গ্রিক বীর থিসিয়াসের একটি জাহাজ ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জাহাজের কাঠ, পেরেক, পাল একে একে নষ্ট হতে থাকে। প্রতিবার নষ্ট অংশ নতুন অংশ দিয়ে বদলে দেওয়া হয়। একসময় দেখা গেল, জাহাজের প্রথম দিকের কোনো অংশই আর নেই। তখন প্রশ্ন ওঠে, এই জাহাজই কি এখনো থিসিয়াসের আসল জাহাজ? এখানেই তর্ক শুরু।
একদল বলে, হ্যাঁ, এটিই থিসিয়াসের জাহাজ। কারণ, পরিবর্তন ধীরে ধীরে হয়েছে। জাহাজের ব্যবহার, নাম, কাজের ধারাবাহিকতা কখনো ভাঙেনি। আরেক দল বলে, না, এটি আর থিসিয়াসের জাহাজ নয়। কারণ, আসল জাহাজ গঠিত হয়েছিল যা কিছু দিয়ে, সেসব বদলে গেছে, ফলে জাহাজটি আর সেই আসল জাহাজ নেই।
চলুন, ধরে নিই সেই জাহাজের নাম জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। আর বীর থিসিয়াস হচ্ছেন ২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণেরা। এনসিপি গঠন করা হয়েছিল বৈষম্যহীন একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ গড়ার শপথ নিয়ে।
দলটি সম্প্রতি মাত্র ৩০টি আসন সমঝোতার বিনিময়ে জোট বেঁধেছে ডানপন্থীদের প্রধান রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে।
প্রশ্ন উঠছে, এটা কী সেই একই এনসিপি, যারা মধ্যপন্থী রাজনীতির কান্ডারি হতে এসেছিল? তাদের কেন ডানপন্থীদের সঙ্গে ভীড়তে হলো? আর যদি তারা ডানপন্থাতেই নিজেদের আশ্রয় খুঁজে পায়, তাহলে কী হবে তাঁদের প্রতিশ্রুত রাজনীতির?
২.
জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর তরুণসমাজ একটি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিল, তাদের সেই আকাঙ্ক্ষাকে পুঁজি করে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক শক্তির বিচ্যুতি আজ এক গভীর সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এনসিপি যে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বৈষম্যহীন রাজনীতির প্রতিশ্রুতি দিয়ে পথচলা শুরু করেছিল, সাম্প্রতিক সময়ে তাদের কৌশলগত সিদ্ধান্তগুলো সেই আদর্শের মূলে কুঠারাঘাত করেছে। আদর্শিক এই অবক্ষয় এবং ডানপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়ার কারণেই জুলাইয়ের তরুণদের অনেকেই আজ দলটির দ্বারা চরমভাবে প্রতারিত বোধ করছে। প্রতারিত বোধ করছে দলটিতে যুক্ত থাকা নেতা-কর্মীরাও।
এনসিপি ঐতিহাসিক কলঙ্কের ভাগীদার দল জামায়াতের দিকে ঝুঁকে পড়ার প্রেক্ষাপট হুট করে দেখা দেয়নি। এর লক্ষণ অনেক দিন ধরেই দেখা যাচ্ছিল। অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ নির্মাণের এজেন্ডা নিয়ে যাত্রা শুরু করা একটি রাজনৈতিক দল যখন তার প্রাথমিক বৈচিত্র্য হারায়, তখন স্বাভাবিকভাবেই তাদের নৈতিক পতনের ঘণ্টা বাজতে শুরু করে। অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির যেসব পোস্টার বয়কে এনসিপি মঞ্চে হাজির করেছিল, অলীক মৃ থেকে শুরু করে অনিক রায়ের মতো নানা ধর্মের, নানা বর্ণের ও নানা আদর্শের সঙ্গে সম্পৃক্ত সেসব নেতাদের বেশির ভাগই বহুদিন আগে দলটি ছেড়ে গেছেন।
সম্প্রতি দলটি থেকে প্রথম সারির নারীনেত্রীদের পদত্যাগের হিড়িক দেখা গেছে। এ অস্থিরতার মধ্য দিয়ে বোঝা যাচ্ছে এনসিপি এখন আর সবার জন্য নিরাপদ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারছে না। তাসনূভা জাবিন ও তাসনিম জারার মতো নারীনেত্রীদের পদত্যাগ এনসিপির অভ্যন্তরীণ পরিবেশের চরম অস্থিরতাকেই স্পষ্ট করে। দলটির নেতৃত্বের এই বিচ্যুতি কেবল ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়, বরং এটি গভীর রাজনৈতিক কৌশলের অংশ।
নেতা-কর্মীদের প্রবল আপত্তি থাকা সত্ত্বেও এনসিপি জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়েছে। এর আগেও দলটির নেতারা নারী কমিশনবিরোধী ও কট্টর ডানপন্থী বহু সমাবেশে অংশগ্রহণ করেছেন, নিজ দলের নারীনেত্রীদের আপত্তি সত্ত্বেও। মানে ডানপন্থীদের সাথে একাত্ব হওয়ার ঝোঁকটা সাম্প্রতিক নয়, প্রক্রিয়াটা চলছিল অনেক দিন ধরেই।
যে তারুণ্য একটি উদার ও বৈষম্যহীন সমাজ চেয়েছিল, তাদের কাছে জামায়াত-হেফাজতের সঙ্গে এনসিপির সখ্য একটি বড় ধাক্কা হিসেবে এসেছে। ধাক্কা খেয়েছে গণতান্ত্রিক সংস্কার জোটও।
কিছুদিন আগে ভোটের মাঠে বিএনপি ও জামায়াতের বাইরে ‘তৃতীয় শক্তি’ হয়ে ওঠার প্রত্যয় নিয়ে গঠিত হয়েছিল গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট। এনসিপির নেতৃত্বে আমার বাংলাদেশ পার্টি ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন ছিল সেই জোটে। মাত্র কয়েক দিনের মাথায় জোটসঙ্গীদের সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়াই জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতায় গেছে এনসিপি। এটি একদিকে যেমন এনসিপির রাজনৈতিক বিশ্বস্ততা নিয়ে প্রশ্ন দাঁড় করায়, অন্য দিকে তৈরি করে এনসিপির নৈতিক প্রত্যয় নিয়েও সন্দেহ।
নির্বাচনী কৌশলের ক্ষেত্রেও এনসিপি নীতিহীনতার পরিচয় দিয়েছে। সারা দেশে শতাধিক আসনে প্রার্থী ঘোষণার পর কেবল ৩০টি আসনের সমঝোতায় জামায়াতের কাছে আত্মসমর্পণ করা দলটির রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের প্রকাশ।
এর আগে গণ-অভ্যুত্থানের সময় ছাত্র-জনতাকে স্যালুট দিয়ে খ্যাতি পাওয়া রিক্সাচালক সুজনকে ঢাকা-৮ আসনে মনোনয়ন দেওয়া নিয়েও চকটদারি দেখিয়েছে দলটি। সুজন এনসিপির মনোনয়নপত্র নেওয়ার পর দলটির প্রথম সারির নেতাদের অনেককে উচ্চবাচ্য করতে দেখা গেছে মেহনতি মানুষের স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সুজনের নাম এনসিপির নির্বাচনী প্রার্থীর তালিকায় ঠাঁই পায়নি। এ ঘটনায় মনে করা স্বাভাবিক যে, মেহনতি মানুষের আবেগকে কেবল রাজনৈতিক ঢাল হিসেবে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে নৈতিক সততার পরিচয় তাঁরা দিতে পারেনি।
৩.
জুলাই অভ্যুত্থানের রক্তক্ষয়ী দিনগুলোতে যে তরুণেরা রাজপথে জীবন বাজি রেখেছিল, তারা নতুন ও স্বচ্ছ রাজনীতি প্রত্যাশা করেছিল। কিন্তু এনসিপির বর্তমান গতিপথ দেখে এটি স্পষ্ট যে দলটি এখন আর সাধারণ মানুষের স্বপ্নের প্রতিনিধি নয়, বরং ক্ষমতার ভাগ-বাঁটোয়ারার খেলায় মত্ত একটি গোষ্ঠী মাত্র। অন্তর্ভুক্তিমূলক সব মুখ হারিয়ে এবং ডানপন্থার বলয়ে আশ্রয় নিয়ে এনসিপি কার্যত সেই তারুণ্যকে ধোঁকা দিয়েছে, যারা তাদের মূল শক্তি ছিল।
জুলাইয়ের তারুণ্য এই প্রতারণা ভুলে যাবে না। কারণ, আন্দোলনের চেতনা কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর ক্ষমতার সিঁড়ি হওয়ার জন্য নয়, বরং একটি বৈষম্যহীন, দুর্নীতিমুক্ত বাসযোগ্য সমাজ গড়ার জন্য ছিল।
লেখার শুরুতে এনসিপিকে থিসিয়াসের সেই জাহাজের সঙ্গে শুরুতে তুলনা করেছিলাম। জাহাজটি যাত্রা শুরু করেছিল সব ধর্ম-বর্ণের মানুষকে নিয়ে একটি নিরাপদ গন্তব্যে পৌঁছানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে। কিন্তু নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থে এবং দ্রুত তীরের দেখা পাওয়ার লোভে নাবিকেরা বৈচিত্র্যময় যাত্রীদের একে একে মাঝনদীতে ফেলে দিয়েছে। সঙ্গে ফেলে দিয়েছে কিছু দিকনির্দেশককেও। তাঁরা জাহাজটিকে যেন নিয়ে যাচ্ছে একটি সংকীর্ণ ও বিপজ্জনক চোরাবালির দিকে। প্রশ্নটা এখন আর জাহাজের পরিচয়ে সীমাবদ্ধ নেই। বরং গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, অন্তর্ভুক্তির নকশায় তৈরি এই জাহাজ নিজের শুরুর দিকনির্দেশকদের ছাড়া আদৌ কোনো কুলে পৌঁছাতে পারবে কি না!
সৈকত আমীন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক।
ই–মেইল: [email protected]
*মতামত লেখকের নিজস্ব
