চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে সংসদে কেন এমন কটাক্ষ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফরম বিক্রি ও এর আয়–ব্যায় নিয়ে সম্প্রতি জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু একটি সমালোচনামূলক বক্তব্য দেন। এর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষকবৃন্দ: আদনান মান্নান, মাছুম আহমেদ, মনজুরুল আলম, মৌরী দে, কাজী তানভীর আহাম্মদ, অনুপম দাশগুপ্ত, মোহাম্মদ রেজওয়ানুল হক, মো. মাহবুব হাসান, তানজিনা শারমিন, সুমন ভট্টাচার্য, অনুপম কুমার দাশ, শান্ত বণিক

ভর্তি পরীক্ষা কেবল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় একাই নেয় না, দেশের ৫৫ টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা হয়।ফাইল ছবি

একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার আয়-ব্যয় নিয়ে মন্তব্যের আগে সেই পরীক্ষা পরিচালনার বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা আবশ্যক। ভর্তি পরীক্ষার নিরাপত্তাকাজে দীর্ঘ সময়ের জন্য নিযুক্ত করতে হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সদস্যকে, এই খাতে খরচও কম নয়।

রয়েছে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, সমীক্ষণ, কম্পোজ, ফটোকপিসহ পরীক্ষার উপকরণ-সংক্রান্ত বিশাল খরচ, বিভিন্ন কেন্দ্রে পরীক্ষা গ্রহণে বড় অঙ্কের পরিবহন ব্যয় এবং শত শত পরিদর্শকের সম্মানী। পরীক্ষা সম্পন্নে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে (শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশন, নোটিফিকেশন এসএমএস, এসএসসি এবং এইচএসসি ফলাফলের ডেটাবেজ সংগ্রহ, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস, সার্ভার রক্ষণাবেক্ষণসহ ইত্যাদি) খরচও কম নয়। অধিকন্তু, ভর্তি পরীক্ষার আয়ের ৪০ শতাংশ টাকা চলে যায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কাছে, যা পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ইউজিসির বার্ষিক বরাদ্দের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়।

ভর্তি পরীক্ষা কেবল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় একাই নেয় না, দেশের ৫৫ টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমান বা তার চেয়ে বেশি পরীক্ষার্থী থাকে দেশের অন্তত চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। অতিরিক্ত পরীক্ষার্থীর চাপে কয়েক শিফটে পরীক্ষা নিতে হয় কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং তাদের সম্মানীও যথাযথভাবে নিয়ম অনুসরণ করেই দেওয়া হয়, যা মোটাদাগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় দ্বিগুণ।

‘যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের—মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা...,’ আসলেই আমাদের কখনো সেই জীবন দেখা হবে না। কারণ, আমাদের আনন্দের উপলক্ষ মাসির্ডিজ গাড়ি বা বিলাসবহুল বাড়ি নয়। আমাদের ছাত্রী আফরিন যখন অক্সফোর্ডে যায় কিংবা ছাত্র জুনায়েদ যখন বিসিএস ক্যাডার হয় বা সুমিত যখন গুগলে চাকরি পায়, সেটাই আমাদের আপ্লুত করে।

কারও উপার্জনের তথ্য কিন্তু গণমাধ্যমে ফলাও করে বলা হয় না, টিভি চ্যানেলে কিংবা পত্রিকার পাতায় প্রকাশ করা হয় না এবং এটা বলার কথাও নয়। সবাই তাদের কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষা কমিটিসহ সংশ্লিষ্ট সব উচ্চপর্যায়ের কমিটি থেকে অনুমোদন নিয়েই পুরো ভর্তি পরীক্ষা পরিচালনা করে। তাহলে কোন যুক্তিতে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা না দেখে কেবল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ঢালাওভাবে কটাক্ষ করেন একজন মাননীয় সংসদ সদস্য?

আমরা সাধারণ শিক্ষক। সম্মানী না দিলেও আমরা পরিদর্শকের দায়িত্ব পালন করব। কারণ, এটি আমাদের দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা, শিক্ষার্থীদের প্রতি দায়বদ্ধতা, আগামী দিনের নাগরিক তৈরির জন্য আমাদের কর্তব্যের জায়গা। আমরা কখনো সরকার  কিংবা ইউজিসির কাছে দাবি করিনি পরীক্ষার উপার্জন থেকে আমাদের অনেক অর্থের প্রয়োজন। কখনো বলিনি, আমাদের মাঝে সব টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারা করা হোক।

আমরা সাধারণ শিক্ষকেরা কোনোভাবেই ভর্তি ফরমের উপার্জন থেকে অর্জিত অর্থ বণ্টনের সঙ্গে জড়িত নই। আমাদেরও কথা—এই টাকা এ দেশের সাধারণ মানুষের কষ্টে অর্জিত টাকা। ভর্তি পরীক্ষার  ফির যৌক্তিকতা এবং এই খাতে অর্জিত অর্থের বণ্টন ন্যায্যতা নিয়ে তদন্ত হতেই পারে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে আয়-ব্যয়ের হিসাব চাইতে পারে।

কিন্তু কোনো রকম নিরীক্ষা বা তদন্ত ছাড়াই ঢালাওভাবে এ বিষয়ে মন্তব্য করা হবে কেন?  অথচ ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে যায়, মুহূর্তের আগুনে ছারখার হয়ে যায় কত মানুষের স্বপ্ন-ভবিষ্যৎ, সাগর-রুনির হত্যার বিচার শুধু পেছাতেই থাকে, খাদিজারা অকারণে পড়ে থাকে অন্ধকার জেলে, প্রশ্ন ওঠে না...।

আমরা অর্থের জন্য নয়, কাজ করি বাংলাদেশের জন্য। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে আমাদের শিক্ষকেরা সেই প্রমাণ রেখে চলেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবদান উজ্জ্বল ও অবিস্মরণীয়। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার দাবিতে সোচ্চার ছিলেন এই শিক্ষকেরাই, নেতৃত্ব দিয়েছেন।

আমরা অর্থের জন্য নয়, কাজ করি বাংলাদেশের জন্য। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে আমাদের শিক্ষকেরা সেই প্রমাণ রেখে চলেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবদান উজ্জ্বল ও অবিস্মরণীয়। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার দাবিতে সোচ্চার ছিলেন এই শিক্ষকেরাই, নেতৃত্ব দিয়েছেন চট্টগ্রামের সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও। চট্টগ্রাম শহরের জামালখান এলাকার প্রতিটি ইট, চেরাগী পাহাড়ের রাস্তা তার সাক্ষী।

চট্টগ্রাম শহরের ফুসফুসখ্যাত সিআরবির প্রাণ-প্রকৃতি বাঁচানোর জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। এই শহরের মশা নিধনের গবেষণা নিয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পাশে থেকে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেছেন আমাদের তরুণ শিক্ষকেরা। করোনা মহামারিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একের পর এক ল্যাব তৈরি করেছেন আমাদের শিক্ষকেরা।

কখনো তো কোথাও একরত্তি পয়সা খোঁজেননি, টাকার লোভে তো তাঁরা ছোটেননি। অর্থ, বিত্ত, চাকচিক্যময় জীবন স্বপ্নকথা, অনেক দূরের গল্প—এটা মেনে নিয়েই কিন্তু সবাই শিক্ষকতায় এসেছেন। তাই কারও সম্পর্কে উদ্ধত মন্তব্য করার আগে অবশ্যই ভাবতে হবে, আমি কাকে নিয়ে কথা বলছি, কী তার অতীত।

‘যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের—মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা...,’ আসলেই আমাদের কখনো সেই জীবন দেখা হবে না। কারণ, আমাদের আনন্দের উপলক্ষ মাসির্ডিজ গাড়ি বা বিলাসবহুল বাড়ি নয়। আমাদের ছাত্রী আফরিন যখন অক্সফোর্ডে যায় কিংবা ছাত্র জুনায়েদ যখন বিসিএস ক্যাডার হয় বা সুমিত যখন গুগলে চাকরি পায়, সেটাই আমাদের আপ্লুত করে।

দিন শেষে ভালোবাসা আর সম্মানটুকুই আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। মাননীয় সংসদ সদস্য, আপনাকে অনুরোধ, অযাচিত মন্তব্য করে এই অবস্থান থেকে আমাদের নিচে নামাবেন না। আপনাদের হাতেই দেশের সম্মান, আমাদের সম্মান।
     
লেখকবৃন্দ: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান, কলা, প্রকৌশল ও বাণিজ্য অনুষদের বিভিন্ন বিভাগের তরুণ শিক্ষক

[email protected]