মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কী করলেন এবং কেন করলেন

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গ এবং ভারতের এমন একজন নেত্রী, যাঁর রাজনৈতিক কৌশল অনেক ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষ বুঝতে পারেন না। কিন্তু হয়তো পরে দেখা যায়, তাঁর দল শেষ পর্যন্ত লাভবানই হয়েছে। উইলিয়াম শেক্‌সপিয়ার বলেছিলেন যে হ্যামলেটের পাগলামির মধ্যে একটা প্রক্রিয়া রয়েছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও একটা প্রণালি ও যুক্তি রয়েছে। তিনি তাঁর কৌশলের কঠিন মূল্যায়ন করে তবেই পাগলামি করেন। এই যুক্তিতেই তাঁর গত শনিবারের (১৯ মে) মন্তব্যটিকে দেখতে হবে।

শনিবার হুগলির এক সভায় মমতা বলেন, ‘সব সাধু সমান হয় না। আমাদের মধ্যেও কি আমরা সবাই সমান? এই যে বহরমপুরের একজন মহারাজ আছেন, আমি শুনেছি অনেক দিন ধরে, কার্তিক মহারাজ। ভারত সেবাশ্রম সংঘকে আমি খুব শ্রদ্ধা করতাম…কিন্তু এই লোকটা বলেছে, “তৃণমূলের এজেন্ট বসতে দেব না।” একে আমি সাধু বলে মনে করি না। কারণ, সে ডাইরেক্ট পলিটিকস করছে, দেশটার সর্বনাশ করছে।’

এই নির্বাচন অন্তত পশ্চিমবঙ্গে কোনো সার্বিক সাম্প্রদায়িক ইস্যু ছিল না। মধ্য বাংলার একজন পরিচিত হিন্দুধর্মীয় নেতা স্বামী প্রদীপ্তানন্দ বা কার্তিক মহারাজের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মন্তব্য করে সেই ইস্যু তৈরি করে দিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। কার্তিক মহারাজ রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় না নিষ্ক্রিয়, সে প্রশ্ন এখানে অবান্তর। তিনি যদি সক্রিয় হয়েও থাকেন এবং তৃণমূলের বিরোধিতা করে থাকেন তাহলেও প্রশ্ন ওঠে, মমতা কেন নির্বাচনের মাঝামাঝি এসে একজন হিন্দুধর্মীয় নেতাকে আক্রমণ করলেন।

এর ফলে আগামী শনিবার ষষ্ঠ দফার ৮ আসনে এবং আগামী ১ জুন সপ্তম ও শেষ দফায় ৯ আসনে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে, সেটিই এখন আলোচ্য বিষয়। এটি স্পষ্ট যে গত নির্বাচনের মতো এবার পশ্চিমবঙ্গে অন্তত সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের পথে হাঁটতে পারেনি বিজেপি। এই কারণে মনে করা হচ্ছিল যে তাদের আসনসংখ্যা গতবারের ১৮ থেকে অনেকটাই কমে যাবে। কিন্তু শনিবার থেকে মমতার হিন্দুধর্মীয় নেতাকে ধারাবাহিক আক্রমণের জেরে বিরাট প্রচারণা শুরু করেছে বিজেপি।

এই প্রচারণার মূল লক্ষ্য হচ্ছে মমতা হিন্দু সমাজের শত্রু; তিনি এবং তাঁর অনুগামীরা ইসকন, ভারত সেবাশ্রম সংঘ বা রামকৃষ্ণ মিশনের মতো প্রতিষ্ঠানের বিরোধী। বস্তুত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঠিক এই শব্দগুলো ব্যবহার করেছেন মমতার শনিবারের মন্তব্যের পর।

নরেন্দ্র মোদি কোনো কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে বিজেপির গোটা নেতৃত্ব এবং তথ্যপ্রযুক্তি সেল বারবার সেই একই কথা বলতে থাকে। নেতা-নেত্রীরা বিষয়টিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যান। যেমন এ ক্ষেত্রে আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা প্রশ্ন তুলেছেন, ইমামদের সম্পর্কে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই মন্তব্য করতে পারতেন কি না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বিজেপির নেতা–কর্মীরা নেমে পড়েছেন।

নরেন্দ্র মোদি কোনো কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে বিজেপির গোটা নেতৃত্ব এবং তথ্যপ্রযুক্তি সেল বারবার সেই একই কথা বলতে থাকে। নেতা-নেত্রীরা বিষয়টিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যান। যেমন এ ক্ষেত্রে আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা প্রশ্ন তুলেছেন, ইমামদের সম্পর্কে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই মন্তব্য করতে পারতেন কি না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বিজেপির নেতা–কর্মীরা নেমে পড়েছেন। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে এবং প্রতিটি জনসভায় বিষয়টি নিয়ে কথা বলছেন বিজেপির নেতা-নেত্রীরা।

মমতা কেন শেষ তিন দফার ভোট গ্রহণ বাকি থাকতে এ মন্তব্য করলেন। এর উত্তর স্পষ্টই কারোর কাছে নেই—তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ নেতা-কর্মী থেকে সমর্থকেরাও অথই জলে। ধর্মীয় লাইনে মেরুকরণ হলে বিজেপির সুবিধা অনেক বেশি হবে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহই নেই। কারণ, পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু ভোটের সংখ্যা ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ এবং মুসলমান ভোট মোটামুটিভাবে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। ২০১৯ সালে প্রায় ৬০ শতাংশ হিন্দু ভোট একত্র হওয়ার কারণে ৪২-এর মধ্যে বিজেপি পেয়েছিল ১৮ আসন এবং তৃণমূল ২০ আসন।

আরও পড়ুন

আগামী দুই পর্বে যে ১৭ আসনে ভোট হবে, তার মধ্যে পাঁচটি আসন আগেরবার পেয়েছিল বিজেপি। ২৫ মে যে ৮ আসনে ভোট হবে, তার মধ্যেই এই ৫ আসন ছিল এবং তার পরে (১ জুন) যে ৯ আসনে ভোট হবে, তার মধ্যে একটিও বিজেপি পায়নি। তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা-কর্মীরাই মনে করছেন, শেষ পর্বে বিজেপি শেষ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি আসন পেয়ে যেতে পারে মমতার এ মন্তব্যের জেরে।

বামপন্থীদের অনেকের ব্যাখ্যা যে তাদের উত্থানের সঙ্গে এই মন্তব্যের যোগ আছে। মমতা ভয় পাচ্ছেন যে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের জোট শেষ পর্যন্ত মুসলমান ভোট তৃণমূল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে তাঁকে বিপদে ফেলবে। অতীতের নির্বাচনে দেখা গেছে, তীব্র মেরুকরণে তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি এই দুই দলের ভোট বাড়ে, আর বামফ্রন্টের কমে। এবার বামফ্রন্টের ভোট বাড়ছে বুঝতে পেরে কাজটি করলেন মমতা, যাতে অতীতের মতোই তাঁর ও বিজেপির ভোট ও আসন বাড়ে।

এই যুক্তি হয়তো বামফ্রন্টের দিক থেকে ঠিক আছে, কিন্তু মেনে নেওয়া কঠিন। এর কারণ, এর ফলে বিজেপির আসন যদি হঠাৎ শেষ পর্যায়ে ১৭-এর মধ্যে ৫ (২০১৯) থেকে বেড়ে ১৪ থেকে ১৫ হয়ে যায়, তাহলে বিরাট বিপদে পড়বেন মমতা। অপর ব্যাখ্যা হচ্ছে, চিরাচরিত ‘সেটিং থিওরি’, অর্থাৎ মমতা ও মোদির মধ্যে সমঝোতা রয়েছে। লোকসভা নির্বাচনে বিজেপিকে বাড়তি ১০ থেকে ১৫টি আসন ছেড়ে দেবেন মমতা এবং পরিবর্তে পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলকে জেতানোর বন্দোবস্ত করবেন মোদি। ২০১৯-এর লোকসভা ও ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচন দেখে অনেকেই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে তাঁদের মধ্যে সমঝোতা রয়েছে।

কিন্তু এই বিশ্লেষণের ঝুঁকি হলো ২৫ থেকে ৩০ আসন পশ্চিমবঙ্গে পেয়ে কেন্দ্রে ক্ষমতা দখলের পরে বিজেপি যে তৃণমূল কংগ্রেসকে ফেলে দেবে না বা অন্য রাজ্যের মতো এ রাজ্যেও সপরিবার মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেপ্তার করবে না, তার গ্যারান্টি কোথায়? অতীতে বিজেপি প্রথমে বিপদে ফেলেছে তাদের বন্ধুদের, যেমন মহারাষ্ট্র শিবসেনা বা কাশ্মীরে পিডিপি এবং পরে শত্রুদের। মমতা এমন মন্তব্য করে কী ফল ঘরে তুলবেন বা আদৌ তুলতে পারবেন কি না, তা বোঝা যাবে দুই দফা নির্বাচনের ফলাফলের পরে।

● শুভজিৎ বাগচী প্রথম আলোর কলকাতা সংবাদদাতা