ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা কারা চালান, কেন চালান

রোবরার ঢাকার মিরপুরে অটোরিকশাচালকেরা রাস্তা আটকে বিক্ষোভ করেন।ছবি : প্রথম আলো

সড়কে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বন্ধের সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে রোববার দিনভর রিকশাচালক ও পুলিশের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার পর সোমবার সরকার সেই অবস্থান থেকে আংশিক সরে এসেছে। এর আগে, রোবরার ঢাকার মিরপুরে অটোরিকশাচালকেরা রাস্তা আটকে বিক্ষোভ  করেন। তাঁদের দাবি ছিল, বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের যেন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালানোর সুযোগ দেওয়া হয়। একই দাবিতে সোমবার তারা প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেন।

ঘটনার সূত্রপাত অবশ্য ১৫ মে। রাজধানীর বনানীতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ভবনে সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা পরিষদের প্রথম সভায় সড়ক পরিবহন ও যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নির্দেশ দেন, ‘ঢাকায় কোনো ব্যাটারিচালিত রিকশা চালানো যাবে না। এটা আগে কার্যকর করুন। এ ছাড়া ২২ মহাসড়কে রিকশা ও ইজিবাইক নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সেটা বাস্তবায়ন করুন।’

এরপর বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিআরটিএ কঠোর অবস্থান নেওয়ার কথা জানায়: ব্যাটারি অথবা মোটরচালিত রিকশা বা ভ্যান বা অনুরূপ শ্রেণির থ্রি-হুইলার ঢাকা মহানগরে চলাচলের কারণে সড়কে নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ অনুযায়ী ব্যাটারি অথবা মোটরচালিত রিকশা বা ভ্যান বা অনুরূপ শ্রেণির থ্রি-হুইলার এবং ফিটনেসের অনুপযোগী, রংচটা, জরাজীর্ণ ও লক্কড়ঝক্কড় মোটরযান চালানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

এরপর সোমবার  গুলিস্তানে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে মন্ত্রী সেই অবস্থান থেকে আংশিক সরে আসার ঘোষণা দেন। তিনি জানান,স্বল্প আয়ের মানুষের কষ্টের কথা বিবেচনা করে শুধুমাত্র ঢাকা শহরে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।  

অটোরিকশা বন্ধ আবার শুধু ঢাকার ক্ষেত্রে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার পেছনে সরকারের কাছে নীতির চেয়ে রাজনৈতিক বিবেচনা হয়তো বেশি কাজ করেছে। তবে এখানে কর্মসংস্থানের মূল সমস্যাটিকেই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।  

এটা ঠিক যে, সড়ক, মহাসড়কে দ্রুতগতির যানবাহনের সঙ্গে ধীরগতির যান একসঙ্গে চললে দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। সেক্ষেত্রে অটোরিকশা, ইজিবাইকের মতো হালাকা যানের জন্য আলাদা লেন থাকা আবশ্যক।

বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা বলছে, ঢাকা শহরের সড়কে প্রায় ১৮ সংস্করণের যানবাহন চলছে। রিকশা, ঠেলাগাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি, ছোট, বড়, হালকা, ভারী, দ্রুতগতি—সব যান একসঙ্গে চলে। অন্যান্য শহর এবং আঞ্চলিক সড়ক ও মহাসড়কের চিত্রটাও এর থেকে খুব বেশি ভিন্ন নয়। এ কারণে, যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে আরও অনেকগুলো করণীয়ের সঙ্গে ধাপে ধাপে যানবাহনের সংস্করণ কমানোর পরামর্শ দিয়ে আসছেন।  

এখানে সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি  কর্মসংস্থানের। গত দেড় দশকে সরকারের প্রবৃদ্ধি আর উন্নয়নের জমাজমাটি গল্পের বিপরীতে কর্মসংস্থানের গল্পটা অনেকটাই ফিকে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি হয়নি। বরং উদ্বৃত্ত পুঁজির একটা বড় অংশ পাচার হয়ে গেছে। ফলে কর্মসংস্থানের পালে হাওয়া লাগেনি। কৃষিতেও ক্রমাগত কর্মসংস্থান কমছে। একের পর এক পাটকল, চিনিকল বন্ধ হয়েছে। ফলে গরিব মানুষেরা নিরুপায় হয়ে শহরমুখী হয়েছেন। ফুটপাতে দোকান দেওয়া থেকে শুরু করে বাদাম বিক্রি, এটা-সেটা নানা কিছু করে জীবনধারণ করার প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

বাংলাদেশের সড়কের নৈরাজ্য বলি আর অসুখ বলি আর হত্যাকাণ্ড বলি, এর মূল দায়টা অবশ্যই রাজনৈতিক। ব্যাংক, শেয়ারবাজার, বিদ্যুৎ-জ্বালানির মতো এখানেও ক্ষমতার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের একটা শক্তিশালী নেক্সাস তৈরি হয়েছে। তারা সরকারের মধ্যে থেকেই নীতিনির্ধারণীতে ভূমিকা রাখে। এটা ঠিক যে ঢাকার অটোরিকশার মালিকদের একটা অংশও রাজনৈতিক এই নেক্সাসের অংশ।

ঢাকার চালকদের আরেকটি অংশ ও সারাদেশের চালকদের অনেকে ধারদেনা করে কিংবা এনজিওর কাছ থেকে ঋণ নিয়ে কিংবা শেষ কোনো অবলম্বন বিক্রি করে এসব অটোরিকশা কেনেন। অবশ্য সড়কে সেই যান নিয়ে নামতে গেলে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে পুলিশ–প্রশাসন সবাইকেই ম্যানেজ করতে হয়।

বিআরটিএ বলছে, অটোরিকশা আইনত নিষিদ্ধ। কিন্তু অটোরিকশা যারা চালাচ্ছেন তারা তো দেখছেন, রাস্তায় অটোরিকশা চলছে। তারা তো দেখছে, বাজারে অটোরিকশা বিক্রি হচ্ছে। তারা তো দেখছে, সাধারণ রিকশার মতো অটোরিকশায় অমানুষিক শারীরিক শ্রম লাগে না।

অনেকে বলতে চান ব্যাটারিচালিত যানবাহনের কারণে বিদ্যুতের অপচয় হয়। কিন্তু পাল্টা যুক্তিও এখানে আছে, গ্রীষ্ম মৌসুমে আমাদের এখানে বিদ্যুতের চাহিদা চার থেকে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট বেড়ে যায়। এর মূল দায়টা এসির। মোট জনসংখ্যার কত শতাংশ মানুষ এসির সুবিধাভোগী? আবার জ্বালানি অপচয়ের কথা যদি বলা হয়, তাহলে এর কতটা দায়টা মোটরসাইকেল আর ব্যক্তিগত গাড়ির, সেটা কি নীতিনির্ধারকেরা স্পষ্ট করে বলবেন?

কিন্তু এখানে সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি  কর্মসংস্থানের। গত দেড় দশকে সরকারের প্রবৃদ্ধি আর উন্নয়নের জমাজমাটি গল্পের বিপরীতে কর্মসংস্থানের গল্পটা অনেকটাই ফিকে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি হয়নি। বরং উদ্বৃত্ত পুঁজির একটা বড় অংশ পাচার হয়ে গেছে। ফলে কর্মসংস্থানের পালে হাওয়া লাগেনি। কৃষিতেও ক্রমাগত কর্মসংস্থান কমছে। একের পর এক পাটকল, চিনিকল বন্ধ হয়েছে। ফলে গরিব মানুষেরা নিরুপায় হয়ে শহরমুখী হয়েছেন।

দেশে কর্মসংস্থান না থাকায় সস্তা শ্রমের শ্রমিক হতে অনেকেই মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি দিচ্ছেন। ঝুঁকিপূর্ণ পথে আবার ইউরোপে পাড়ি দিতে তাঁদের অনেকেই ভূমধ্যসাগরে ডুবে মরছেন। আর দেশে যাঁরা থাকছেন, তাঁদের মধ্যে ১৪ বছরের শিশু থেকে শুরু করে ৭০ বছর পর্যন্ত বয়সীরা বেছে নিচ্ছেন ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক, রিকশা অথবা ভ্যানের চাকা। শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত অংশের যাঁরা, তাঁদের সন্তানেরা ছুটছেন বিদেশে। যে দেশ থেকে অর্থ পাচারের সঙ্গে সঙ্গে এভাবে তরুণ জনগোষ্ঠী পাচার হতে থাকে, সেই দেশটার ভবিষ্যৎ আর কী বাকি থাকে।

গত কয়েক দশকে ব্যাটারিচালিত যানবাহন ঘিরে বিপুল বিকাশ হয়েছে। উন্নয়ন গবেষক মাহা মির্জার মতে, কোনো ধরনের সহযোগিতা ছাড়াই এই খাতে ৬০-৭০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।

২০২২ সালের ১৫ মে প্রথম আলোয় প্রকাশিত, ‘ব্যাটারিচালিত রিকশা-জটিলতা, বেকার তরুণের পথ কী’ শিরোনামের কলামে তিনি লেখেন, বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলাতেই এখন শত শত পার্টসের দোকান, ইজিবাইকের গ্যারেজ, স্টিলের ওয়ার্কশপ আর টায়ারের দোকান। এই বাহন ঘিরে আবার দেশজুড়ে গড়ে উঠেছে লাখ লাখ মেরামতের দোকান। কন্ট্রোল বক্স পুড়ে যায়, স্টিয়ারিং ছিঁড়ে যায়, বিয়ারিং ভেঙে যায়, ব্রেক ‘লুজ’ হয়ে যায়, নষ্ট পার্টস সারাতে হয়, ইঞ্জিনের তেল বদলাতে হয়। মোটরের মিস্ত্রি, পেইন্টিং মিস্ত্রি, বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি, ইঞ্জিনের মিস্ত্রি, সহকারী—সব মিলিয়ে একেকটা দোকানেই ৭ থেকে ১০ জনের কর্মসংস্থান হয়। রহিমআফরোজ, পাওয়ার প্লাস দেশেই ব্যাটারি সংযোজন করছে। উৎপাদক, সংযোজক, চালক আর মেরামত মিলিয়ে এক দশকে তৈরি হয়েছে দারুণ প্রাণবন্ত এক স্থানীয় অর্থনীতি। কোনো রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা ছাড়াই দেশজুড়ে ৬০ থেকে ৭০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান করেছে এই খাত। এটা জরুরি শিল্প না হলে কোনটা জরুরি শিল্প?

  • মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী