আইএমএফের ঋণ ও বাংলাদেশে সংস্কার: কোথায়, কীভাবে

বাংলাদেশের উন্নয়নের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণে উন্নয়ন সহযোগীরা এই শতকের প্রায় শুরু থেকেই উন্নয়নকে আরও টেকসই, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে গ্রহণযোগ্য করতে বেশ কিছু অতিপ্রয়োজনীয় সংস্কারের কথা বলে আসছিলেন। সম্ভবত ২০০৫ সালে বিশ্বব্যাংকের আইএফসির বিজনেস ক্লাইমেট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড, যুক্তরাজ্য এবং জাপান দূতাবাসের সহায়তায় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় গতি পায় ‘বাংলাদেশ বেটার বিজনেস ফোরাম’। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০৭-০৮ সালের সরকারের সময় গঠন করা হয় ‘রেগুলেটরি রিফর্মস কমিশন’। এই উদ্যোগগুলোতে মূলত ব্যবসায়ের পরিবেশ উন্নতকরণ, প্রচলিত আইনি বাধাগুলো দূর করা, সময় ও অপরাপর প্রতিযোগী দেশের বিবেচনায় ব্যবসাকে সহায়তা করতে নতুন আইন প্রণয়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল।

২০০৯ সালে নতুন সরকার গঠিত হলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, এমনকি জাতীয় প্রবৃদ্ধি বেশ গতি পেলেও পিছিয়ে পড়ে সামগ্রিক সংস্কারের কর্মসূচি। ফলে উন্নয়নকে ভবিষ্যৎমুখী করার ক্ষেত্রে উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্যে বাংলাদেশ নিয়ে আশঙ্কার উদ্রেক হয়। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ গত বছরের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলাদেশের জন্য অনেকটা আপত্কালীন ঋণ বিবেচনা করতে গিয়ে আবার প্রয়োজনীয় তথা বহুল প্রয়োজনীয় আর্থিক এবং রাজস্ব খাতের অনেক দিনের বকেয়া সংস্কার অ্যাজেন্ডাগুলো সামনে নিয়ে আসে। এটির একটি ভালো দিক হলো, অর্থনীতিবিদ এমনকি অনেক রাজনীতিবিদও দেখলাম সংস্কারের প্রশ্নে একমত। আর্থিক খাতে অনাচার আর একটি বৃহৎ সম্ভাবনার দেশে অতি কম রাজস্ব আয় যে আমাদের বেশি দূর এগিয়ে নিতে পারবে না, তাঁরা তা সম্যক উপলব্ধি করতে পারছে।

নির্বাচনের বছর আবার কতটুকু সংস্কার সম্ভব, সেটা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। তবু আমরা সংস্কার চাই। শুধু প্রয়োজনীয় সংস্কারই আমাদের আর্থিক ও রাজস্ব খাতে প্রয়োজনীয় গভীরতা এনে উন্নয়নকে দীর্ঘস্থায়ী করতে পারে

সম্প্রতি বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল। এমনকি প্রথম কিস্তির তহবিল বাংলাদেশ পেয়েও গেছে। অনুমোদন বৈঠকে সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা জানান, বাংলাদেশের আর্থিক খাতের দুর্বলতা কমলে, নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা উন্নত করা হলে এবং পুঁজিবাজারের বিকাশের পথ প্রশস্ত করা গেলে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রয়োজনীয় আরও অর্থায়ন করা সম্ভব হবে।

তাঁদের মতে, প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা বৃদ্ধি করতে কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন। সে জন্য দরকার বাণিজ্য ও প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির সহায়ক পরিবেশ তৈরি, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও শাসনব্যবস্থার উন্নয়ন। এ ছাড়া বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার মধ্যে আরও টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সরকারকে তার উচ্চাভিলাষী সংস্কার কার্যক্রমের গতিও বাড়াতে হবে। ২০৩১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ হতে গেলে মানবসম্পদ ও অবকাঠামো খাতে আরও বিপুল বিনিয়োগ করতে হবে। একই সঙ্গে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনেও তা জরুরি। বাংলাদেশ সরকার এসব চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এবং একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কেও অবগত বলে জানিয়েছেন আমাদের কর্তাব্যক্তিরা।

অনেক দিন ধরেই বলা হয়ে আসছে, রাজস্ব খাতে সংস্কার করে আয় বাড়াতে পারলে বাংলাদেশ সামাজিক খাত, উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ব্যয় বৃদ্ধি করতে পারবে। তবে সে জন্য কর নীতি ও রাজস্ব প্রশাসন—উভয় খাতেই হাত দিতে হবে। রাজস্ব সংস্কার হলে সরকারি অর্থায়ন, বিনিয়োগ ও ঋণ ব্যবস্থাপনা উন্নত হবে। এতে সরকারের ব্যয় সক্ষমতা ও স্বচ্ছতা বাড়বে এবং শাসনব্যবস্থা উন্নত হবে।

সরকারের কেউ কেউ অবশ্য বলেছেন আইএমএফের ঋণ পেতে ও চলমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার কয়েক মাস ধরেই সংস্কার কর্মসূচি পরিচালনা করছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে যখন আইএমএফের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফরে আসে, তখন এসব সংস্কার উদ্যোগে তাঁরা সন্তোষ প্রকাশ করেন বলেও জানা গেছে। পরবর্তী সময় ঋণ অনুমোদন বৈঠকেও সংস্কারের বহুল প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোকপাত করা হয়।

আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, ব্যাংকিং খাতে ঋণখেলাপি কমিয়ে আনা, সুশাসন নিশ্চিতকরণ এবং ব্যাংকিং খাতে প্রযুক্তি সহায়তায় ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা উন্নতকরণে মনোযোগ দিচ্ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডও কর-জিডিপি অনুপাত সম্প্রসারণ, করদাতাদের হয়রানি হ্রাস, কর আদায়ে প্রযুক্তির অধিকতর ব্যবহারের ওপর জোর দিচ্ছেন বলে আমরা জানতে পেরেছি।

এসব বিষয় নিয়ে আবার অনেক দিন ধরেই আলোচনা উচ্চকিত রয়েছে। তবে এই শাসনকাঠামোতে আবার কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তন সম্ভব নয় বলেও অনেকেই মনে করেন। ঋণ সংস্কার কমিশন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক শক্তিশালীকরণ প্রকল্প, ব্যাংকিং সংস্কার কমিশনের সুফল ব্যাংকিং খাতে রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক দলের অহেতুক হস্তক্ষেপের কারণে সময়কালে ধরে রাখা যায়নি। স্বজনতোষণ পুঁজিবাদের কারণে রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট মন্দ ঋণও কমানো সম্ভব হয়নি। ব্যাংকিং খাত অনেকটা মালিকনির্ভর হয়ে গেছে। প্রয়োজনীয় সেবা-পণ্যের বিকাশ ঘটেনি। বিশেষ ও কাঠামোগত ঋণের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনাও উন্নত করা যায়নি।

অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বা বিআইডিএসের পর্যালোচনায় প্রায় তিন কোটি লোকের মাথাপিছু বার্ষিক আয় প্রায় সাড়ে তিন লাখ হলেও, এমনকি প্রায় ৪০ বছর ধরে একটি বর্ধিষ্ণু ব্যক্তি খাতের বিকাশ সত্ত্বেও বাংলাদেশে আয়কর আদায় এখনো অনেক নিচে। সেই স্বল্প রাজস্ব আয়ের আবার বিরাট অংশ আসে পরোক্ষ কর থেকে।

ৎ ও বৃহৎ আয়করদাতারা এখনো হয়রানির অভিযোগ আনেন। ভ্যাট অনলাইন প্রকল্পের বাস্তবায়ন ঝুলে আছে অনেক বছর ধরে। সমুদ্র, এমনকি বিমানবন্দরেও হয়রানির সংবাদ আসে প্রায়ই। একতরফা কর চাপিয়ে দেওয়ার অভিযোগও প্রায়ই উচ্চারিত হয় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পক্ষ থেকে।

এই বাস্তবতায় আর্থিক ও রাজস্ব খাতের সংস্কারে যে আরও রাজনৈতিক সদিচ্ছা লাগবে, তাতে সন্দেহ নেই। সেই সঙ্গে সামগ্রিক সংস্কারকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় লোকবলও প্রয়োজন। নির্বাচনের বছর আবার কতটুকু সংস্কার সম্ভব, সেটা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। তবু আমরা সংস্কার চাই। শুধু প্রয়োজনীয় সংস্কারই আমাদের আর্থিক ও রাজস্ব খাতে প্রয়োজনীয় গভীরতা এনে উন্নয়নকে দীর্ঘস্থায়ী করতে পারে।

  • মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক