এটাই হোক ধারাবাহিক পেঁয়াজ নাটকের শেষ পর্ব

পৌরাণিক কাহিনি আর ইতিহাস-ঐতিহ্য ছাপিয়ে বঙ্গদেশে পেঁয়াজ নতুন এক নতুন সেনসেশন এবং জটিল ইস্যুর নাম। পেঁয়াজ উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য সফলতা সত্ত্বেও পেঁয়াজবিলাসী ভোক্তা আর মুনাফালোভী ব্যবসায়ী মিলে বাঙালির পেঁয়াজ নিরাপত্তাকে করে তুলেছে নাট্যময়, অনিশ্চিত ও ঝুঁকিপূর্ণ।

এই মসলা ফসলটি বাংলাদেশের জাতীয় বাণিজ্য, বাজারব্যবস্থা এমনকি জাতীয় রাজনীতি ও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ঝড় তোলার ক্ষমতা রাখে। মাছ-মাংস, দুধ-ডিম, তেল-ডালের সংকট মেনে নিলেও পেঁয়াজের কোনো সংকট মানতে নারাজ পেঁয়াজবিলাসী বাঙালি। পেঁয়াজপাগল বাঙালির সস্তা মূল্যে নিরবচ্ছিন্ন পেঁয়াজের সরবরাহ চাই সারা বছর। চালের বাজার নিয়ে সরকারকে যতটা তটস্থ থাকতে হয়, পেঁয়াজ নিয়ে তার চেয়ে বেশি তটস্থ থাকতে হয়।

১৯৮০ সালে ইন্দিরা গান্ধীর নির্বাচনে জেতার পেছনে নাকি আগের বছর পেঁয়াজের সংকট ও অস্বাভাবিক দামও কাজ করেছিল। জাতীয় উৎপাদন যত বেশিই হোক না কেন, পেঁয়াজ নিরাপত্তা নিয়ে কোনো ঝুঁকি নেওয়া হয়তো ঝুঁকিপূর্ণ। তাই সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রথম সারির পেঁয়াজ উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে গৌরবান্বিত হওয়ার পরও প্রধান আমদানিকারক দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।

গত কয়েক বছর প্রধান পেঁয়াজ উৎপাদনকারী দেশ ভারতের রপ্তানি করা পেঁয়াজের সিংহভাগই (প্রতিবছর ৭-১২ লাখ টন) এসেছে বাঙালির পেঁয়াজ বিলাসিতায়। পেঁয়াজ দুনিয়ায় মোট ১০-১২ মিলিয়ন মেট্রিক টন পেঁয়াজ কেনাবেচা হয় আন্তর্জাতিকভাবে, যার প্রায় ১০ শতাংশ শেয়ার তৃতীয় বৃহত্তর পেঁয়াজ উৎপাদনকারী দেশ বাংলাদেশের, যা আমদানিনির্ভর অন্যান্য দেশের জন্য কিছুটা অস্বস্তিকর।

পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ করলে কী কী সুফল আসবে দেশে? হ্যাঁ, দেশে উৎপাদন বাড়বে, পেঁয়াজের বিলাসী ব্যবহার কমবে, দেশীয় ফার্মিং এন্টারপ্রাইজ ও ভ্যালু-চেইন শক্তিশালী হবে, আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থির ওঠানামা আমাদের দেশীয় বাজারকে প্রভাবিত করতে পারবে না। পেঁয়াজের  বাজারমূল্য স্থিতাবস্থায় এলে পেঁয়াজ গবেষণা, সম্প্রসারণ ও সংরক্ষণের বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বাড়বে।

১৯৯১ সালে ১০ কোটি মানুষের জন্য পেঁয়াজের সরবরাহ ছিল প্রায় ৪ দশমিক ৫ লাখ টন। মাথাপিছু প্রাপ্যতা প্রায় চার কেজি। পরে আর্থিক সমৃদ্ধি ও খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালির পেঁয়াজ খাওয়ার পরিমাণ বাড়তে থাকে। গত অর্থবছরে আমরা উৎপাদন ও আমদানি মিলিয়ে মোট ৩৬ লাখ টন পেঁয়াজ খেয়ে ফেলেছি।
বাংলাদেশে প্রায় প্রতিবছরই পেঁয়াজ নিয়ে গণমাধ্যম গরম হয়ে ওঠে। ভারত উপমহাদেশে পেঁয়াজ মসলা হিসেবে ব্যবহৃত হলেও পেঁয়াজ মূলত ব্যবহৃত হয় সবজি ও কাচা সালাদ হিসেবে। আট বিলিয়ন জনসংখ্যার পৃথিবীতে ৯০-৯৫ মিলিয়ন টন পেঁয়াজ উৎপন্ন হয়। ২০ শতাংশ সংগ্রহ-উত্তর ক্ষতি বাদ দিলে ব্যবহারের জন্য থাকে ৭৫ মিলিয়ন টন। সেই হিসাবে মাথাপিছু পেঁয়াজ খাওয়ার পরিমাণ প্রায় ১০ কেজি।

গত বছর বাংলাদেশে উৎপাদন, সংগ্রহ-উত্তর নষ্ট ও আমদানি হিসাব করে প্রায় ৩৬ লাখ টন নিট পেঁয়াজ সহজলভ্য ছিল। সেই হিসাবে মাথাপিছু প্রাপ্যতা ছিল প্রায় ২২ কেজি, যা উপমহাদেশে সর্বোচ্চ। বিশ্বে মোট উৎপাদিত পেঁয়াজের ৩০ শতাংশ আসে এই উপমহাদেশর কয়েকটি দেশ (ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা) থেকে। শুধু বাংলাদেশ ও ভারতের বৈশ্বিক জোগান প্রায় ২৮ শতাংশ। আবার ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা মিলে বৈশ্বিক মোট উৎপাদিত পেঁয়াজের ৩৭ শতাংশ ভক্ষণ করে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কত মেট্রিক টন পেঁয়াজ সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারলে বাংলাদেশকে ‘পেঁয়াজ স্বাবলম্বী’ দেশ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া যায়? চার সদস্যের পরিবারে প্রতি মাসে ৫-৬ কেজি পেঁয়াজ কি যথেষ্ট নয়? নানা শ্রেণি-পেশার পরিবারের ওপর জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, ৮০ শতাংশ পরিবারের পেঁয়াজ ভক্ষণের পরিমাণ ৪-৬ কেজি, যা একটি পরিবারে মাসিক খাদ্য বাবদ মোট খরচের মাত্র ১-২ শতাংশ (২০০-৩০০ টাকা)।

পাঁচ সদস্যের পরিবারে যদি প্রতি মাসে গড়ে সাড়ে সাত কেজি পেঁয়াজ সরবরাহও নিশ্চিত করা হয়, তাহলে পেঁয়াজের জাতীয় চাহিদা দাঁড়ায় ২৪ লাখ মেট্রিক টন। সংগ্রহ-উত্তর ক্ষতি বাদে যেখানে আমাদের উৎপাদন প্রায় ২৯ লাখ মেট্রিক টন। সেই হিসাবে বাংলাদেশ পেঁয়াজ উদ্বৃত্ত দেশ। তা ছাড়া পেঁয়াজের উল্লেখযোগ্য কোনো ইন্ডাস্ট্রিয়াল ব্যবহার নেই। তাই বাঙালির পেঁয়াজ বিলাসিতার জন্য পেঁয়াজ আমদানির যেমন যৌক্তিকতা নেই, তেমনি যৌক্তিকতা নেই আর কোনো নতুন ফসলি জমি পেঁয়াজ চাষের আওতায় আনার সম্প্রসারণ প্রচেষ্টা।

গত ১০ বছর পেঁয়াজ আবাদের আওতায় জমির পরিমাণ বেড়েছে ৪১ শতাংশ (২০১১-১২ সালে ১ লাখ ৮০ হাজার হেক্টর, ২০২১-২২ সালে ২ লাখ ৫৩ হাজার হেক্টর)। জমি-সংকটের বাংলাদেশে এটা কোনো সফলতার গল্প নয়। ফলন বাড়িয়ে মোট উৎপাদন বাড়াতে পারলে সেটা সফলতা। প্রধান পেঁয়াজ উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশের ফলন (১০ টন/হেক্টর) এখনো সবচেয়ে কম। আমাদের ফলন চীন (২২ টন/হেক্টর), যুক্তরাষ্ট্র (৬০ টন/হেক্টর) অথবা মিসরের (৩৫ টন/হেক্টর) মতো না হোক, ভারতের ফলনের (১৯ টন/হেক্টর) কাছাকাছি তো থাকা উচিত।

ক্রমহ্রাসমান ফসলি জমিতে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ফসল যোগ হচ্ছে। ক্রপিং সিস্টেমে ড্রাগন ফল, মাল্টা, ভুট্টা, ফুল চাষ, সবজি চাষ জমির জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। গো খাদ্যের অব্যাহত চাহিদা মেটাতে ভুট্টা, সবুজ ঘাস ফসল (নেপিয়ার, পারা, জাম্বো), খেসারির চাষ বেড়েই চলেছে। ধান চাষের আওতায় জমির পরিমাণ কমানোর কোনো সুযোগ নেই। কৃষিজমি কমে যাওয়াসহ প্রচণ্ড আন্তফসল প্রতিযোগিতার মধ্যে যদি পেঁয়াজ বিলাসের জন্য অতিরিক্ত জমি লাগে, তা সার্বিক খাদ্য নিরাপত্তার জন্য মোটেই সুখকর নয়।

‘বাংলাদেশ এখন পেঁয়াজ উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয়’—   এই সাফল্য আমরা উদ্‌যাপন করেছি গত এপ্রিল মাসে । এর মাত্র চার মাস পর পেঁয়াজ আমদানির জন্য ভারত বাদেও বিশ্বের ৯টি দেশে আমাদের হাজির হতে হয়েছে। চীন (২ হাজার ৪০০ টন), মিসর (৩ হাজার ৯১০ টন), পাকিস্তান (১১ হাজার ৮২০ টন), কাতার (১ হাজার ১০০ টন), তুরস্ক (২ হাজার ১১০ টন), মিয়ানমার (২০০ টন), থাইল্যান্ড (৩৩ টন), নেদারল্যান্ডস (৪ টন), সংযুক্ত আরব আমিরাত (৩ টন) থেকে মোট ২১ হাজার ৫৮০ টন পেঁয়াজ আমদানির সিদ্ধান্ত হয়েছে পেঁয়াজবিলাসী জাতির মাথা ঠান্ডা রাখতে।

পেঁয়াজ আমদানির জন্য প্রায় সারা দুনিয়াতেই (যাদের পেঁয়াজ কিছুটা উৎপাদন হয়) হাজির হয়েছি আমরা। প্রিয় পেঁয়াজবিলাসী ভাই আপনি কি জানেন, একটি ছোট্ট পণ্য আমদানির জন্য ৯টি দেশে এলসি খুললে বাণিজ্য অর্থনীতির কী হয়, ট্রেড ব্যালেন্সের অবস্থা কেমন থাকে। ডলার-সংকটের এই পাথর সময়ে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে পেঁয়াজ আনতে হবে বাঙালির ‘হট অ্যান্ড স্পাইসি’ খাবার রান্না করতে।

মজার বিষয়, এ বছর গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়েছে ৪০ হাজার মেট্রিক টন। ডিসেম্বর নাগাদ প্রায় ৩-৪ লাখ  মেট্রিক টন মুড়িকাটা পেঁয়াজ (বাল্ব টু বাল্ব) বাজারে আসবে। পরের মার্চ মাসে গিয়ে আবার ৩৫ লাখ টন পেঁয়াজ বাজারে আসবে। ভোক্তার সামান্য ভক্ষণ সমন্বয় ও দায়িত্বশীল ভোক্তা আচরণ ৪০০ মিলিয়ন ডলারের আমদানি বাণিজ্য থেকে বাঁচাতে পারত।

আগামীর বাস্তবতায় পেঁয়াজবিলাসী জাতির জন্য পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন খুব জরুরি। বৈশ্বিক পেঁয়াজের বাজার নানা রকম সংকটে পড়তে যাচ্ছে। প্রধান উৎপাদনকারী দেশ ভারত, চীন ও বাংলাদেশে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে। চাইলেই সস্তায় পেঁয়াজ আমদানি করা না-ও যেতে পারে।

আমাদের মোট ছয় শতাধিক খাদ্য ও খাদ্যজাতীয় পণ্য আমদানি করতে হয় বিদেশ থেকে, যার জন্য ব্যয় করতে হয় ১০ বিলিয়ন ডলার। আমরা চাইলেই গম, ভুট্টা, তেল, ডাল, দুধ, তুলা আমদানি, বন্ধ করতে পারব না। কিন্তু অবিশ্বাস্য উৎপাদন সফলতার পরও অন্তত চাল আর পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ করতে পারব না কেন? আসুন আমরা পেঁয়াজবিলাসী না হয়ে পেঁয়াজ উৎপাদন ও ব্যবহারে সুবিবেচক হই।

রেকর্ড পরিমাণ ধান উৎপাদনের পরও গত তিন বছর চাল আমদানি করা হয়েছিল ভারত থেকে। চালের বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণে অতি সতর্কতা এই আমদানিকে যৌক্তিক করেছিল। কিন্তু এবার সরকার আমন কাটার বেশ আগেই বলে দিয়েছে বাংলাদেশ চাল আমদানি করবে না। ধানচাষি, মিলমালিক আর ভোক্তা মিলে যৌক্তিক দাম নির্ধারণ করবে। সরকার প্রয়োগ করবে নানা রকম নীতিকৌশল। এটা সরকারের সাহসী ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত।

এখন সাহস করে সরকারকে অনেক আগে থেকেই ঘোষণা দিতে হবে যে পেঁয়াজ আমদানি করা হবে না। শুধু এমন একটি ঘোষণাতেই পেঁয়াজপ্রিয় বাঙালির পেঁয়াজ খাওয়া অন্তত ১০ শতাংশ কমে যাবে। পেঁয়াজ কোনো অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যসামগ্রী নয় চাল, ডাল, তেল, মাছ, মাংস, সবজির মতো। পেঁয়াজের আমদানি বন্ধ করে দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজ দিয়ে চাহিদা মেটানোর সময় এসেছে বাংলাদেশের। কৃষিবান্ধব সরকার, সাহসী কৃষক, কৃষিবিজ্ঞানী ও সম্প্রসারণবিদদের যৌথ প্রচেষ্টায় এই সফলতা।

পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ করলে কী কী সুফল আসবে দেশে? হ্যাঁ, দেশে উৎপাদন বাড়বে, পেঁয়াজের বিলাসী ব্যবহার কমবে, দেশীয় ফার্মিং এন্টারপ্রাইজ ও ভ্যালু-চেইন শক্তিশালী হবে, আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থির ওঠানামা আমাদের দেশীয় বাজারকে প্রভাবিত করতে পারবে না। পেঁয়াজের  বাজারমূল্য স্থিতাবস্থায় এলে পেঁয়াজ গবেষণা, সম্প্রসারণ ও সংরক্ষণের বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বাড়বে।

রপ্তানি বন্ধ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলে পেঁয়াজের গড় ফলন বাড়বে। জমির পরিমাণ না বাড়িয়েও উৎপাদন বাড়ানো যাবে। বাংলা ব্র্যান্ডের প্রিমিয়াম মানের পেঁয়াজ রপ্তানি হবে ইউরোপের বাজারে। এক লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ সংরক্ষণ করার মতো কোল্ডস্টোরেজ করতে পারলে সেটা দিয়ে বাজার বাফারিং করা যাবে।

কাজেই ২০৩০ সাল নাগাদ অন্তত পাঁচ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ রপ্তানির লক্ষ্য নিয়ে ‘অনিয়ন ভিশন-২০৩০’ প্রণয়ন করার সময় এখনই। সবার দায়িত্বশীল প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ হোক একটি পেঁয়াজ স্বাবলম্বী দেশ, পেঁয়াজ উদ্বৃত্ত দেশ, পেঁয়াজ রপ্তানিকারক দেশ। আর ২০২৩ সালের পর্বটিই হোক ধারাবাহিক পেঁয়াজ নাটকের শেষ পর্ব।

  • ড. মো. রওশন জামাল প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী
    [email protected]