অভিভাবকদের চিন্তায় যখন ‘ভালো কলেজ’

এ মুহূর্তে দেশের ১৩ লাখের বেশি পরিবার সন্তানের কলেজ-ভর্তি নিয়ে চিন্তা করছে। কোন কলেজ ভালো এবং কোন কলেজ খারাপ—এ নিয়ে অভিভাবকেরা যাঁর যাঁর মতো খোঁজখবর নিচ্ছেন। স্কুল-কলেজের শিক্ষক, পাড়া-প্রতিবেশী ও অভিজ্ঞ শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞাসা করে বোঝার চেষ্টা করছেন, কোন কলেজটি ভালো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসএসসি পাস করা খুব অল্পসংখ্যক শিক্ষার্থীই তার মনমতো কলেজে ভর্তি হতে পারবে।

 সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয়, যে কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার ফল ভালো, সেটি ভালো কলেজ। আর যে কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার ফল খারাপ, সেটি খারাপ কলেজ। কিন্তু এটি ভালো কলেজ বা খারাপ কলেজের প্রধান পরিচয় হতে পারে না। কারণ, বিগত বছরগুলোর এইচএসসির ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, যেসব কলেজ ভালো শিক্ষার্থীদের ভর্তি করেছে, সেসব কলেজের ফল ভালো হয়েছে। আর এটাই তো স্বাভাবিক, এসএসসিতে ভালো ফলধারীরা এইচএসসিতেও ভালো করবে।

আদতে ভালো কলেজের কী কী বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার? ভালো কলেজের ক্লাসরুম পড়াশোনার উপযোগী হবে—আলো-বাতাস খেলা করবে, বসার ভালো বেঞ্চ বা ডেস্ক থাকবে, লেখার মানসম্পন্ন বোর্ড থাকবে, পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের ব্যবস্থা থাকবে। ভালো কলেজে থাকবে গবেষণাগার, লাইব্রেরি, অডিটরিয়াম, খোলা মাঠ ও শিক্ষাসহায়ক অন্যান্য কার্যক্রম। এ ছাড়া দক্ষ ও দায়িত্বশীল শিক্ষক থাকবেন, যাঁদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় শিক্ষার্থীরা তাদের পড়াশোনার কাজটি সহজে চালিয়ে নিতে পারবে।

ভালো কলেজের আরও অনেক বৈশিষ্ট্যের একটি হবে ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫০ জনের মধ্যে সীমিত রাখা। একেকটি ক্লাসে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এর বেশি হলে শ্রেণি কার্যক্রম চালাতে শিক্ষকদের হিমশিম খেতে হয়। এ ছাড়া কলেজের অবস্থানও গুরুত্বপূর্ণ। যে কলেজ কোনো শিক্ষার্থীর বাড়ি থেকে দূরে, সেটিকে ওই শিক্ষার্থীর জন্য ‘ভালো কলেজ’ বলা যায় না। কারণ, এতে শিক্ষার্থীর নিজের পড়াশোনা ও প্রস্তুতির সময় কমে যায়।

তবে কলেজ যেমনই হোক, অভিভাবকেরা ভালোই জানেন, কোচিং আর প্রাইভেট ছাড়া এইচএসসিতে ভালো ফল করা যায় না। তাই একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির বেশির ভাগ শিক্ষার্থীকে কোচিং করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে কলেজের শিক্ষকেরাও কোচিং করতে বা প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করেন। এমনও শোনা যায়, কলেজের শিক্ষকের কাছে না পড়লে ভালো নম্বর দেওয়া হয় না। কোচিং-প্রাইভেট আর নোট-গাইডই যদি ভালো ফলের মাধ্যম হবে, তবে ভালো কলেজ আর খারাপ কলেজ নিয়ে এত হিসাবের কী দরকার!

কয়েক বছর ধরে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির প্রক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে অনলাইনে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়তায় ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অধীন কেন্দ্রীয়ভাবে এ ভর্তির কাজটি হয়। যদি কলেজে ভর্তির জন্য পরীক্ষা নেওয়া হতো, তাহলে শিক্ষার্থীদের দুর্গতির সীমা থাকত না।

কলেজ-ভর্তি নিয়ে দুশ্চিন্তা কমানোর একটি ভালো উদ্যোগ হতে পারে—স্কুল-কলেজ এক করে দেওয়া। অর্থাৎ যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নবম-দশম শ্রেণি আছে, সেগুলোকে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বর্ধিত করা। এ সক্ষমতা তৈরি করা খুব জটিল ব্যাপার নয়। এ ক্ষেত্রে প্রধান কাজ হবে কলেজে পাঠদানের যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ করা। এটা করা সম্ভব হলে এসএসসি পাসের পর একজন শিক্ষার্থীকে কলেজ নির্বাচন নিয়ে নতুন করে বিশেষ ভাবতে হবে না।

প্রক্রিয়াটি অনলাইন-নির্ভর হওয়ায় ঝক্কি কমেছে, অনিয়মের সুযোগ কমেছে, কিন্তু অভিভাবকদের দুশ্চিন্তা কমেনি। কিন্তু অধিকাংশ অভিভাবক পুরো প্রক্রিয়া ঠিকমতো বুঝেও উঠতে পারেননি। তাই কলেজের জন্য নিশ্চায়ন আগে করবেন, না মাইগ্রেশনের জন্য অপেক্ষা করবেন, তা বুঝে উঠতে সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজ নেন। ইউটিউব ও অন্যান্য মাধ্যমে কলেজের ভর্তিপ্রক্রিয়া নিয়ে তৈরি করা ভিডিও ও কনটেন্টগুলোর ভিউ দেখে এটা স্পষ্ট হয়। এর মানে আবেদনপ্রক্রিয়া, নিশ্চায়নপ্রক্রিয়া, মাইগ্রেশনের উপায়, ভর্তির জন্য করণীয় ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের নানা রকম জিজ্ঞাসা রয়েছে। 

অনলাইনে আবেদনের সময়ে শিক্ষা বোর্ড প্রতিটি কলেজের আসনসংখ্যা প্রকাশ করে। সেখানে প্রতিটি কলেজে ভর্তির ন্যূনতম জিপিএ দেওয়া থাকে। কিন্তু অনলাইন প্রক্রিয়ায় ভর্তির ক্ষেত্রে আসলে জিপিএ নয়, মোট নম্বর বিবেচনা করা হয়। ফলে রেজাল্ট জিপিএ-ভিত্তিক হলেও কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে আগের মতো নম্বরকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। তবু এর চেয়ে ভালো পদ্ধতি আপাতত দেখা যাচ্ছে না। প্রক্রিয়াটি প্রযুক্তিনির্ভর ও যুগোপযোগী, কিন্তু এটি সম্পন্ন করতে যথেষ্ট সময় লাগছে।

এ বছর এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে ২৮ জুলাই। আর ক্লাস শুরুর সম্ভাব্য তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে ৮ অক্টোবর। এ হিসাবে অন্তত আড়াই মাস লেগে যাচ্ছে একাদশ শ্রেণির ভর্তি কার্যক্রম শেষ করতে।

দুঃখজনক ব্যাপার, এ প্রক্রিয়ায় এ বছর একাদশ শ্রেণিতে (২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে) ভর্তির জন্য আবেদন করেও প্রথম ধাপে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (কলেজ-মাদ্রাসা) ভর্তির সুযোগ পায়নি ৪৫ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী। এরা যে খারাপ ছাত্র বা তাদের ফল খারাপ, তা নয়। বরং ফল অনুযায়ী যে কলেজে সে ভর্তির আশা করে আবেদন করেছিল, সেই কলেজে তার চেয়ে বেশি নম্বরধারী শিক্ষার্থীরা আবেদন করেছে। ‘ভালো কলেজ’ আর ‘খারাপ কলেজে’র মারপ্যাঁচে তারা যথার্থ কলেজ চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়েছে।

কলেজ-ভর্তি নিয়ে দুশ্চিন্তা কমানোর একটি ভালো উদ্যোগ হতে পারে—স্কুল-কলেজ এক করে দেওয়া। অর্থাৎ যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নবম-দশম শ্রেণি আছে, সেগুলোকে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বর্ধিত করা। এ সক্ষমতা তৈরি করা খুব জটিল ব্যাপার নয়। এ ক্ষেত্রে প্রধান কাজ হবে কলেজে পাঠদানের যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ করা। এটা করা সম্ভব হলে এসএসসি পাসের পর একজন শিক্ষার্থীকে কলেজ নির্বাচন নিয়ে নতুন করে বিশেষ ভাবতে হবে না।

পর্যালোচনা করে দেখা যায়, যত শিক্ষার্থী এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাস করে, তাদের মধ্যে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী কলেজ-মাদ্রাসায় ভর্তির জন্য আবেদন করে না। ধারণা করা যায়, এই শিক্ষার্থীরা এসএসসি পাসের পর পড়াশোনা ছেড়ে দেয় বা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। তাদের কাছে ‘ভালো কলেজ’, ‘খারাপ কলেজ’—কোনো বিবেচ্য হবে না।

তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক