বাংলাদেশের বিস্ময়কর উন্নয়ন: বিনিয়োগের পালে দিচ্ছে জোর হাওয়া

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অবকাঠামো খাতে বাংলাদেশের যেসব অর্জন, তার মধ্যে অন্যতম পদ্মা সেতুফাইল ছবি : প্রথম আলো

এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, বাংলাদেশের উন্নয়ন সমালোচক, শত্রু এবং এমনকি বন্ধুদের প্রত্যাশাগুলোকেও ছাড়িয়ে গেছে। বিশেষ করে বর্তমান সরকারের বিচক্ষণ নেতৃত্বে গত এক দশকে সেটা আরও মূর্ত হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশিরা যে দৃঢ়তার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন, সেটিই আমাদের পরবর্তী ধাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ২০২৬ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পৌঁছবে। বাংলাদেশের ধারাবাহিক উন্নতিকে যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় স্বীকৃতি দিয়েছে, এটা তারই প্রমাণ।

২০০৯ সালে, বৈশ্বিক অর্থনীতির মন্দাকালে, বাংলাদেশ সরকার অবকাঠামো খাতে বিশাল-বিশাল প্রকল্প গ্রহণ করে। সেসব প্রকল্প শুধু স্থানীয় অর্থায়নে নয়, দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় উৎস থেকে নেওয়া ঋণে বাস্তবায়ন শুরু হয়েছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অবকাঠামো খাতে বাংলাদেশের যেসব অর্জন, তার মধ্যে অন্যতম পদ্মা সেতু। প্রায় ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ সেতুতে গাঙ্গেয় অঞ্চলের সবচেয়ে দীর্ঘতম সেতু। ঢাকা মেট্রোরেল, মহাসড়ক, ডিজিটাল বাংলাদেশ (সবার জন্য ইন্টারনেট প্রবেশগম্যতা), সবার জন্য বিদ্যুৎ নিশ্চিত করার জন্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ এবং গভীর সমুদ্রবন্দরের মতো প্রকল্পও রয়েছে। এসব কিছুই দেশটির ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিত্তি গড়ে দিয়েছে।

এই উন্নয়ন প্রকল্পগুলো পুরো বাংলাদেশকেই উৎপাদনশীল করে তুলছে। এমনকি আগে যেসব অঞ্চলে যোগাযোগব্যবস্থা কম উন্নত ছিল, সেগুলোকেও উৎপাদনশীলতার বলয়ে নিয়ে আসা সম্ভব হচ্ছে। আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ রুটের বিমানবন্দরগুলো সম্প্রসারণের ফলে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগব্যবস্থায় (কানেকটিভিটিতে) নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। এটা স্পষ্টত, বাংলাদেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সামনে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে।

বাংলাদেশের জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা এখন ২৫ হাজার মেগাওয়াট। নতুন বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) আসার জন্য অথবা দেশের ভেতরে উৎপাদন ও শিল্প খাতের উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট বিদ্যুৎ দেওয়ার সক্ষমতা বাংলাদেশের এখন আছে। জ্বালানি নিরাপত্তা আরও নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশের ভাসমান টার্মিনালের (ফ্লোটিং স্টোরেজ রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট বা এফএসআরইউ) বহরে আরও দুটি টার্মিনাল যুক্ত হচ্ছে।

এর ফলে আমদানি করা তরলীকৃত গ্যাস (এলএনজি) রিগ্যাসিফিকেশন করে পাইপলাইনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় আরও প্রাকৃতিক গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা সম্ভব হবে। এতে শিল্প উৎপাদন, সার উৎপাদন, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও গৃহস্থালিতে দুই হাজার মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফডি) গ্যাস সরবরাহ করা যাবে।

ডিজিটাল পরিসরেও দেশে ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটা কানেকটিভিটি তৈরি করতে পেরেছে। দেশজুড়ে তৈরি হওয়া টেলিযোগাযোগ ও ইন্টারনেট যোগাযোগের বদৌলতে যে কেউ এখন হাতে থাকা মুঠোফোনে আঙুলের স্পর্শ করেই যেকোনো তথ্য পেতে পারেন। ২০০৮ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকল্প ঘোষণা করা হয়েছিল। এই প্রকল্পটি ‘ডিজিটাল বিভক্তি’ কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। এটি অর্থনীতি ও শিক্ষাক্ষেত্রে প্রভাব রেখেছে এবং সামাজিক বৈষম্য নিরসনে ভূমিকা রেখেছে।

ইনফো-সরকার-এই ই-গভর্ন্যান্স উদ্যোগের মাধ্যমে অসংখ্য সরকারি সেবাকে অনলাইনে সহজলভ্য করা সম্ভব হয়েছে, যা ব্যবসা সহজীকরণের জায়গাটিকে উন্নত করেছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগুলো দ্রুত উন্নয়নের ফলে এমন একটা জায়গা তৈরি করেছে, যেখান থেকে দেশটির পক্ষে তার সক্ষমতাকে আরও দূর পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া সম্ভবপর হয়েছে।

উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রা মডেল হিসেবে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান সরকারের স্থিতিশীলতা ও প্রগতিশীল নীতিগুলো সন্দেহাতীতভাবে এই অবিস্মরণীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশের অবিস্মরণীয় অবকাঠামোগত উন্নয়ন বিবেচনায় জিডিপি অনুপাতে ঋণের হার অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় কম। বর্তমান জিডিপি অনুপাতে ঋণের হার ৩৯।

দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মাঝে অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ একটি ভৌগোলিক সুবিধা ভোগ করছে। এ অঞ্চলগুলোর মধ্যে এবং একইসঙ্গে ভারতের সাত কন্যা বলে পরিচিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর সঙ্গে- বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সেতু বাংলাদেশ। ভৌগোলিক এই অবস্থান দেশটিকে আঞ্চলিক যোগাযোগব্যবস্থায় (কানেকটিভিটি) যুক্ত থাকা এবং বাণিজ্যের ক্ষেত্রে (বিশেষ করে ভারত, চীন ও আসিয়ানের সঙ্গে) বিশাল এক সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।

বর্তমানে তৈরি পোশাকশিল্প দেশটির রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে প্রাধান্য করছে। ৮০ শতাংশের বেশি রপ্তানি আয় এ খাতেই আসছে। তৈরি পোশাকশিল্পের ধারাবাহিক বিকাশের যে অভিজ্ঞতা, তার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ এখন তার উৎপাদন খাতকে বহুমুখী ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে ভালো একটা অবস্থানে রয়েছে। চামড়া, পাটজাত পণ্য, স্বাস্থ্যসেবা, ওষুধ, সিরামিকস ও ইন্টারনেট সেবা শিল্পের দ্রুত বিকাশ উৎপাদন খাতের এই পরিবর্তনের সাক্ষ্য দিচ্ছে।

তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে একটা ‘সবুজ রূপান্তরের’ ভিত্তি গড়ার দিকে যাত্রা শুরু করেছে বাংলাদেশ। প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এর ফলে সার্ভিস প্রোভাইডার বা সেবা প্রদানের একটা বড় উদ্যোক্তা গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে।
জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজিএস) পৌঁছাতে বাংলাদেশ বড় ধরনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গত বছর দেশটি সফলভাবে দুটি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে সক্ষম হয়-এসডিজি-১২ বা টেকসই উন্নয়ন ও ভোগ এবং এসডিজি-১৩ বা জলবায়ুবিষয়ক পদক্ষেপ।

একটা বিশাল ও সহজলভ্য শ্রমশক্তি দিয়ে বাংলাদেশ উদীয়মান বাজারের সুবিধা গ্রহণ করতে পারে। দেশটির অর্থনৈতিক উন্নয়নে সাত কোটির বেশি শ্রমশক্তি নিয়োজিত। এছাড়া ২০১৭ সাল থেকে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৩০ লাখ কর্মী নতুন করে শ্রমবাজারে যুক্ত হচ্ছেন। বাংলাদেশের ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার চার ভাগের এক ভাগ। ফলে তরুণ ও প্রাণবন্ত এমন একটি শ্রমশক্তি বাংলাদেশের রয়েছে, যা দেশটির অর্থনীতিকে আরও দ্রুত এগিয়ে নিতে সক্ষম।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রধান প্রধান সামাজিক সূচকে ইতিবাচক প্রভাব রাখছে। ২০০৪ সালে সাক্ষরতার হার ছিল ৫১ দশমিক ৬, সেখানে ২০২২ সালে সাক্ষরতার হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৪ দশমিক ৬। জনমিতিতে তরুণ জনগোষ্ঠীর যে আধিক্য, তা থেকে লাভ তুলতে সাক্ষরতার হারের এই অগ্রগতি নিঃসন্দেহে ভূমিকা রাখছে। শিক্ষাক্ষেত্রে লিঙ্গসমতা অর্জনে অগ্রগতি ঘটেছে, মাতৃমৃত্যুর হার দৃশ্যমানভাবে কমেছে। এসব অগ্রগতি আরও উৎপাদনশীল ও দক্ষ কর্মী বাহিনী তৈরিতে অবদান রেখেছে।

কঠোর পরিশ্রমী এক কোটির বেশি প্রবাসীর (বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের) আনুষ্ঠানিক পথে পাঠানো প্রবাসী আয়ের প্রবাহ ক্রমাগত বাড়ছে, যা দেশটির বাণিজ্য ঘাটতি মোকাবিলায় বড় ভূমিকা রাখছে। এর ইতিবাচক ফলাফল হচ্ছে, বাংলাদেশকে কখনোই ব্যালেন্স অব পেমেন্ট বা বৈদেশিক লেনদেনে চলতি হিসাবের ভারসাম্যের সংকটে পড়তে হয়নি। এটি নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশের টেকসই অর্থনীতি এবং কয়েক দশক ধরে চলা ধারাবাহিক অগ্রগতির সাক্ষ্য দিচ্ছে। এ ছাড়া তৈরি পোশাকশিল্পে যে বিপুলসংখ্যক নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে, তাতে দেশটিতে লিঙ্গসমতা ও মজুরিসমতা শক্তিশালী হয়েছে।

এরপর বাংলাদেশে দ্রুত বর্ধনশীল একটা মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠছে। বাংলাদেশি মধ্যবিত্তে শ্রেণির এই বিকাশের কারণে অভ্যন্তরীণভাবে ভোগের চাহিদা বেড়েছে। এর ফলে রিটেইল বা পণ্য পরিষেবা, আবাসন ও সেবা খাতের ব্যাপক প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। এর ফলাফল হলো, এই উদীয়মান মধ্যবিত্ত শ্রেণি ভোগ্যপণ্য, আর্থিক সেবা খাত, প্রযুক্তি, ই-কমার্স, স্বাস্থ্যসেবা ও অন্যান্য খাতে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আকৃষ্ট করছে।

আঞ্চলিক বাজারগুলো, বিশেষ করে ভুটান, নেপাল ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাজারগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতির বহুমুখী রূপান্তরে ভীষণভাবে লাভবান হবে। এসব বাজারে নতুন মধ্য শ্রেণির উত্থানের মধ্য দিয়ে একটা শক্তিশালী ভোক্তাগোষ্ঠী জন্ম হচ্ছে।

উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রা মডেল হিসেবে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান সরকারের স্থিতিশীলতা ও প্রগতিশীল নীতিগুলো সন্দেহাতীতভাবে এই অবিস্মরণীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশের অবিস্মরণীয় অবকাঠামোগত উন্নয়ন বিবেচনায় জিডিপি অনুপাতে ঋণের হার অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় কম। বর্তমান জিডিপি অনুপাতে ঋণের হার ৩৯।

অবকাঠামো খাতে উন্নয়নের ফসল কাটতে শুরু করেছে বাংলাদেশি জনগণ ও এখানকার ব্যবসা– সেটা ভৌত ও সামাজিক দুইভাবেই। এর পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে অভূতপূর্ব মাত্রায় রাজস্ব আনা সম্ভব। এটা বাংলাদেশকে ৬ থেকে ৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম করে তুলবে।

  • মুহাম্মদ আজিজ খান সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান।

ডেইলি স্টার থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ : মনোজ দে