেকটাই এগিয়ে গেছে। ২০২২ সালে ‘হিসাব’ ভারতের সর্ববৃহৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠান স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ‘হাই-পে’ ও হাই-পস’ নামে দুটি পাইলট প্রকল্প শুরু করে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ২৭টি দোকানে আনুষ্ঠানিক যাত্রার পর তিন সপ্তাহের মধ্যে ‘হিসাব’-এর কর্মকাণ্ড ২০ হাজারের বেশি দোকানে ছড়িয়ে পড়ে, যা কোনো প্রচারণা ছাড়াই ১০ হাজার গুণ প্রবৃদ্ধি। জাপানের বৃহত্তম ও বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় বিদ্যুৎসেবা সংস্থা ‘টোকিও ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানি’ বা টেপকোর জন্য হিসাব তার কাস্টমার এনগেজমেন্ট সলিউশন সার্ভিস চালু করে। জাপানি ভাষায় কথোপকথনমূলক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি প্রবর্তনের মাধ্যমে হিসাব ২ কোটি ২০ লাখ জাপানি নাগরিকের ভয়েস প্রযুক্তিনির্ভর সেবা দিয়ে যাচ্ছে।
সময়টি বাংলাদেশের জন্য নিঃসন্দেহে গর্বের। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে উদীয়মান দেশীয় প্রযুক্তি খাত বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি বাজারে নেতৃত্ব স্থানীয় অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশসহ ২৭টি দেশে হিসাবের প্রযুক্তিটি পেটেন্ট করা হয়েছে, যার মধ্যে ইন্ডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, নাইজেরিয়াসহ আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশ অন্তর্ভুক্ত। হিসাবের পেটেন্ট করা ৫৪টি সেবার মধ্যে ভয়েস ব্যাংকিং, স্বয়ংক্রিয় কল সেন্টার, ভয়েস কমার্স ও মোবাইল নেটওয়ার্কনির্ভর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পরিচালিত কথোপকথন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ভয়েস প্রযুক্তি ও সংশ্লিষ্ট খাতের সেবায় পেটেন্টে নতুনত্ব আনতে হিসাবের দক্ষ প্রকৌশলীরা গবেষণা ও উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য সময় ব্যয় করে থাকেন। এই ঐকান্তিক প্রচেষ্টার স্বীকৃতিস্বরূপ হিসাব এরই মধ্যে ২০২১ সালে টয়োটা সিটির ‘আইচি অ্যাওয়ার্ড’, ২০২১ সালে জাপানি উন্মুক্ত প্রযুক্তি প্রতিযোগিতা ‘গেট ইন দ্য রিং’-এ প্রথম পুরস্কার, ২০২৩ সালে নিক্কি এশিয়া পুরস্কার ও ২০২৩-এ পেমেন্ট ক্যাটাগরিতে ‘বাংলাদেশ ফিনটেক অ্যাওয়ার্ড’-এ ভূষিত হয়।
একটি বাংলাদেশি প্রযুক্তি কোম্পানি কীভাবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত, অন্যতম শীর্ষস্থানীয় প্রযুক্তি কোম্পানিতে পরিণত হতে পারে ‘হিসাব’ তার একটি অনবদ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। হিসাবের এই সাফল্য বাংলাদেশি প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর জন্য প্রযুক্তিবিশ্বে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করার পথও সুগম করেছে। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশি প্রকৌশলীরাও যে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের ব্যবহার উপযোগী প্রযুক্তি উদ্ভাবনে পারদর্শী, হিসাব সে সক্ষমতারও প্রমাণ দিয়েছে। সক্ষমতার মানদণ্ডে প্রযুক্তিবিশ্বে ‘হিসাব’ প্রথম বাংলাদেশি কোম্পানি। সময় এখন তাদের পথ অনুসরণ করে বাকিদের অদম্য গতিতে এগিয়ে যাওয়া।
এ জেড এম সাইফ প্রযুক্তি ও সমসাময়িক বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহের বিশ্লেষক।
বিজ্ঞাপনী সংস্থা পেপার রাইম-এর সিইও।