তিনি পুড়ছেন আমাদের নিয়েই

বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের তৎপরতাছবি: প্রথম আলো

ঢাকা রেলওয়ে পুলিশের উপপরিদর্শক সেতাফুর রহমান গোটা গোটা অক্ষরে সুরতহাল প্রতিবেদন লিখছেন, ‘চলন্ত ট্রেনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে সম্পূর্ণ শরীর আগুনে ঝলসে গিয়াছে। জখমের চিহ্ন বর্ণনা করার মতো কিছু নাই।’

সেতাফুরের ঠিক পেছনে মর্গ। তালাবদ্ধ দুই কক্ষে চারটি মরদেহ রাখা আছে। এমনভাবে পুড়েছে যে ডিএনএ প্রতিবেদন ছাড়া স্বজনদের হাতে লাশ বুঝিয়ে দেওয়া অসম্ভব। তবু মন মানে কই।

বেসরকারি একটি ওষুধ প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী ষাটোর্ধ্ব আবদুল হক এসেছেন ছেলের খোঁজে। ছেলে আবু তালহা বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। ফরিদপুর থেকে বেনাপোল এক্সপ্রেসে ঢাকা, সেখান থেকে সৈয়দপুরে যাওয়ার কথা ছিল।

তালহা এবার ফরিদপুর থেকে ফেরার আগে সবার সঙ্গে ছবি তুলেছেন। মাকে বলেছেন, ‘ভালো শাড়ি পরো, তোমার সবচেয়ে সুন্দর শাড়িটা।’

রাতে ট্রেনে আগুন লাগার খবর শুনে ছেলেকে ফোন করেছিলেন। বন্ধ পান। আদরের প্রথম সন্তানকে বাড়ি থেকে বিদায় দেওয়ার সময় ছুঁয়েছিলেন, ওটাই কি শেষ স্পর্শ? কে জানে!

গোপীবাগে জ্বলতে থাকা বেনাপোল এক্সপ্রেসে আরও একটা ছবি আমরা দেখলাম। ট্রেনের জানালা দিয়ে পুড়তে থাকা এক ব্যক্তির মুখটা ঝুলে আছে, বেরিয়ে আছে হাত দুটি। ঘটনাস্থলে যাঁরা গিয়েছিলেন, সেই সব সাংবাদিক বলছিলেন, ‘তিনি বলেছেন, “আমার স্ত্রী-সন্তানকে বের করুন। ওদের বাঁচান।”’

রাজধানীর এশিয়ান ইউনিভার্সিটির ফার্মেসি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন চন্দ্রিমা রায়। চিকিৎসক ভাই দিবাকর রায় খুঁজতে এসেছেন বোনকে।

নাতাশা জেসমিন পুড়েছেন তাঁর স্বামী মো. আসিফ খানের সামনেই। রাতেই ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স একটি শিশুর মৃত্যুর খবর দিয়েছিল। তার স্বজনেরাও হয়তো ছিলেন আশপাশে কোথাও। কাঁদতে কাঁদতে হয়রান হয়ে কোথাও মরার মতো পড়ে আছেন।

এখন পর্যন্ত চার লাশের জন্য আবেদন করেছেন পাঁচজন। স্বজনদের কবে সমাহিত করতে পারবেন, ঠিক নেই। চিকিৎসকেরা এখন স্বজনদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করবেন, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের ফরেনসিক পরীক্ষাগারে নমুনা মিলিয়ে দেখা হবে। সে এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া। তত দিন পর্যন্ত খাঁ খাঁ বুকে স্বজনদের অপেক্ষা জারি থাকবে।

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই দফায় সহিংসতার শুরু ২৮ অক্টোবর। আমরা পুলিশ কনস্টেবল আমিরুল ইসলাম পারভেজকে পিটিয়ে হত্যার ভিডিও দেখলাম, বাসচালকের ঘুমন্ত সহকারী ২২ বছরের নাইমের অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার খবর পেলাম।

জানলাম, গত ১৯ ডিসেম্বর মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে যখন আগুন লাগানো হয়, তখন কোলের শিশুটিকে বাঁচাতে জাপটে ধরেছিলেন মা। তা-ও শেষ রক্ষা হয়নি। এক ঘটনায় মারা গেছেন চারজন।

গোপীবাগে ট্রেনে আগুনের ঘটনা ঘটার ২৪ ঘণ্টার কম সময়ের মধ্যে পুলিশ জানিয়ে দিয়েছে, কারা আছে নাশকতার পেছনে। খুদে বার্তায় তারা বলেছে, ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যানবাহনে আগুন দেওয়া, প্রার্থীদের অস্থায়ী নির্বাচনী ক্যাম্পকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া, ভোটকেন্দ্রে অথবা তার আশপাশে হাতবোমা নিক্ষেপ করে ভোটারদের আতঙ্কিত করা, প্রচারপত্র বিলি করার কাজসহ গতকাল গোপীবাগে বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনের বগিতে আগুন দেওয়ার অন্যতম পরিকল্পনাকারী এবং জনবলদাতা মনসুর আলম এবং বিএনপির পক্ষে আশ্রয় এবং অর্থদাতা নবীউল্লাহ নবীকে পৃথক পৃথক অভিযান চালিয়ে মোট ৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি লালবাগ এবং ওয়ারী বিভাগ।’

প্রশ্ন ওঠে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেন ঘটনা ঘটার আগেই অভিযুক্তদের শনাক্ত করতে পারে না?

আরও পড়ুন

আওয়ামী লীগ এসব সহিংসতার জন্য বিএনপিকে দুষছে, বিএনপি আওয়ামী লীগকে। দেদারে বিবৃতি দিচ্ছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। জাতিসংঘকেও কথা বলতে হচ্ছে সহিংসতার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স জানাল, সারা দেশে শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে শনিবার সকাল ১০টা পর্যন্ত ট্রেনসহ ৬টি যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আগুন দেওয়া হয়েছে ৯টি স্থাপনায়। এর মধ্যে ৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ১টি উচ্চবিদ্যালয়ে। আজ ৭ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচন এই আগুন আর কত মানুষকে পোড়াবে, কে জানে?

তারপরও আমাদের অনেকেই এসব ঘটনায় দর্শক। কবিতার সেই লোকটির মতো, ‘দাদা আমি সাতে পাঁচে থাকি না/ যে যা করে দেখি ভাই, সুবিধাটা নিয়ে যাই/ ধুম করে প্রকাশ্যে আসি না/ দাদা আমি সাতে পাঁচে থাকি না/ রাজনীতি, দলাদলি কিংবা সে কোলাকুলি/ যে যা খুশি হয়ে যাক, দুনিয়া চুলোয় যাক/ আমি টুঁ শব্দটি করি না/ বারান্দা থেকে আমি নামি না/ দাদা আমি সাতে পাঁচে থাকি না।’

গোপীবাগে জ্বলতে থাকা বেনাপোল এক্সপ্রেসে আরও একটা ছবি আমরা দেখলাম। ট্রেনের জানালা দিয়ে পুড়তে থাকা এক ব্যক্তির মুখটা ঝুলে আছে, বেরিয়ে আছে হাত দুটি। ঘটনাস্থলে যাঁরা গিয়েছিলেন, সেই সব সাংবাদিক বলছিলেন, ‘তিনি বলেছেন, “আমার স্ত্রী-সন্তানকে বের করুন। ওদের বাঁচান।”’ পরে তিনি আর বের হতে পারেননি। তাঁরা কি বের হতে পেরেছিলেন?

এই লেখা যখন লিখছি, তখনো এই ব্যক্তির পরিচয় জানা যায়নি। শুধু জানি, এই পুড়তে থাকা মানুষটাই সম্মিলিতভাবে পরাজিত এই জনগোষ্ঠীর প্রতিভূ। ক্রমাগত তিনি পুড়ছেন আমাদের নিয়েই।

  • শেখ সাবিহা আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক

    [email protected]