হুমায়ূন আহমেদের লেখা
‘দেশপ্রেমের অপরাধে’ প্রিয় নদীর পাড়ে তাঁকে হত্যা করা হয়
ফয়জুর রহমান আহমেদ পেশায় ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পিরোজপুরের মহকুমা পুলিশপ্রধানের দায়িত্ব পালন করছিলেন। পুলিশে চাকরি করলেও তিনি সংস্কৃতিমনা এবং সাহিত্যানুরাগী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন এবং তাঁকে হত্যা করা হয়। তাঁকে নিয়ে তাঁর সন্তান বিশিষ্ট কথাসাহিত্যক হুমায়ূন আহমেদ একটি স্মৃতিচারণামূলক লেখা লিখেছিলেন, যা রশীদ হায়দারের সম্পাদনায় বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত স্মৃতি: ১৯৭১ বইয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বিজয়ের মাস উপলক্ষে প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য সেই লেখা প্রকাশ করা হলো।
আমার বাবা ছিলেন একজন নিশি পাওয়া মানুষ। ঐ জিনিসটা ছোটবেলায় ধরতে পারিনি। তাঁকে বোঝার জন্য আমাকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। অথচ ছোটবেলায় তাঁকে আর দশজন বাবার মতোই মনে হতো। খুব রাগী ছিলেন বলে আমাদের সঙ্গে দূরত্বও ছিল। মাঝে মাঝে বাসায় শাস্তির আসর বসত। আমরা ছোটরা সারা দিনে যেসব অপরাধ করেছি, মা তার বিবরণ দিতেন। বাবা দিতেন ধমক। ভয়াবহ ধমক। ময়মনসিংহের ভাষায় সেই ধমকের নাম—বিজালা ধমক। এতেই আমাদের অবস্থা কাহিল। অথচ মজার ব্যাপার হচ্ছে আমার বাবা কোনো ছেলেমেয়ের গায়ে কখনো হাত তোলেননি। আবার কোলে নিয়ে আদরে–চুমুতে অস্থিরও করেননি। ভালোবাসার প্রকাশ্য প্রকাশ তাঁর ধাতে ছিল না।
তাঁর সব আদর আমরা যখন ঘুমিয়ে থাকি তখনকার জন্যে তোলা থাকত, যাতে আমরা বুঝতে না পারি। এক রাতের কথা মনে আছে—রক্ত আমাশয়ে আমি মরণাপন্ন। চিকিৎসায় কোনো কাজ হচ্ছে না। এক রাতে ঘুম ভেঙে গেল। ঘর অন্ধকার—মেঝেতে নিভু নিভু হারিকেন। লক্ষ করলাম বাবা আমাকে কোলে নিয়ে মূর্তির মতো বসে আছেন। আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। অনেকক্ষণ পর আবারো জেগেছি, সেই একই দৃশ্য।
স্নেহময় পিতা তাঁর রোগাক্রান্ত পুত্রকে কোলে নিয়ে নিশি যাপন করছেন কিন্তু তিনি চাচ্ছেন না ভালোবাসার এই গোপন দৃশ্য কেউ দেখে ফেলুক। অবশ্যি তিনি তাঁর আবেগ পুরোপুরি গোপনও করতে পারতেন না। তিনি তাঁর কন্যাদের প্রতি অতিরিক্ত রকমের দুর্বল ছিলেন। ঈদের দিনে আমাদের সব ভাই–বোনের জন্যে নতুন কাপড় কেনা প্রায় সময়ই সম্ভব হতো না অথচ বোনেরা ঠিকই পেত। তারা কখনো কিছু চেয়ে পায়নি, এমন নজির নাই। অবশ্য বোনরা খুব লক্ষ্মী ছিল, তারা কখনো বড় কিছু চেয়ে তাদের দরিদ্র বাবাকে বিব্রত করেনি।
পৃথিবীর সব বাবাই তাঁদের হৃদয়ে ভালোবাসার সমুদ্র ধারণ করেন। এদিক দিয়ে আমার বাবাকে অন্য দশজন বাবার কাছ থেকে আলাদা করা ঠিক হবে না—তিনি অন্য রকম ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে। তাঁর মাথার ভেতর কেমন করে জানি কিছু রঙিন পোকা ঢুকে গিয়েছিল। ঐ সব পোকা অনবরত তাঁর মাথায় স্বপ্ন তৈরি করত। মধুর সব স্বপ্ন-সংগীত, সৌন্দর্য, সাহিত্য।
আমাদের সিলেটের মীরাবাজারের বাসায় কিছুদিন পরপর বসত গানের আসর। আসতেন অনেকেই, তাঁদের মধ্যে একজনের কথা খুব মনে পড়ে—সুরসাগর প্রাণেশ দাস। আসতেন কবি-সাহিত্যিকরা। শুধু স্থানীয় কবি-সাহিত্যিকরাই নন—চিঠি লিখে মনিঅর্ডারে টাকা পাঠিয়ে দূরের জনকে আনতেন।
বাবার সময় কাটত মহাসুখে। মাঝে মাঝে সাহিত্যচর্চার জন্যে তিনি অফিস থেকে ছুটি নিতেন। এই ছবিটি খুব চোখে ভাসে বুকের নিচে বালিশ দিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে আছেন। ক্রমাগত লিখে যাচ্ছেন, তাঁর চোখে–মুখে গভীর আনন্দ। এই আনন্দের উৎস কোথায়, খুব জানতে ইচ্ছে করত।
তাঁর সাহিত্য সাধনার স্বীকৃতি হিসেবে ঘরে আমরা একটা বাঁধানো সার্টিফিকেট দেখতাম। সেখানে লেখা—ফয়জুর রহমানকে সাহিত্য সুধাকর উপাধি দেয়া হলো। এই উপাধি তাঁকে কারা দিয়েছেন, কেন দিয়েছেন, কিছুই মনে নেই, তবে তাঁর কবরের নামফলকে আমরা এই উপাধি গভীর মমতায় বসিয়ে দিয়েছি। বাবা ছিলেন স্বপ্ন পাওয়া মানুষ। নানান ভঙ্গিতে তাঁর স্বপ্ন বাস্তবে প্রকাশ পেত আর তার ঝামেলা পোহাতে হতো আমার মাকে। যেমন একবার তিনি তাঁর বেতনের বড় একটা অংশ খরচ করে একটা বেহালা কিনে ফেললেন। উদ্দেশ্য বেহালাবাদক হবেন। তাঁর সময় হলো না। আমরা তাঁর পুত্রকন্যারা বেহালায় হাত মক্শ করতে করতে অল্প সময়ের মধ্যে বেহালার দফা শেষ করলাম। কিছুদিন পর সস্তায় একটা ঘোড়া কিনে ফেললেন। আমাদের মীরাবাজারের বাসার সামনের একটা সুপারিগাছে সেই ঘোড়া বাঁধা থাকত। আসাদ নামের একজন কাজের লোক সেই ঘোড়াকে ছোলা খাওয়াত। আমরা বাচ্চারা সেই প্রাণীটির ভয়ে অস্থির ছিলাম।
পরিষ্কার মনে আছে, ঘোড়ার কাছে আমাদেরকে নিয়ে গেলেই আমরা বিকট চিৎকার করতাম। দু’মাসের মধ্যে এই প্রাণীটি বিক্রি করে বাবা একটা হারমোনিয়াম কিনলেন। আমরা সকাল–বিকাল সেই হারমোনিয়াম ঘিরে বসতাম এবং প্রাণপণে চেঁচাতাম—খোলো খোলো দ্বার, রাখিয়ো না আর বাহিরে আমায় দাঁড়ায়ে।
বাসাভর্তি ছিল বই। ট্রাংকে বই, আলমিরায় বই, খাটের নিচে বই। প্রতি শীতে সেইসব বই রোদ দেয়া হতো। বইয়ের সংখ্যা যে আশেপাশের সবার বিস্ময় উদ্রেক করত, ছোটবয়সেও তা ভালোই বুঝতে পারতাম। পরবর্তী সময়ে বাবার সন্তানতুল্য এই সমস্ত বই জনৈক পাকিস্তানি কর্নেলের নির্দেশে লুট করা হয়। পিরোজপুর শহরে একদল মানুষ বাসার যাবতীয় আসবাবপত্রের সঙ্গে বইগুলিও নিয়ে যায়। কাজটি করে আমার দেশের মানুষ—এই দুঃখ কোথায় রাখি?
বই ছাড়াও ছিল বাঁধানো ছবি। ছোট, বড়, মাঝারি নানান সাইজের ফ্রেমে বাঁধা ছবি। রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের পাশাপাশি মহাত্মা গান্ধী, জিন্নাহ সাহেব, লিয়াকত আলী খান। জর্জ বার্নার্ড শ-র দুটি ছবি ছিল। ছবি থেকে বাবার মানসিকতা আঁচ করার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। যখন যাঁকে তাঁর পছন্দ হয়েছে তাঁর ছবিই তিনি বাঁধিয়ে ফেলেছেন। কোন ছবিটি কার—কী জন্যে ছবির মানুষটি বিখ্যাত এইসব আমাদের কাছে তিনি কখনো প্রকাশ করেননি। এর থেকে মনে হয়, ছবিগুলি তিনি তাঁর নিজের আনন্দের জন্যেই টানিয়েছেন, কাউকে কিছু শেখানোর জন্যে নয়।
অবশ্যি একটি জিনিস তিনি তাঁর ছেলেমেয়েদের সচেতনভাবে শেখাবার চেষ্টা করতেন—তা হচ্ছে সৌন্দর্যবোধ। প্রচণ্ড শীতের রাতে আমাদের সবাইকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে গেছেন একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখাবেন। আমরা তখন থাকি দিনাজপুরের পঁচাগড়ে। অদ্ভুত দৃশ্য হচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া। আমরা শীতে থরথর করে কাঁপছি, বাবা উত্তেজনায় কাঁপছেন—দেখ কী অদ্ভুত জিনিস—তাকিয়ে দেখ।
পুলিশে চাকরি করতেন, কিছুদিন পরপর তাঁকে বদলি করা হতো। বাংলাদেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত আমরা তাঁর সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছি। শৈশব প্রকৃতির সৌন্দর্যে মোহিত হবার বয়স নয়। আমি মগ্ন হতাম বাবাকে দেখে। দিনাজপুরে শালবন, বান্দরবনের শঙ্খ নদী, রাঙামাটির পাহাড় যা-ই দেখতেন মুগ্ধ হতেন। আমাদের মনে আছে দিনাজপুরের জগদ্দলে যখন ছিলাম, তখন রোজ তিনি আমাদের নিয়ে বনের ভেতর ঢুকে যেতেন। হাতে গুলিভরা বন্দুক থাকত, কারণ তখন প্রায়ই বাঘ বেরুত। আমরা ছোটরা বাঘের ভয়েই অস্থির থাকতাম, বনের সৌন্দর্য আমাদের স্পর্শ করত না।
সৌন্দর্যের প্রতি তাঁর এই প্রগাঢ় মমতার কারণেই হয়তো জীবনের শেষ সময়টা তিনি কাটাতে এলেন সৌন্দর্যের লীলাভূমি বরিশালে। বিশাল সব শান্ত নদী তার পাশে নারকেলবন। ঘন সবুজ এক স্বপ্নের দেশ। মহকুমা পুলিশপ্রধান হয়ে তিনি এলেন পিরোজপুরে। আমরা প্রায়ই নৌকা নিয়ে বেরুতাম। নৌকায় বোনরা হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করত। বাবার হৃদয় হয়তোবা কিছুটা উদাস হয়ে যেত। সেই সময় অগ্নিময় দেশের ভবিষ্যতের চিন্তা তাঁকে গ্রাস করে ফেলেছিল। কোনো কাজেই তিনি মন দিতে পারতেন না। সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলাপ করতেন।
আলাপের ব্যাপার একটিই—দেশের কী হবে?
আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র। আমার ছোট দুই ভাই–বোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। দেশের এই থমথমে অবস্থায় আমরা সবাই ঢাকা ছেড়ে বাবার কাছে এসেছি। আমাদের কথাবার্তা শুনে তিনি আরো গম্ভীর হয়ে গেলেন—সারাক্ষণ বলতেন—আমরা কী করব? আমাদের কী করা উচিত?
তাঁর যে কী করা উচিত, তা তিনি টের পেলেন ২৫শে মার্চের রাতে। ওয়্যারলেসে পিরোজপুরে খবর এল, রাজারবাগ পুলিশ হেডকোয়ার্টারে পাকিস্তানি মিলিটারি গুলিবর্ষণ শুরু করেছে। পাল্টা গুলি করছে পুলিশরা।
আমার নিশি পাওয়া স্বপ্নগ্রস্ত বাবার স্বপ্ন ভঙ্গ হলো। তিনি বুঝলেন তাঁর কী করা উচিত? পুলিশের অস্ত্রাগারে যা-কিছু অস্ত্র ছিল, তা দিয়ে প্রতিরোধ বাহিনী তৈরি করা হলো। ট্রেনিং ক্যাম্প খোলা হলো। জনগণকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হলো। যত দিন যেতে লাগল বাবা অস্থির হয়ে উঠতে লাগলেন। আমাদের পাঠিয়ে দিলেন বরিশালে এক গণ্ডগ্রামে, যাতে পাক আর্মি আমাদের খুঁজে বের করতে না পারে। তিনি একা পিরোজপুরে থেকে গেলেন।
একসময় গানবোট নিয়ে পাক আর্মি পিরোজপুর শহরে উঠে এল। একটি গুলিও তাদের ওপর বর্ষিত হলো না।
বাবা তাদের হাতে ধরা পড়লেন। দেশপ্রেমের অপরাধে ৫ই মে ১৯৭১ সালে তাঁর প্রিয় নদীর পাড়ে তাঁকে হত্যা করা হলো। তাঁর লাশ নদীতে ভাসতে লাগল। সেই নদীতে, যেখানে তিনি তাঁর পুত্র–কন্যা এবং মমতাময়ী স্ত্রীকে নিয়ে কত না রজনী কাটিয়েছেন। মৃত্যুর সময় তিনি কী ভেবেছিলেন, আজ তা জানার কোনো উপায় নেই। কিন্তু আমার ধারণা, মৃত্যুর পূর্বক্ষণেও প্রকৃতিসৌন্দর্য তাঁকে অভিভূত করেছিল। বাংলার এই সবুজ করুণ ডাঙায় হয়তোবা আর একবার আসবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।
হুমায়ূন আহমেদ প্রয়াত কথাসাহিত্যিক এবং ফয়জুর রহমান আহমেদের সন্তান