আমাদের দেশে এক নামে অনেক নদ–নদী আছে, এক নদ–নদীরও আছে অনেক নাম। এখন পর্যন্ত যতটুকু জানা যায়, ইছামতী নামে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক নদী আছে। সরকারি তালিকায় আছে মোট ১৪টি নাম। এর বাইরে আরও ৪টি নাম পাওয়া গেছে। নদী–গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী জানিয়েছেন, ইছামতী নামে ১৮টি স্বতন্ত্র নদী আছে।
কয়েক বছর আগে মাহবুব সিদ্দিকী আমাকে বলেছিলেন, দেশে মোট ১২টি ইছামতী নদী আছে। এরপর আমার কাছ থেকে জেনে আদি রংপুর মাহিগঞ্জের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ইছামতীর নামটাও যোগ করলেন। তখন হলো ১৩টি। কয়েক দিন পর তিনি আমাকে বলছেন, মন্টেগুমারি মার্টিন একটি বইয়ে কুড়িগ্রামের ইছামতী নদীর কথা লিখেছেন।
আমিও মন্টেগুমারি মার্টিনের দ্য হিস্টিরি, আন্টিকস, টপোগ্রাফি অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিকস অব ইস্টার্ন ইন্ডিয়া (ভলিউম-৩) ঘেঁটে দেখলাম কুড়িগ্রামে ইছামতীর কথা উল্লেখ আছে। খোঁজ নিয়ে বুঝলাম, নদীর ভাঙাগড়ায় ওই ইছামতী বিলীন হয়েছে। এখন পর্যন্ত যে ১৮টি ইছামতী পাওয়া গেছে, আরও হয়তো থাকতে পারে।
দেশে করতোয়া নামে ৫টি, কাটাখালী নামে ৬, গজারিয়া নামে অন্তত ৮ ও ধলেশ্বরী নামে ৫টি নদী এবং সুতি নামে ৬, কুমার নামে ৫, ধলাই নামে ৬ ও পিয়াইন নামে ৫টি নদ আছে।
সিরাজগঞ্জে হুড়া সাগর নামে ৫টি, রংপুর জেলায় বুড়াইল নামে ৪, কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী উপজেলায় গিরাই নামে ৩টি স্বতন্ত্র নদ আছে। কেন একই নামে অনেক নদী, সেটি অনুসন্ধান করে বোঝার চেষ্টা করছি। মানাস নদের বুড়াইল নাম ধারণের বিষয়টি বুঝতে পেরেছি। রংপুর-কুড়িগ্রাম মহাসড়ক অতিক্রম করে বয়ে যাওয়া বুড়াইলের একটি শাখা ব্রাহ্মণীকুণ্ডা নামের স্থানে মানাস নদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার পর নাম হয়েছে বুড়াইল।
এখানে একটি ব্যাখ্যা দেওয়া যায়, বুড়াইলের শাখা নদীর কারণে এই নাম হতে পারে। যমুনেশ্বরী নদীর ক্ষেত্রেও এমনটি হয়েছে। করতোয়া নদীর সঙ্গে সোনরবন্দ নদ বদরগঞ্জে মিলিত হওয়ার পর নাম হয়েছে ঘিরনই। এই ঘিরনই যখন যমুনেশ্বরীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে, তখন আবারও করতোয়া নাম ধারণ করেছে। এই করতোয়াই বগুড়া দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সব ক্ষেত্রে এক নামে অনেক নদ–নদীর নাম হওয়ার কারণ জানা যায় না।
আবার এক নদীর অনেক নাম আমরা দেখেছি। যেমন কুড়িগ্রাম দিয়ে প্রবাহিত হওয়া একটি নদীর কয়েকটি নাম আছে। প্রায় ৩০ কিলোমিটারের নদীটি ধরলার শাখানদী ও উপনদী। কুড়িগ্রামের কাঁঠালবাড়ীতে ধরলা নদীর শাখা নদী হিসেবে প্রবাহিত হতে শুরু করেছে। উৎসস্থলে এ নদীর নাম নয়া নদ। এরপর নাম হয়েছে হাজির নদ। তার কিছু দূর পরে সৈন্যাসীর ডারা নামে পরিচিত। এ নদীকে আরও ভাটিতে খলিশাকুড়ি নামেও ডাকা হয়। তারও খানিকটা ভাটিতে এ নদীর নাম শিয়ালডুবি। আরও ভাটিতে গর্ভের দোলা। চণ্ডীমারী নদীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার পর নাম হয়েছে অর্জুনের ডারা।
কেউ যদি সরেজমিন অনুসন্ধান ছাড়াই নদীর কেবল নাম অনুসন্ধান করে সিদ্ধান্তে আসতে চান, তখন উল্লিখিত নদীটি নয়া, হাজির, খলিশাকুড়ি, সন্যাসীর ডারা, শিয়ালডুবি, গর্ভের দোলা ও অর্জুনের ডারা ৭টি নদ–নদী হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। লালমনিরহাটে সতী নদী আছে। উৎসস্থলে নাম সতী হলেও ভাটিতে কোথাও দিক সতী, কোথাও তিস্তা নামে পরিচিত। বাস্তবে সতী এখন মরা সতী নামে পরিচিত।
নদীর সংখ্যানির্ধারণী কাজে সরেজেমিন অনুসন্ধান যথাযথ না হলে সংখ্যাবিষয়ক জটিলতা দেখা দেবে। সে জন্য আমরা যখনই সরেজমিন নদীর অনুসন্ধান করি, তখন চেষ্টা করি পাড়ে পাড়ে নদীকে দেখার। একই নদীর আলাদা নাম থাকলেও সেটি ভিন্ন নামে এক নদী হিসেবে আমরা গ্রহণ করি।
নদীর নাম পরিবর্তনের কিছু বাস্তব ভিত্তি আছে। দুটি নদী একত্রে মিলিত হওয়ার পর যে ধারা তৈরি হয়, সেটিকে আলাদা একটি নদী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। একাধিক প্রবাহ মিলিত হলে নবসৃষ্ট প্রবাহটির গতিপ্রকৃতি-ধরন বদলে যায়। আমাদের বড় বড় নদ–নদীর মধ্যেও এমনটি ঘটেছে। যেমন ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা দুটি স্বতন্ত্র বড় নদ–নদী। কুড়িগ্রামের চিলমারী ও গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে নদী দুটি মিলিত হয়েছে। এরপর এ নদীর নাম হয়েছে যমুনা। একইভাবে যমুনা যখন রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে গঙ্গা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে, তারপর নাম হয়েছে পদ্মা। যদিও পদ্মার ব্যাপক প্রচলনে উজানে রাজশাহীতে পদ্মা নামেই গঙ্গাকে ডাকা হচ্ছে। সুদূর অতীতে গঙ্গা-যমুনার মিলিত ধারা পদ্মা নামে প্রবাহিত হতো।
আমাদের নদীর সংখ্যানির্ধারণীতে আরেকটি সীমাবদ্ধতা আছে। যেমন পঞ্চগড়ের করতোয়া নদী আত্রাই নাম নিয়ে ভারতে প্রবশে করেছে। এই নদী যখন ভারত থেকে আবারও বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, তখন সেটি আরেক আত্রাই হিসেবে ধরা হচ্ছে। আবার ধরলাও বাংলাদেশে প্রবেশ করার পর আবারও ভারতে প্রবেশ করেছে। তারপর আবারও বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এখানে ধরলাকে দুটি হিসেবে দেখানো হয়নি।
এক নামে অনেক নদী যদি কাছাকাছি থাকে, তাহলে বিভ্রান্তি দেখা দেয়। রংপুরে যখনই আমরা বুড়াইল নদের কথা বলি, তখনই যাঁরা নদী সম্পর্কে খবর রাখেন না, তাঁরা সব সময় একটি বুড়াইলকে বোঝেন। একইভাবে বুড়িতিস্তার কথা তুললে সবাই নীলফামারীর বুড়িতিস্তাকে বোঝেন। আরও যে বুড়িতিস্তা আছে, সেগুলোর কথা শুরুতে ভাবা হয় না।
এমনও হয়েছে, আমরা নতুন নদীর নাম জেনে দেখতে গিয়ে জেনেছি, আমাদের পরিচিত অন্য নদীরই আরেক ভিন্ন নাম। আমাদের দেশের নদীগুলোর একটি ম্যাপ প্রস্তুত করা প্রয়োজন। তাহলে কোথায় কোন নাম আছে, তা সহজে চিহ্নিত করা যাবে। এক নামে একাধিক নদী থাকলেও সেগুলো সহজে চিহ্নিত হবে। অর্ধশতাধিক বছরে দেশের সব নদী সম্পর্কে আলাদা পরিচয় না থাকা দুঃখজনক। অন্তর্বর্তী সরকার ১ হাজার ৪১৫টি নদীর সন্ধান দিয়েছে। আমরা মনে করি, আর কিছুটা কাজ করা সম্ভব হলে দেশের সব নদীর একটি মানচিত্র প্রস্তুত করা সম্ভব।
● তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক