সকালে ঘুম থেকে উঠে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঢোকা এখন আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে। যথারীতি সেটি করতে গিয়ে জানতে পারলাম, আজকে ডিম দিবস। অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, ভোরে এসে দুপুরের জন্য গৃহকর্মী কী রান্না করে গেল, সেটি দেখতে রান্নাঘরে গিয়ে দেখলাম—কড়াইতে হাস্যোজ্জ্বল ডিম। একটি সার্থক ডিম দিবসই বটে! কিন্তু মনের খায়েশ নিয়ে সেই ডিম কি খাওয়ার উপায় আছে? ডিম খেতে গিয়ে মাথায় বাড়ি দেয় এর দাম।
ডিম দিবস আসলেই মনে পড়ে যায় ২০১৭ সালের অক্টোবরের এক ‘ঐতিহাসিক ডিম যুদ্ধের’ কথা। সেবার ডিম দিবসে রাজধানীর খামারবাড়ির কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনের প্রাঙ্গণে তিন টাকায় ডিম বিক্রির আয়োজন করা হয়। ডিম কিনতে ভোর ছয়টা থেকে মানুষের লাইন লেগে গেল। হাজারো মানুষের ধাক্কাধাক্কিতে ভেঙে পড়ে অস্থায়ী মঞ্চ। ডিমও ভেঙে গড়াগড়ি খেল রাস্তায়। পণ্ড হয় আয়োজন। তখন খুচরা বাজারে ডিমের দাম ছিল সাড়ে সাত থেকে আট টাকা। কিন্তু তিন টাকায় ডিম কিনতে এভাবে মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়বে সেটি ছিল কল্পনাতীত। চিন্তা করছি, এখন যদি এমন একটি ডিম বিক্রির আয়োজন করা হয় কী অবস্থা হবে।
মেসে, হোস্টেল, ব্যাচেলর বাসার বাসিন্দাদের ডিম ছাড়া চলেই না—এ কথা অনস্বীকার্য। নিম্ন বা মধ্যবিত্তের জন্য ডিম তো আরও বেশি অপরিহার্য। মাছ–মাংসের বাইরে এই একটিই বস্তু আছে, যা একই সঙ্গে উপাদেয়, পুষ্টি পূরণ করে আবার সবচেয়ে সহজলভ্যও। তবে সেই ডিম কিনতেও এখন চিন্তা করতে হয় আমাদের। কয়দিন আগে বিবিসি বাংলার এক ভিডিও প্রতিবেদনে দেখলাম, মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন গৃহিণী বলছিলেন, আগে তাঁর বাচ্চাকে প্রতিদিন একটি ডিম খেতে দিলেও এখন সেটি পারছেন না। বরং একটি ডিমকে তাঁকে এখন ভাগ করতে হচ্ছে। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে, নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোর কী অবস্থা!
অফিসে আসার পথে বাসার গলির মুদি দোকানদারের কাছে জানতে চাইলাম, ডিমের দাম কত? তিনি বললেন, হালি ৪৮ টাকা। ডজন ১৪৪ টাকা। ডিমের বাড়তি দাম নিয়ে কথা তুললে তিনি বললেন, ‘সব সিন্ডিকেট। ডিমের উৎপাদন কমে গেছে এটা সত্য। এরপরেও সিন্ডিকেটের কারণে এমন দাম। ট্রাকভর্তি ডিম, তেরপল দিয়ে ঢেকে রেখে বলে ডিম নাই।’ কারওয়ানবাজার এসে ডিমের বাজারে ঢুকে এক বিক্রেতাকে জিজ্ঞাসা করে দেখলাম, এখানে ডজন ১৪০ টাকা। কারওয়ানবাজার বলে কথা, পাড়ার দোকানের সঙ্গে পার্থক্য থাকবেই। তবে চার্টে হাঁসের ডিমের ডজন লেখা আছে, ১৯০ টাকা। মানে একটি ডিম প্রায় ১৬ টাকা। কারওয়ানবাজারের ডিমবিক্রেতাকেও জিজ্ঞাসা করলাম ডিমের দামের প্রসঙ্গে। তিনি বললেন, ডিমের উৎপাদন নেই। মুরগির খাবারের দাম বেড়ে গেছে। লোডশেডিংয়ের কারণে অনেক মুরগি মারা যাচ্ছে। খামার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, দুই দোকানদারের কথাতেই সত্যতা আছে। গত আগস্টে এক মধ্যরাতে সরকার জ্বালানি তেলের দাম একলাফে ৪২-৫২ শতাংশ বাড়িয়ে দিল। পরদিন থেকে একের পর এক পণ্যের দাম হু হু করে বাড়তে থাকল। রকেট গতিতে ছুটতে থাকে ডিমের দামও। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের খুচরা বাজারে প্রতিটি ডিমের দাম ১৫ টাকা পর্যন্ত উঠে যায়। গোটা দেশে হইচই পড়ে গেল। দাম বৃদ্ধির কারণ দেখানো হলো, সরবরাহ কমে গেছে। তখন ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণে মাঠপর্যায়ে অভিযানে নামে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এরপর যে গতিতে উঠেছিল, সেই গতিতেই নেমে যায় ডিমের দাম।
তখন প্রশ্ন ওঠে ডিমের দাম বাড়াল কারা? পোলট্রি খরচ বেড়ে গেছে এটি সত্য। অনেক খামার বন্ধ হয়ে যাওয়ার খবরও আমরা পাই। কিন্তু ডিমের বাড়তি দাম খামারিরা পাননি বলে দাবি তাঁদের। করোনাকাল থেকেই তাঁরা লোকসান দিয়ে যাচ্ছেন। আর এভাবে দাম বাড়িয়ে বাড়তি মুনাফারও সুযোগ নেই তাঁদের। ডিমের দামের হিসাব দিয়ে পোলট্রিশিল্পের কেন্দ্রীয় সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) দাবি করে, মধ্যস্বত্বভোগীরা এখানে বড় অঙ্কের মুনাফা করে নিয়েছে। করপোরেট কোম্পানি ও আড়তদারদের প্রতিও আঙ্গুল ওঠে। অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) দাবি, ব্যবসায়ীরা সব সময় লোকসানের ফিরিস্তি দেয়। কিন্তু ব্যবসার মুনাফা দিয়েই তাঁরা ছোট থেকে বড় হয়েছেন।
কথা হচ্ছে, এখনও ডিমের দাম বাড়তি। করোনাকালে মানে গত বছরও একটি ডিম যেখানে সাড়ে আট–নয় টাকা করে কিনে খাওয়া গেছে। সেটি এখন বারো টাকা। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষ ডিম খাওয়া কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। মূল্যস্ফীতির এই দিনে সেটি না করে উপায় নেই।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা তথ্য অনুযায়ী, ন্যূনতম পুষ্টির চাহিদা পূরণে একজন মানুষকে বছরে গড়ে ১০৪টি ডিম খাওয়া দরকার। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে মাথাপিছু ডিম খাওয়ার সংখ্যা ছিল ১৩৬। দেখা যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক স্বীকৃত ন্যূনতম চাহিদার চেয়েও আমাদের ডিম খাওয়ার পরিমাণ বেশি। চলতি অর্থবছরে এই পরিসংখ্যান কমবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মানুষ যেভাবে ডিম কেনা কমিয়ে দিয়েছে, ন্যূনতম চাহিদা পূরণে ডিম খাওয়ার আন্তর্জাতিক আদর্শমান ধরে রাখাটাই কঠিন ব্যাপার হবে। আশঙ্কা হচ্ছে, এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে অন্তঃসত্ত্বা মা ও শিশুর ওপর। কারণ, তাদের প্রয়োজনীয় পুষ্টির চাহিদা পূরণে বড় ভূমিকা পালন করে থাকে ডিম।
এ দেশে কোনো জিনিসের দাম একবার বাড়লে সেটি আগের দামে আর ফেরত আসে না। এটিই এখানকার ব্যবসা-বাণিজ্যের ‘সায়েন্স’। দাম কমা বলতে এখানে বোঝায়—কোনো পণ্যের দাম দশ টাকা বেড়ে গেল, এরপর সরকারি নানা পদক্ষেপের পর পাঁচ টাকা কমল। এতেই সবাই খুশি। ডিমের দামের ক্ষেত্রেও তা আমরা দেখতে পাচ্ছি। দাম বাড়ার পর কয়েক টাকা কমার পর আমরা ভুলেই গেছি, গত জুলাইয়েও ডিমের দাম ছিল ১০০ থেকে ১১০ টাকার মধ্যে।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর এক হোটেলে এক সেমিনারে কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেছিলেন, ‘ডিমের দাম বেড়েছে, তবে এটি সাময়িক। এবং শিগগিরই দাম কমে আসবে।’ সেসময় বড় বাজারে পোলট্রি মুরগির বাদামি ডিমের দাম ছিল প্রতি হালি ৪৫ টাকা। আর পাড়া-মহল্লার মুদিদোকানে হালি ৫০ টাকা। আজকের দামের ধারনা তো শুরুতেই দিলাম, তারমানে ঘুরেফিরে প্রতি ডিম ১১-১২ টাকা।
এরপর ২৯ সেপ্টেম্বর গাজীপুরে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে (বারি) এক কর্মশালায় গিয়ে সাংবাদিকদের মন্ত্রী মহোদয় বলেন, ‘একটা ডিমের উৎপাদন খরচ ৫ থেকে ৬ টাকা। সেই ডিম সর্বোচ্চ ৮ টাকা বিক্রি হতে পারে। কিন্তু তা না করে সেই ডিম বিক্রি হচ্ছে ১২ থেকে ১৩ টাকা। এটা কেন? এটা কি আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না? এ ব্যাপারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়সহ আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।’
মনে হলো, ডিমের এমন দামে মন্ত্রী অবাক হয়েছেন। তবে তাঁর এমন অবাক হওয়াতেই বরং আমরা অবাক হই। মন্ত্রী মহোদয়ের বক্তব্য থেকে আমরা বুঝলাম, খামারিদের হাত ভোক্তাদের হাত পর্যন্ত পৌঁছাতে একটি ডিমের দাম হয়ে যাচ্ছে উৎপাদন খরচের চেয়েও দ্বিগুণের বেশি। তার মানে মধ্যস্বত্বভোগীদের মুনাফার বিষয়টিই এখানে সত্য। সেটি শুধু এখনের জন্য না, আগ থেকেই তা হয়ে আসছে।
‘সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন’—সেটি তো জানা কথাই। কিন্তু সেই উদ্যোগ যে নেওয়া হয়নি, তা বর্তমান বাজারে ডিমের দাম দেখেই বোঝা যায়। যেকোনো খাতেই মধ্যস্বত্বভোগী সিন্ডিকেটের কথা পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে সবাই বলেন, কিন্তু কাজের বেলায় সবাই ঠুঁটো জগন্নাথ। সিন্ডিকেট ভাঙার সামর্থ্যও তাঁরা আসলে রাখেন না। সিন্ডিকেটের সুবিধাভোগী কারা, সেটিও ব্যাখ্য করে বলার প্রয়োজন হয় না এ দেশের মানুষকে। যাক, তাও অন্তত তাঁর কথায় ডিমের বাজার নিয়ে মধ্যস্বত্বভোগীদের বিষয়টি বেরিয়ে এসেছে, সেখানে ডিমের দাম নিয়ে বেদনাও প্রকাশ হতে দেখি আমরা। এ জন্য মন্ত্রী মহোদয়কে ডিম দিবসের শুভেচ্ছা জানানো যেতেই পারে।
রাফসান গালিব প্রথম আলোর সহসম্পাদক