নতুন শিক্ষাক্রম, একক ভর্তি পরীক্ষা এবং শিক্ষায় আর যে সব চ্যালেঞ্জ

নতুন বছর শুরু হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন দেখল দেশ। যদিও কারা ক্ষমতায় আসছে তা এক প্রকার অনুমেয়ই ছিল। ক্ষমতাসীন সরকারই আবারও পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায়। তবে নতুন করে সরকার গঠন হবে, হবে নতুন দায়িত্ব বণ্ঠন।

এখন নতুন বছরে শিক্ষা নিয়ে নানা চ্যালেঞ্জ আমরা দেখতে পাচ্ছি। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার দায়িত্ব নিতে হবে নতুন সরকারকেই।

চব্বিশে ‘শিক্ষা’ নিয়ে চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে বিশদ আলোচনা-সমালোচনা করা দরকার।

নতুন শিক্ষাক্রম


গত বছরজুড়েই নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে আলোচনা ছিল। গত বছর  প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম শুরুর পর এই নিয়ে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশাজীবীদের আলোচনার অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। চব্বিশে পূর্বনির্ধারিত দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণির শিক্ষাক্রমে আমূল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া বছরটি তাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।

পত্রপত্রিকা থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মাঝে ‘তুষের আগুন’ রূপ নেওয়া নতুন শিক্ষাক্রমের ‘গতিপথ’ নিয়ে গত বছরের সমালোচনায় এই শিক্ষার রূপরেখা কণ্টকাকীর্ণ হয়ে উঠলেও নতুন বছর সরকার এটি কীভাবে সামলাবে, তা নিয়ে কিছুটা হলেও ‘অন্ধকার’ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।

স্বাধীনতার পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে এই দেশে ব্রিটিশ শিক্ষার কাঠামোতে চলা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় নবম শ্রেণিতে বিশেষায়িত শিক্ষার জন্য বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসা শাখায় পড়াশোনার সুযোগ থাকলেও চলতি বছর নবম শ্রেণিতে বিভাগ বিভাজন উঠে যাওয়ায় সবার জন্য বিজ্ঞান শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা আগামী শিক্ষার জন্য যুগান্তকারী পদক্ষেপ হলেও ‘সামষ্টিক বিজ্ঞান’ শিক্ষার পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু নিয়ে সবার নজর থাকবে বৈকি।

গত বছরের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তক নিয়ে কুম্ভিলকবৃত্তি, ভুলভাল আধেয়  (কনটেন্ট), বানানের বই সর্বস্তরের মানুষের মনে ক্ষোভ তৈরি করেছিল, সেই ধারা এবারও নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠ্যপুস্তকে থাকছে কি না, তা নিয়ে আলোচনা থাকবে সেটা নিশ্চিত করে বলা যায়। সংযোজন, পরিমার্জনের অজুহাতে নির্ভুল পাঠ্যপুস্তকের অনীহা দীর্ঘদিনের হলেও এবার জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড গত বছরের চেয়ে কতটা শিক্ষা নিয়ে এগোল তা সময় বলে দেবে।

গণমাধ্যমে খবর বের হয়েছে যে নতুন শিক্ষাক্রমের আওতাধীন কয়েকটি শ্রেণির জন্য পাঠ্যপুস্তক বছরের শুরুতে পাচ্ছে না। এরপরও নতুন শিক্ষাক্রমের শিখন, পঠন ও মূল্যায়ন নিয়ে ‘শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মনের শঙ্কা কতটা কাটবে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। মূলত শিক্ষার এই আমূল পরিবর্তন নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘প্রস্তুতির ঘাটতি’ যখন সুস্পষ্ট, তখন এর সঠিক বাস্তবায়ন নিয়ে সরকারকে অনেকটাই বেগ পেতে হবে।

নতুন শিক্ষাক্রমের ভুলভ্রান্তি নিয়ে আমরা বিস্তর আলোচনা করেছি, গণমাধ্যমগুলোও খবর প্রকাশ করে যাচ্ছে, তবে সরকার যদি সেইগুলো আমলে না নেয়, নিজেদের ভুলভ্রান্তি সংশোধনের সুযোগ না নেয়, তাহলে এমন শিক্ষাক্রমের সাফল্য কতটা পাওয়া যাবে, তা বলা সত্যিই মুশকিল।

হ্যাঁ, এই কথা সত্য, আমাদের একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনায় একমুখী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা দীর্ঘদিন থেকে ছিল। সেই খোরাক নতুন শিক্ষাক্রমে ফিরলেও শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার জন্য যোগ্য জনবল ও প্রয়োজনীয় আনুষঙ্গিক ব্যবস্থাপনার অভাব চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। তাই এই সংকট মোকাবিলায় সরকার কতটা সদয় হচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করছে নতুন শিক্ষাক্রমের ভাগ্য। তাই এই বছরটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে নতুন শিক্ষাক্রম।

শিক্ষকদের মানোন্নয়ন

প্রতিবছরই শিক্ষকদের আন্দোলন করতে দেখা যায়। কখনো প্রাথমিক, কখনো মাধ্যমিক আবার উচ্চমাধ্যমিকের সরকারি কিংবা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে। শিক্ষার মানোন্নয়নের সঙ্গে যেসব মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন জরুরি তা হলো শিক্ষক। অথচ আমরা বিভিন্ন সময়ে রাজপথে এই দেশে শিক্ষকদের নামতে দেখি বেতন বৃদ্ধির জন্য, শিক্ষা জাতীয়করণের (সরকারীকরণ) জন্য, সম-অধিকার কিংবা মর্যাদার দাবির জন্য।

শিক্ষকদের মান বাড়াতে তাঁদের সঠিক নিয়োগ ব্যবস্থাপনা যেমন জরুরি তেমনি, মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করতে লোভনীয় বেতন কাঠামো ও সুযোগ-সুবিধা প্রদান জরুরি। শিক্ষকদের টিউশনি কিংবা কোচিং ব্যবসায় জড়িত না আহ্বান জানিয়ে সরকার যে দায়িত্ব পালন করতে যায়, সেটি তাঁদের বেতন কাঠামোর পরিবর্তনেই সম্ভবপর হয়ে ওঠে। আমাদের শিক্ষকেরা কতটা অভাগা যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারীকরণের জন্য আন্দোলন করতে হয়।

অথচ এই সব শিক্ষকদের কাঁধে উঠে একই সিলেবাস ও শিক্ষা কাঠামোর দায়িত্ব। শিক্ষকদের মৌলিক চাহিদার একসূত্রকরণ করতে না পারলে শিক্ষার যতই ভালো পরিবর্তন করার উদ্যোগ নেওয়া হোক না কেন, তা অসাড় হয়ে যাবে। তাই শিক্ষকদের যেন আর কোনো আন্দোলনে আসতে না হয়, সেই ব্যবস্থাপনা তৈরি করা সরকারের জন্য নৈতিক চ্যালেঞ্জ বটে।

কোভিডে লাইনচ্যুত শিক্ষা

কোভিড মহামারিতে সারা বিশ্বের নিয়মতান্ত্রিক জীবনব্যবস্থার ছদ্মপতন ঘটলেও বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছিল শিক্ষায়। বিশ্বের অনেক দেশেই কোভিডের সেই ঝক্কি সামলে উঠে এগিয়ে গেলেও আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাপনা এখনো মন্থরগতিতে রয়েছে। কোভিডে লাইনচ্যুত শিক্ষার ট্রেন সরকার এখনো সারাতে পারেনি। ফলে অটো পাস, সিলেবাস সংক্ষিপ্তকরণ, পরীক্ষা কমিয়েও ‘শিক্ষাকে’ বাগিয়ে আনতে না পারার ব্যর্থতা ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয়’ নেয়নি।

যে কারণে কোভিডের বিদায়ের দুই-তিন বছর পরও পাবলিক পরীক্ষা সময়মতো নেওয়ার কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। মূলত অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে আমাদের শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের মতো পাবলিক পরীক্ষাগুলো সময়মতো না নেওয়ার কারণে চার থেকে ছয় মাসের একটি ‘ব্যবধান’ তৈরি হয়েছে যে পিছিয়ে যাওয়ায় কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষাও পিছিয়ে গেছে। এক সেশনের পরীক্ষা হচ্ছে পরের সেশনে। ভর্তি প্রক্রিয়ায় পিছিয়ে থাকায় ‘উচ্চশিক্ষা’ নিতে যাওয়া শিক্ষার্থীরা বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না।

অথচ এই ব্যবধান কমিয়ে ফেলার জন্য ‘স্কুল বা কলেজের একটি শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যক্রমে শিক্ষকদের সামান্য একটু বেশি পরিশ্রম করলেই দুই বছর আগেই সেই সমস্যা সমাধান করা যেত। দেড় বছরের একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যসূচির পরিবর্তন আনলেও সময়ের ব্যবধান না কমানোর খেসারত কিংবা অতিরিক্ত ক্লাস করানোর মনোভাব শিক্ষকদের মাঝে তৈরি করতে না পারার দরুন শিক্ষায় যে লাইনচ্যুত হয়েছে, তার ক্ষত সারতে আরও সময় লাগবে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের এই পরীক্ষাকে বাগিয়ে আনার কৌশল নতুন বছরের জন্য কিছুটা হলেও চ্যালেঞ্জিং।

বিশ্ববিদ্যালয়ে একক ভর্তি পরীক্ষা

চলতি শিক্ষাবর্ষ থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ‘একক ভর্তি পরীক্ষা’ আয়োজনের কথা থাকলেও তেইশের ‘অজ্ঞাত’ কারণে স্থগিত হয়ে যাওয়া একক ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন এই বছরের বড় চ্যালেঞ্জ। বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মনোমালিন্যের খবর চাউর হওয়ার পরও এই কাঠামোর বাস্তবায়ন আদৌও হবে কি না, তা দুরূহ হয়ে গেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যের অভিপ্রায়ে বাস্তবায়নের পথে আটকে থাকা ‘একক ভর্তি’ পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মনে ক্ষোভের সঞ্চার হলেও বাস্তবে সরকার কতটা সদিচ্ছা প্রকাশ করছে, তার ওপর নির্ভর করছে একক বা সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার ভাগ্য। আমরা যাঁরা দীর্ঘদিন থেকে পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন সময়ে একক ভর্তি পরীক্ষার কাঠামো নিয়ে লেখালেখি-পরামর্শ দিয়ে আসছি, তাঁরা অনেকটাই আশা নিয়ে এই বছর অপেক্ষায় থাকবেন।

ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণায়ের মুখোমুখি অবস্থান ‘অভ্যন্তরীণ’ একটি চিঠিতে স্পষ্ট হওয়ার পর আমরা একক ভর্তি পরীক্ষা কেন স্থগিত হলো, তা নিয়ে প্রথম আলোয় বিস্তারিত লিখেছি। আশা করি একক ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তা দূর করতে তাঁরা সচেষ্ট হবেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিচ্ছিন্নভাবে স্নাতকে ভর্তি পরীক্ষা এই বছরেই শেষ হোক, বছরের মাঝামাঝি সময়ে ‘একক ভর্তি পরীক্ষা’ আয়োজনের প্রজ্ঞাপন জারি হোক, সেই চ্যালেঞ্জ নিয়ে সরকার এগিয়ে যাবে বলে বিশ্বাস করি।

শিক্ষা নিয়ে আমরা কথা বলব, তাঁদের ভুলভ্রান্তি নিয়ে সমালোচনাও করব। যাতে করে আগামী প্রজন্মের জন্য ‘মানসম্মত’ শিক্ষাক্রম তৈরি হয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে যেন আমাদের বাচ্চারা পিছিয়ে না পড়ে, তার জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। তাহলেই একদিন এই দেশটির বিজয়কেতন বিশ্বমণ্ডলে পরিবেষ্টিত হবে।

  • ড. নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়।

    ই-মেইল: [email protected]