‘প্রাইভেট’ পড়ানো যেভাবে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে বাধা

কয়েক দিন আগের ঘটনা। নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে ঢাকার টিচার্স ট্রেনিং কলেজে মাস্টার ট্রেইনারদের প্রশিক্ষণ চলছে। প্রশিক্ষণের ফাঁকে এনসিটিবির একজন কর্মকর্তা তাঁর ব্যক্তিগত মুঠোফোনের একটি এসএমএস পড়তে দিলেন। রীতিমতো আঁতকে ওঠার মতো ব্যাপার!

টিচার্স ট্রেনিং কলেজের পাশের একটি সরকারি বিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক ওই এসএমএসটি পাঠিয়েছেন। নতুন বছরে যেসব শিক্ষার্থী তাঁর কাছে ‘প্রাইভেট’ পড়তে চায়, তাদের এখনই বিকাশে বা নগদে টাকা পাঠিয়ে ভর্তি নিশ্চিত করতে বলেছেন। হোয়াটসঅ্যাপে রীতিমতো গ্রুপ খুলে তিনি ব্যাচ পড়ানোর কাজটি করে চলেছেন। এমনকি জানা গেল, করোনার সময়ও তাঁর ‘ব্যবসা’ ছিল রমরমা। এ রকম শিক্ষক দেশজুড়ে থাকলে বিদ্যালয়ে ক্লাস না হলেও শিক্ষার্থীদের সমস্যা হওয়ার কথা নয়!

২০২৩ সালে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির নতুন বই আসছে। এর ধারাবাহিকতায় পরের বছরগুলোতে অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির বইও আসবে। শুধু বই-ই নতুন হচ্ছে না, নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদান প্রক্রিয়া এবং মূল্যায়নপদ্ধতিও সম্পূর্ণ পাল্টে যাচ্ছে। টিচার্স ট্রেনিং কলেজে সেই প্রশিক্ষণই চলছিল। মাস্টার ট্রেইনাররা ক্লাস ও মূল্যায়নের প্রক্রিয়া বুঝে নিচ্ছেন।

এরপর এসব মাস্টার ট্রেইনার প্রশিক্ষণ দেবেন সারা দেশের শিক্ষক প্রশিক্ষকদের। শিক্ষক প্রশিক্ষকদের কাছ থেকে শ্রেণিকক্ষের শিক্ষকেরা সরাসরি বুঝে নেবেন ক্লাস মূল্যায়নের নতুন পদ্ধতি। পুরো প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের পথে অনেক বাধা রয়েছে। কিন্তু শ্রেণিকক্ষে যাঁরা মূল কাজটি করবেন, তাঁদের দায়িত্ব বোধ করি সবচেয়ে বেশি। এবার প্রশিক্ষণের ব্যাপারটি তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বছরের পর বছর ধরে যে প্রক্রিয়ায় ক্লাস চলত, এখন আর সেই প্রক্রিয়ায় ক্লাস নেওয়া যাবে না। কিন্তু নতুন নিয়মে কীভাবে ক্লাস নিতে হবে, পরীক্ষা বলে আদৌ কিছু থাকবে কি না, সেগুলো না বুঝেই অনেক শিক্ষক বিভিন্ন উপায়ে ‘প্রাইভেট’ পড়ানোর প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। নতুন শ্রেণিতে ওঠার আগেই শিক্ষার্থীর ‘ব্যাচ’ নিশ্চিত করতে অভিভাবকদেরও বিভ্রান্ত করছেন।

নতুন শিক্ষাক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই জানেন, এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের প্রধান বাধা শিক্ষকেরাই। শিক্ষকদের বড় অংশ শ্রেণিকক্ষের বাইরে পাঠদানে অভ্যস্ত। সেখান থেকে পাঠদান প্রক্রিয়াকে আবার শ্রেণিকক্ষে নিয়ে যাওয়া শিক্ষকদের পক্ষে সহজ নয়। অধিকাংশ স্কুলে রুটিন অনুসারে একেকটি ক্লাসের ঘণ্টা পড়ে, কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় ক্লাসে কোনো পড়াশোনাই হয় না।

প্রায় ক্ষেত্রেই শিক্ষক ক্লাসে গল্প করে কাটিয়ে দেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনি একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। তবে বিষয়টি এমনভাবে উপস্থাপন করেন, যাতে শিক্ষার্থীদের মনে হয় তাঁর কাছে আলাদাভাবে ‘প্রাইভেট’ না পড়লে পরীক্ষায় পাস করা সম্ভব নয়। শিক্ষার্থীদের আতঙ্ক অভিভাবকদের মধ্যে আরও গভীরভাবে সঞ্চারিত হয়। ফলে একটি ক্লাসে হাতে গোনা দু-চারজন শিক্ষার্থী পাওয়াই কঠিন, যারা নিজে নিজে প্রতিদিনের পড়া তৈরি করে। অথচ এমন হওয়ার কথা ছিল না।

আগের শিক্ষাক্রম ছিল প্রতিযোগিতামূলক, যেখানে একজন শিক্ষার্থী আরেকজন শিক্ষার্থীকে তার নোট বা উত্তর দেখাত না। আর নতুন শিক্ষাক্রম হচ্ছে সহযোগিতামূলক, যেখানে শিক্ষার্থীরাই পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের পথে এগিয়ে যাবে

পুরোনো শিক্ষাপদ্ধতির সঙ্গে নতুন শিক্ষাপদ্ধতির যোজন যোজন ফারাক রয়েছে। পুরোনো পদ্ধতিতে শিক্ষকের কাজ কোনো একটি টপিক বা বিষয় নিয়ে ক্লাসে আলোচনা করা। আলোচনার সময়ে ক্ষেত্রবিশেষে তিনি শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করে জেনে নিতে পারেন, বোঝার ক্ষেত্রে তাদের কোনো সমস্যা আছে কি না। এরপর লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হয় তার অবস্থান। এই মূল্যায়ন ছিল নম্বর ও জিপিএভিত্তিক।

নতুন পদ্ধতিতে শিক্ষক সরাসরি কোনো বিষয় বা টপিক পড়ানো শুরু করবেন না। চারটি ধাপ অনুসরণ করে শিক্ষক পাঠদানের কাজটি করবেন। প্রথম ধাপে তিনি কোনো একটি বিষয় নিয়ে শিক্ষার্থীদের মতামত যাচাই করবেন। এ ক্ষেত্রে তিনি শিক্ষার্থীদের একক কাজ দিতে পারেন, দলগতভাবেও কাজ করার সুযোগ দিতে পারেন। এর মধ্য দিয়ে শিক্ষক তাদের জ্ঞানের স্তর সম্পর্কে ধারণা পাবেন এবং দুর্বল শিক্ষার্থীকে শনাক্ত করতে পারবেন। দ্বিতীয় ধাপে শিক্ষক প্রত্যেকের বা প্রতিটি দলের মতামতের ভিত্তিতে অন্য শিক্ষার্থীদের অভিমত বা প্রতিক্রিয়া লক্ষ করবেন।

এ সময়ে শিক্ষক বিশেষভাবে লক্ষ করবেন, তারা গুরুতর কোনো ভুল করছে কি না। তিনি তাদের অনুসন্ধান, আলোচনা ও প্রতিক্রিয়াকে প্রশংসা করবেন। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পারস্পরিক জ্ঞানের সঞ্চারণ ঘটবে। তৃতীয় ধাপে শিক্ষক পুরো ধারণাটি পরিষ্কার করবেন বা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবেন। এ অংশে শিক্ষকের ভূমিকা হবে মুখ্য। আলোচনার যেকোনো পর্যায়ে তিনি শিক্ষার্থীদের মনে তৈরি হওয়া প্রশ্নের জবাব দেবেন। চতুর্থ বা শেষ ধাপে অন্য কোনো কাজের মধ্য দিয়ে শিক্ষক পর্যবেক্ষণ করবেন শিক্ষার্থীরা বিষয়টি কতটুকু বুঝতে পেরেছে। শিক্ষার্থী তার অর্জিত জ্ঞান বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারছে কি না, তা যাচাই করা চতুর্থ ধাপের লক্ষ্য।

আরও পড়ুন

পাঠদান প্রক্রিয়ার মতো মূল্যায়নপদ্ধতিও আগের মতো থাকছে না। মূল্যায়নের কাজটি চলবে মূলত বছরজুড়ে। শ্রেণিকক্ষের বিভিন্ন কাজের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা নির্ধারিত যোগ্যতাগুলো অর্জন করার চেষ্টা করবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী কতটুকু যোগ্যতা অর্জন করেছে, বা কতটুকু পারছে, শিক্ষক সেটুকু অ্যাপসে বা এক্সেল শিটে চিহ্নিত করে রাখবেন।

বছরের যেকোনো সময়ে যোগ্যতাটি অর্জন করতে পারলেই চলবে। কোনো শিক্ষার্থী যোগ্যতা অর্জন করার আগেই যদি শিক্ষক তাকে ‘পারে’ বা ‘সফল’ বলে চিহ্নিত করেন, তবে ওই শিক্ষার্থী পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলেও প্রকৃত দক্ষতা অর্জন করতে সক্ষম হবে না। আর নতুন শিক্ষাক্রম নম্বর বা জিপিএভিত্তিক না হওয়ার কারণে ফলাফলের পেছনেও কাউকে ছুটতে হবে না। লক্ষ করার ব্যাপার, আগের শিক্ষাক্রম ছিল প্রতিযোগিতামূলক, যেখানে একজন শিক্ষার্থী আরেকজন শিক্ষার্থীকে তার নোট বা উত্তর দেখাত না। আর নতুন শিক্ষাক্রম হচ্ছে সহযোগিতামূলক, যেখানে শিক্ষার্থীরাই পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের পথে এগিয়ে যাবে।

এই প্রক্রিয়াকে সফল করে তুলতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সতর্ক থাকতে হবে। ‘প্রাইভেট’ পড়ানোর প্রচার চালিয়ে শুরুতেই শিক্ষকদের একটি অংশ নতুন শিক্ষাক্রমের উদ্দেশ্যকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিচ্ছেন। নতুন শিক্ষাক্রম পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে যায় কি না, সেটা সময়ই বলে দেবে। তবে এ ধরনের শিক্ষকদের এখনই থামাতে হবে। শুধু কঠিন আইন করে শিক্ষকদের অর্থ আয়ের অসৎ উদ্যোগকে থামানো যাবে না। নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠদান পদ্ধতি ও মূল্যায়নপ্রক্রিয়া যথাযথভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান সম্ভব।

  • তারিক মনজুর অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়