বাংলাদেশ–পাকিস্তান সম্পর্ক: অতীতের আয়নায় ভবিষ্যতের পথচলা কেমন হবে

পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কখনোই কেবল কূটনৈতিক স্বার্থের ভিত্তিতে সীমাবদ্ধ নয়, এর পেছনে রয়েছে রক্তক্ষয়ী সংঘাতের ইতিহাস ও বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা। বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন, তা নিয়ে লিখেছেন এস কে তৌফিক হকমোহাম্মাদ ঈসা ইবন বেলাল

পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার দুই দিনের সফরে শনিবার দুপুরে ঢাকায় আসেন। ২৩ আগস্ট, ২০২৫ছবি: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে পাওয়া

দীর্ঘদিনের নীরবতা ভেঙে আবারও আলোচনার টেবিলে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক। সাম্প্রতিক পাকিস্তানের দুই শীর্ষ মন্ত্রীর সফর দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

২১ আগস্ট পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খান ঢাকায় এসে চার দিনের সফরে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা জোরদারে নানা কর্মসূচিতে অংশ নেন। তার ঠিক পরেই ২৩ আগস্ট পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও উপপ্রধানমন্ত্রী ইসহাক দার দুই দিনের সফরে ঢাকায় আসেন এবং বাংলাদেশি নীতিনির্ধারক ও রাজনীতিবিদদের সঙ্গে বৈঠক করেন।

এসব সফরে শুধু বৈঠকই হয়নি, বরং কূটনীতি, বাণিজ্য ও সংস্কৃতি বিনিময় জোরদারের লক্ষ্যে একাধিক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। দীর্ঘ শীতলতার পর এমন তৎপরতা ইঙ্গিত দিচ্ছে, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্ক হয়তো এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছে।

মূলত চব্বিশের আগস্ট–পরবর্তী সময় থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কিছুটা স্বাভাবিকের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পাকিস্তান থেকে জাহাজভর্তি মালামাল বাংলাদেশে আসা শুরু হয় এবং আরও নানা ক্ষেত্রে সহযোগিতার নতুন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল। যেটি পূর্ববর্তী সময়ে শেখ হাসিনার আমলে প্রায় সম্পূর্ণরূপে বন্ধ ছিল।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক অন্য সব দেশের মতো নয়। কারণ, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী নির্বিচার হত্যা, নারী নির্যাতনসহ নানান মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছিল। তাই পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক কখনোই কেবল কূটনৈতিক স্বার্থের ভিত্তিতে সীমাবদ্ধ নয়, এর পেছনে রয়েছে রক্তক্ষয়ী সংঘাতের ইতিহাস ও বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা। ফলে এই সম্পর্ক স্বাভাবিক হলেও তা অন্য দেশের সঙ্গে সম্পর্কের মতো সরল নয়। ফলে এ কারণেই বাংলাদেশকে সতর্কতার সঙ্গে ও সম্ভাব্য ঝুঁকি মাথায় রেখে ভবিষ্যৎ কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

তবে আমরা পৃথিবীর ইতিহাসে তাকালে দেখতে পাই, যারা একসময় একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল, তারাও পরবর্তী সময় কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থে সম্পর্ক পুনর্গঠন করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র জাপানের ওপর দুটি পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করেছিল; কিন্তু আজ তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিদ্যমান।একইভাবে জার্মানি ও ইউরোপের অন্যান্য দেশ যারা যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ ছিল, তারা যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে একসঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো কাঠামো গড়ে তুলেছে।

অর্থাৎ যুদ্ধ মানেই যেকোনো দেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থায়ীভাবে ছিন্ন হয়ে যাবে—এমন কোনো নিয়ম আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে নেই। বরং রাষ্ট্রগুলো নিজেদের স্বার্থ রক্ষা ও ভবিষ্যৎ কৌশলগত সুবিধা অর্জনের জন্য সম্পর্ক পুনর্নির্মাণের পথ খোঁজে এবং বহুমাত্রিক সহযোগিতায় এগিয়ে যায়।

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সম্পর্কের শর্ত

বাংলাদেশ শুধু আবেগ নয়; বরং সতর্কতা, সম্মান ও স্বার্থ—তিনটি উপাদানকে সামনে রেখেই পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক নতুন করে সূচনার চেষ্টা করছে। এর প্রমাণ আমরা পেয়েছি কিছুদিন আগে ঢাকায় অনুষ্ঠিত পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকে। সে সময় বাংলাদেশ পাকিস্তানকে তিনটি শর্ত উপস্থাপন করে।

প্রথমত, পাকিস্তানকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ভূমিকার জন্য নিঃশর্তভাবে ক্ষমা চাইতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনারা যেভাবে নির্বিচার গণহত্যা, নারী নির্যাতন এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ চালিয়েছিল, তার দায় তারা আজও স্বীকার করেনি। একটি টেকসই সম্পর্কের জন্য এই দায় স্বীকার ও ক্ষমা প্রার্থনা জরুরি।

দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানকে বাংলাদেশের ক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ শুধু প্রাণহানি নয়, দেশের অবকাঠামো, অর্থনীতি ও সামাজিক কাঠামোতেও ভয়াবহ ধ্বংস ডেকে এনেছিল। তাই ক্ষতিপূরণের বিষয়টি শুধু প্রতীকী নয়, বরং একটি বাস্তব দাবি, যা যুদ্ধ-পরবর্তী ন্যায়বিচার ও ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতার অংশ।

আমরা যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই, তবে দেখব যে ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে শেখ মুজিবুর রহমানই প্রথম পাকিস্তান সফর করেন ওআইসি সম্মেলনে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে পাকিস্তান সফরকারী তিনিই প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান। এই সফরের মধ্য দিয়েই তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রাথমিক পদক্ষেপ নেন।

তৃতীয়ত, পাকিস্তানে ও বাংলাদেশে এখনো আটকে থাকা লোকদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ১৯৭১ সালের পর বহু পরিবার ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে এবং আজও অনেকেই পাকিস্তানে ও বাংলাদেশে থেকে গেছেন নাগরিকত্ব বা আইনি স্বীকৃতি ছাড়াই। তাদের প্রত্যাবর্তন মানবিকতার পাশাপাশি দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্যও অপরিহার্য।

এই তিনটি শর্ত থেকে স্পষ্ট যে, বাংলাদেশ ১৯৭১-এর ঐতিহাসিক পটভূমিকে উপেক্ষা করে নয়, বরং সেটিকেই ভিত্তি ধরে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠন করতে চায়। যুদ্ধ-পরবর্তী সম্পর্ক পুনর্গঠন মানে আগের ক্ষতগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া নয়, বরং সেগুলোর একটি ন্যায্য মীমাংসার মাধ্যমেই ভবিষ্যতের সম্পর্ক দৃঢ় হয়। যেমনটা আমরা ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে জার্মানি এবং অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের সম্পর্ক পুনর্নির্মাণে দেখতে পাই।

বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা

আমরা যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই, তবে দেখব যে ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে শেখ মুজিবুর রহমানই প্রথম পাকিস্তান সফর করেন ওআইসি সম্মেলনে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে পাকিস্তান সফরকারী তিনিই প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান। এই সফরের মধ্য দিয়েই তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রাথমিক পদক্ষেপ নেন।

এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে এগোলেও ইতিহাসের যে অমীমাংসিত প্রশ্নগুলো ছিল, যেমন ১৯৭১ সালের গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, নারীর ওপর পাশবিক নির্যাতন কিংবা যুদ্ধকালীন ধ্বংসযজ্ঞের দায়—এসব বিষয় তখন আলোচনার টেবিলে তুলতে ভোলেননি। ফলে ১৯৭৪ সালে ত্রিপক্ষীয় চুক্তিতে পাকিস্তান অপরাধের ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং একই বছর জুলফিকার আলী ভুট্টো যখন বাংলাদেশ সফরে আসেন তখন একাত্তরের অপরাধের জন্য অনুশোচনা প্রকাশ করেন।

১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতায় আসা খন্দকার মোশতাক আহমেদ পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উষ্ণ করার চেষ্টা করেছিলেন। পাকিস্তান সরকার তখন বাংলাদেশের নতুন সরকারকে দ্রুত স্বীকৃতি জানায়। মোশতাক সরকারও পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগ বাড়াতে আগ্রহী ছিল, তবে তাঁর স্বল্পমেয়াদি শাসনকাল এই প্রচেষ্টাকে দীর্ঘমেয়াদি রূপ দিতে পারেনি।

আরও পড়ুন

শেখ মুজিবুর রহমান পর জেনারেল জিয়াউর রহমান পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখেন। তিনি ইসলামী বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান শক্ত করতে পাকিস্তানকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। এর ফলে বাংলাদেশ-পাকিস্তান দ্বিপক্ষীয় বৈঠক বেড়ে যায় এবং দুই দেশ আবারও সীমিত বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের পথে হাঁটে। জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালে পাকিস্তান সফর করলে তার সময়েই বাংলাদেশ ও পাকিস্তান আবার ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করে।

জিয়ার পর হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ একই ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন। তিনি নিজে পাকিস্তান সফর করেন এবং প্রতিরক্ষা ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বিষয়ে কয়েকটি সমঝোতা এগিয়ে নেন। ১৯৮০-এর দশকে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সামরিক প্রশিক্ষণ সহযোগিতাও বৃদ্ধি পায়।

পরবর্তী সময় বিএনপি সরকারের আমলে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়। ১৯৯২ সালে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ইসলামাবাদ সফর করেন। তাঁর সময়ে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য এবং প্রতিরক্ষা সহযোগিতা প্রসারের চেষ্টা হয়। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে সরাসরি ফ্লাইট, শিক্ষার্থী বিনিময় এবং ব্যবসায়ী মিশনের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ২০০২ সালে পারভেজ মোশাররফ বাংলাদেশ সফর করার সময় একাত্তরে তাঁদের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চান।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে পৌঁছায়। মূলত ‘অ্যান্টি-পাকিস্তান পলিসি’কে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য ব্যবহার করতে থাকে। বিরোধী দল দমন ও ভারতকে তুষ্ট করার জন্য আওয়ামী লীগ এই পদ্ধতি নিয়েছে বলে অনেকে ধারণা করেন। সর্বশেষ চব্বিশের আন্দোলনেও শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ আখ্যা দিয়ে অপমানিত করেন এবং নির্বিচার হামলা-হত্যার পক্ষে যুক্তি দাঁড় করার চেষ্টা করেন।

একদিকে পাকিস্তানের কাছ থেকে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা এবং ঐতিহাসিক দায় স্বীকারের দাবি অবশ্যই ভবিষ্যতেও থাকবে, অন্যদিকে এ বিষয়টিকে ব্যবহার করে যেন দেশের মানুষকে আবার বিভক্ত করা না যায়—সেটি নিয়েও সমান সতর্ক থাকা প্রয়োজন। ইতিহাস ভুলে যাওয়া যাবে না, পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নও আড়াল করা যাবে না। কিন্তু এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে জনগণের ঐক্য নষ্ট করাও কোনোভাবেই মেনে নেওয়া উচিত নয়।

কেমন হতে চলছে আগামীর সম্পর্ক

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্ক নতুন করে স্বাভাবিকীকরণের পথে অগ্রসর হচ্ছে মূলত অর্থনীতি, কূটনীতি এবং শিক্ষা-সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দুই দেশের বাণিজ্য ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ৮৬৫ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এর মধ্যে পাকিস্তান থেকে আমদানি প্রায় ৭৮৭ মিলিয়ন ডলার আর বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে রপ্তানি ৭৮ মিলিয়ন ডলার।

এই বৈষম্য কমাতে বাংলাদেশের সামনে রয়েছে পোশাক খাত, ফার্মাসিউটিক্যালস, পাটজাত দ্রব্য এবং সিরামিক রপ্তানির সুযোগ। অপর দিকে পাকিস্তান থেকে আসতে পারে তুলা, সুতা, ক্লিংকার, রাসায়নিক ও কাগজজাত পণ্য। সাম্প্রতিক সময়ে সরাসরি শিপিং লাইন চালুর ফলে করাচি-চট্টগ্রাম পোর্টের মধ্যে ট্রানজিট সময় ১১ দিনে নেমে এসেছে, যা উভয় দেশের বাণিজ্য সম্প্রসারণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

এই পটভূমিতে ২২ আগস্ট দুই দেশের মধ্যে ‘যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ’ গঠনের জন্য একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে, যা বাণিজ্য ও বিনিয়োগকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার একটি পদক্ষেপ।

কানেকটিভিটির ক্ষেত্রেও নতুন সম্ভাবনা উন্মোচিত হচ্ছে। সরাসরি শিপিং লাইন চালুর পর এবার দুই দেশের মধ্যে ঢাকা-করাচি বা ঢাকা-লাহোর রুটে সরাসরি বিমান যোগাযোগ আবার চালুর বিষয়ে আলোচনা চলছে। একই সঙ্গে কূটনৈতিক ও সরকারি পাসপোর্টধারীদের জন্য ভিসামুক্ত প্রবেশের প্রস্তাব ইতিমধ্যেই আলোচনায় এসেছে, যা ভবিষ্যতে সাধারণ ভ্রমণকারীদের জন্য ভিসাসহজীকরণের পথ খুলে দিতে পারে। এসব উদ্যোগের ফলে শুধু ব্যবসায়িক সহযোগিতাই নয়, জনগণের পারস্পরিক যাতায়াতও বৃদ্ধি পাবে।

শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে উভয় দেশই একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতা জোরদার করতে আগ্রহী। সম্প্রতি দুই দেশের ফরেন সার্ভিস একাডেমির মধ্যে প্রশিক্ষণ ও জ্ঞানবিনিময়ের জন্য সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। পাকিস্তান বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য স্কলারশিপের প্রস্তাব দিয়েছে, যা শিক্ষার্থী বিনিময় কার্যক্রমকে এগিয়ে নেবে।

একই সঙ্গে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বিএসএস) ও পাকিস্তানের অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপিপি) মধ্যে কনটেন্ট শেয়ারিং ও সহযোগিতার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সাংস্কৃতিক দল ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতার মতো কার্যক্রম পারস্পরিক বোঝাপড়া ও আস্থা বৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারে।

১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাংলাদেশের ওপর যে ভয়াবহ ক্ষতি ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, তা যেমন অনস্বীকার্য সত্য, তেমনি এটাও সত্য যে পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নানা রাজনৈতিক শক্তি অনেক সময় ‘অ্যান্টি-পাকিস্তান ন্যারেটিভ’–কে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও ঐক্যের প্রশ্নে এই বিষয় অনেক সময়ই বিভাজনের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

একদিকে পাকিস্তানের কাছ থেকে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা এবং ঐতিহাসিক দায় স্বীকারের দাবি অবশ্যই ভবিষ্যতেও থাকবে, অন্যদিকে এ বিষয়টিকে ব্যবহার করে যেন দেশের মানুষকে আবার বিভক্ত করা না যায়—সেটি নিয়েও সমান সতর্ক থাকা প্রয়োজন। ইতিহাস ভুলে যাওয়া যাবে না, পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নও আড়াল করা যাবে না। কিন্তু এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে জনগণের ঐক্য নষ্ট করাও কোনোভাবেই মেনে নেওয়া উচিত নয়।

এ রকম অবস্থায় বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারকে এখন দ্বৈত সচেতনতা বজায় রাখতে হবে, একদিকে পাকিস্তানের ঐতিহাসিক দায় মীমাংসার প্রশ্নে দৃঢ় থাকতে হবে। অন্যদিকে অভ্যন্তরীণভাবে এ বিষয়কে রাজনৈতিক বিভাজনের হাতিয়ার বানাতে না দিয়ে জাতীয় ঐক্য ও উন্নয়নের পথে অগ্রসর হতে হবে।

সবশেষে বলা যায়, ইসহাক দার ও জাম কামাল খানের সফর প্রতীকী ও কৌশলগত উভয় ক্ষেত্রেই নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে। এটি একটি মাইলফলক সফর হবে, নাকি হারানো সুযোগে পরিণত হবে, তা নির্ভর করছে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান কতটা দক্ষতার সঙ্গে ইতিহাস, রাজনীতি ও বাস্তবতাকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে পারে তার ওপর। অতীতকে না ভুলে, বর্তমানের জাতীয় স্বার্থের বাস্তবতায় সম্পর্ককে এগিয়ে নেওয়াই হতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার এই দুই দেশের জন্য একটি গঠনমূলক পথ।

  • এস কে তৌফিক হক প্রফেসর ও ডিরেক্টর, সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্স (এসআইপিজি), নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

  • মোহাম্মাদ ঈসা ইবন বেলাল গবেষণা সহযোগী, সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্স (এসআইপিজি), নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।

* মতামত লেখকদের নিজস্ব