মার্কিন ভিসা নীতি: সংবিধান ও আইন মানলে উদ্বেগের কিছু নেই

গত মাসের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশিদের সে দেশের ভিসা পাওয়া বা বাতিলের শর্তাদি নিয়ে একগুচ্ছ নীতিমালা প্রকাশ করেছে। এটি গণমাধ্যমকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র বিভাগ থেকে সরাসরি অবগত করেন সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। অবশ্য সম্পূর্ণ বিষয়টি তারা মাসের শুরুতেই সরকারকে অবগত করেছিল বলে উল্লেখ রয়েছে।

নীতিমালা ঘোষণার পর ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত দেশের তিনটি প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতাদের আমন্ত্রণ করে বিষয়টি অবগত করেন। সেখানে তাঁরা সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন বলে জেনেছিলাম।

পরপরই শুরু হয় বিভিন্ন ধরনের আচরণ। বিএনপি এই নীতিমালায় উল্লাস প্রকাশ করতে থাকে। তাদের মতে, এর ফলে সরকার বড় ধরনের বিপদে পড়বে। অন্যদিকে সরকারপক্ষ সজোরে জানায়, এই নীতিমালা কার্যত বিএনপির বিপরীতে গেছে।

কেননা, ভোটে বিঘ্ন সৃষ্টি তারাই করে। কয়েক দিন এভাবে গেলেও সরকারি দলের অবস্থানে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। উচ্চপর্যায় থেকে এই নীতি নিয়ে তোয়াক্কা না করতে কর্মী–সমর্থকদের আহ্বান জানানো হয়। উল্লেখ করা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে না গেলেও যাওয়ার মতো আরও অনেক দেশ-মহাদেশ আছে।

অন্যদিকে তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করতে চায় সরকার। আর দুটি দেশের মাঝে সম্পর্ক অতি চমৎকার। অন্যদিকে আওয়ামী লীগকে ঘিরে গড়ে ওঠা ১৪-দলীয় জোট বৈঠক করে জানায়, মার্কিন ভিসা নীতি ‘দুরভিসন্ধিমূলক’। তাদের মতে, নীতিমালাটি অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনাহূতভাবে এসেছে। আবারও গণমাধ্যমে লক্ষ করা গেল ভিসা নীতির বিষয়ে ভারত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। উল্লেখ্য, এই নীতিমালা শুধু বাংলাদেশকেন্দ্রিক। ভারত কিংবা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশকেন্দ্রিক নয়। তা সত্ত্বেও এতে আমাদের অবস্থান ও পরিস্থিতি যে কেউ পর্যবেক্ষণ করতে পারে।

আলোচনা সংগত যে এই ভিসা নীতি মূলত বাংলাদেশের মানবাধিকার, আসন্ন নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট মহলগুলোর আচরণ ও জনগণের রায়কে যথাযথভাবে প্রতিফলনের উৎকণ্ঠাকেন্দ্রিক। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এখন কিংবা আগেকার প্রশাসনের এতদ্‌বিষয়ক কোনো কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা, রাজনৈতিক দলের সদস্যসহ অনেকেই সংশ্লিষ্ট আছেন। নীতিমালায় বলা হয়েছে, মানবাধিকার লঙ্ঘন, নির্বাচনকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করার জন্য যেকোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী ব্যক্তিরা মার্কিন ভিসা লাভে অযোগ্য বিবেচিত হবেন। ভিসা থাকলেও তা হবে বাতিল।

আপাতদৃষ্টে এটা কঠোর মনে হতে পারে। তবে অসংগত বলা যাবে কি? এগুলো আমাদের সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার কিংবা সংসদ নির্বাচন পরিচালনাসংক্রান্ত আইনের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ বলা যাবে কি? বরং বলতে হবে আমাদের সংবিধানে মানবাধিকার সুরক্ষার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। এটা সমভাবে সব ক্ষেত্রে কাজ করে না বলেই অন্যদের বলতে হয়। তেমনি জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশে বর্ণিত নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন ঘটারই কথা।

মার্কিন মুল্লুকটি অভিবাসীদের। তবে গণতন্ত্র, মানবাধিকারসহ কিছু মূল্যবোধে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী। তারা চায় অন্যরা তাই হোক। হতে পারে গণতন্ত্রের ধরন ভিন্নতর। তবে আমরাও তো একই মূল্যবোধে বিশ্বাসী।আমাদের স্বাধীনতার চেতনাও তাই। আজ সে দেশটি আমাদের রপ্তানি পণ্যের একক বৃহত্তম দেশ। প্রবাসী আয়ের প্রধান উৎস। আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে বৈদেশিক বিনিয়োগকারী। আমাদের বিশাল জনগোষ্ঠী ক্রমান্বয়ে সেখানে থিতু হচ্ছে। সূচনাকালের কিছু সমস্যা বাদ দিলে তো তাঁরা ভালোই আছেন।

যারা বাধাবিঘ্ন সৃষ্টি করে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থার বিধানও রয়েছে এই আদেশে। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখতে পাই এর বিপরীত চিত্র। যেমনটি দেখেছি ২০১৪ বা ২০১৮-এর নির্বাচনে। এসব ক্ষেত্রে আর যা-ই হোক ভোটের ফলাফলে জনমতের প্রতিফলন ঘটেছে, এমনটা বলা যাবে না।

এমন অসংগত ও অন্যায় কাজ যারা করেছে, তাদের কোনো একজনের বিরুদ্ধে আইনানুসারে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা আমরা শুনিনি। বরং সরকারবিরোধী শক্তিগুলোর রাজনৈতিক কার্যক্রম দলীয় বা সরকারি চাপ প্রয়োগে বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনাই জানতে পারছি এখনো।

প্রশ্ন আসতে পারে, এতে যুক্তরাষ্ট্রের নাক গলানো কেন? বিশ্ব এখন মুক্ত! অনেক কিছুই সীমান্তের বেড়াজালে আটকা থাকে না। তবু অনস্বীকার্য যে আমাদের সংবিধানের নির্দেশনা ও আইনের বাধ্যবাধকতার মধ্য থেকে আমরা নির্বাচন করতে পারছি না বলেই যখন যারা বিরোধী দলে থাকে, তখন তারা সরকারকে চাপ দিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও বহুজাতিক সংস্থা যেমন জাতিসংঘ, কমনওয়েলথসহ অনেকের সহায়তা কামনা করে। আওয়ামী লীগও করেছে একাধিকবার।

এমনটা করার প্রয়োজন না হলে আপামর জনগণ আনন্দিতই হতো। আর যুক্তরাষ্ট্র তো অন্যায় কোনো বিধান এই নীতিমালায় যুক্ত করেনি। বরং আমাদের সংবিধান ও আইন অনুসরণের জন্য একটি মৃদু বার্তাই দিয়েছে।

যেকোনো রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের নাগরিকদের তার দেশে প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাখে। সেটা আমাদের আছে। তেমনি আছে যুক্তরাষ্ট্রের। তবে এবার আমাদের কেন্দ্র করে তাদের ভিসা নীতিতে বিশেষ কিছু বিধান সংযোজন ও প্রয়োগ আমাদের জন্য মর্যাদাকর নয়, এটা বলতে হবে।

তবে বিষয়টি এসেছে অনেক দৃশ্য-অদৃশ্য উপদেশ বা পরামর্শ উপেক্ষিত হওয়ার পর। আর এর দায়দায়িত্ব তাদের, যারা এ দেশের সংবিধান ও আইন স্বীকৃত স্বাধীনতার মূল চেতনা সর্বজনীন ভোটাধিকারের মাধ্যমে নির্বাচনের অধিকারকে পাশ কাটানোর চেষ্টা করেছেন। দীর্ঘ ক্যানভাসে এখানে প্রধান তিনটি দলেরই দায়দায়িত্ব রয়েছে।

মার্কিন ভিসার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টিও এখানে আলোচনার দাবি রাখে। ঔপনিবেশিক ধারাবাহিকতায় একসময় ব্রিটেন ছিল আমাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষী জ্ঞানপিপাসুদের প্রধান গন্তব্য। পাশাপাশি জীবিকার প্রয়োজনে অনেকেই সেখানে পাড়ি দিয়েছেন। কালের বিবর্তনে ক্রমবর্ধমান আগন্তুকদের ধারণ করার ক্ষমতা সে দেশের কমে গেছে। কমে এসেছে বিভিন্ন বৃত্তি।

সে শূন্যতা পূরণ করতে অনেক বেশি সুযোগ নিয়ে হাতছানি দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। আমাদের দেশের বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী স্নাতক পর্যায়েই পুরো বৃত্তি নিয়ে পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছেন। স্নাতকোত্তর পর্যায়ে তো রয়েছে। খণ্ডকালীন চাকরি করেই অনেকে মেটাচ্ছেন পড়াশোনার খরচ। ভিজিট ভিসায় গিয়েও কোনো একপর্যায়ে কেউ কেউ নিচ্ছেন উচ্চ ডিগ্রি। সমৃদ্ধিকে নিজেদের আওতায় এনেছেন। সে দেশটি অভিবাসীদের।

আরও পড়ুন

তবে প্রভূত সুযোগের দেশ। এ সুযোগ কাজে লাগাতে তৎপর বিভিন্ন দেশ। পাশাপাশি আমাদের তরুণেরা। মেধাবী অনেক ছাত্রছাত্রী দেশ ছাড়ছেন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে। এটাকে আটকানো যাবে না। আমরা তাঁদের ধরে রাখার মতো অর্থনীতি ও সমাজ এখনো গড়ে তুলতে পারিনি। এসব বিবেচনায় মার্কিন ভিসা অন্যান্য দেশের তুলনায় মোটামুটি সহজই বলা চলে। আর ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় তো এসব হাজার হাজার ভাগ্যান্বেষী আসার কথা নয়।

যাঁরা সেখানে স্থিত হয়েছেন রক্তের বন্ধনে, সেখানে যেতে হয় তাঁদের পিতা-মাতাসহ আপনজনদের। তাঁদের ভিসার বিষয়টিও মার্কিনরা উদারতার সঙ্গেই দেখে থাকে। নিষেধাজ্ঞার আওতায় সে শ্রেণির লোক আসবে, তাদের পক্ষে আমাদের কোনো মন্তব্য নেই। তবে বিষয়টি যাতে সতর্কতার সঙ্গে বাছাই করা হয়, এদিকে যত্নবান হতে মার্কিন কর্তৃপক্ষের নিকট দাবি জানাই।

আগেই উল্লেখ করেছি, মার্কিন মুল্লুকটি অভিবাসীদের। তবে গণতন্ত্র, মানবাধিকারসহ কিছু মূল্যবোধে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী। তারা চায় অন্যরা তাই হোক। হতে পারে গণতন্ত্রের ধরন ভিন্নতর। তবে আমরাও তো একই মূল্যবোধে বিশ্বাসী।আমাদের স্বাধীনতার চেতনাও তাই। আজ সে দেশটি আমাদের রপ্তানি পণ্যের একক বৃহত্তম দেশ। প্রবাসী আয়ের প্রধান উৎস। আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে বৈদেশিক বিনিয়োগকারী। আমাদের বিশাল জনগোষ্ঠী ক্রমান্বয়ে সেখানে থিতু হচ্ছে। সূচনাকালের কিছু সমস্যা বাদ দিলে তো তাঁরা ভালোই আছেন।

আরও পড়ুন

সে দেশটির প্রধান স্থপতি স্বাধীনতার সূচনায় বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র হবে সারা পৃথিবীর সব ভাগ্যাহত মানুষের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। সেটা পরিপূর্ণতা পেয়েছে এমন হয়তো বলা যাবে না। তবে ভাগ্যের পরিবর্তন করেছেন লাখ লাখ বহিরাগত। এঁদের মাঝে আমাদেরও আছে হাজার হাজার।

আর মার্কিন ভিসার সুযোগ আমরা নিতেই থাকব। যে পথে বাধা আছে, সে পথ আমরা মাড়াব না। আর আমাদের সংবিধান ও আইনের বিপরীতে কিছুই নীতিমালা ভুক্ত হয়নি। বরং যেটুকু করেছে সেটুকু মানতে পারলে আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো হবে জোরদার। সমস্যা না থাকলে সময়ের পরিক্রমায় এ-জাতীয় নিষেধাজ্ঞাও থাকবে না।

  • আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব

    [email protected]