গুগল, টিকটক, মেটার জন্য বড় পরাজয়

বাইডেন প্রশাসন ঘোষণা করেছে, তারা চীনসহ কয়েকটি দেশে নির্দিষ্ট ধরনের উপাত্ত স্থানান্তর নিষিদ্ধ করবেছবি: রয়টার্স

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন গত বছর বিগ টেক বা বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর (গুগল, অ্যামাজন, অ্যাপল, মেটার মতো বড় বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান) প্রতিনিধিত্বকারী লবিস্ট এবং আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য–উপাত্ত থেকে লাভবান হওয়া ব্যক্তিদের খুব রাগিয়ে দিয়েছে।

আমাদের ব্যক্তিজীবনের তথ্য–উপাত্তের গোপনীয়তার সুরক্ষা, নাগরিকের অনলাইন অধিকার ও স্বাধীনতাকে নষ্ট করে দিতে পারে—এমন একটি প্রস্তাব করেছিলেন ওই লবিস্টরা। কিন্তু বাইডেন প্রশাসন সেই প্রস্তাব খারিজ করে দিয়েছিল।

সম্প্রতি আমেরিকানদের উপাত্ত সুরক্ষার বিষয়ে বাইডেনের নতুন নির্বাহী আদেশের বিস্তারিত প্রকাশিত হওয়ার পর বোঝা যাচ্ছে, এই লবিস্টদের প্রস্তাবের বিষয়ে আসলেই উদ্বিগ্ন হওয়ার উপযুক্ত কারণ ছিল।

কয়েক দশক ধরে কোনো রকমের তদারকি ও বিধিনিষেধের প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই ডেটা ব্রোকার এবং প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্মগুলো মার্কিন নাগরিকদের ব্যক্তিগত উপাত্তের অপব্যহার করে আসছে।

এ অবস্থায় বাইডেন প্রশাসন ঘোষণা করেছে, তারা চীন এবং যেসব দেশের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ আছে, সেসব দেশে নির্দিষ্ট ধরনের উপাত্ত স্থানান্তর নিষিদ্ধ করবে।

সরকার–সম্পর্কিত উপাত্ত সুরক্ষা ছাড়াও সাধারণ মার্কিন নাগরিকদের সংবেদনশীল ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষায় এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ।

বাইডেন প্রশাসনের আদেশটি সম্ভবত আরও সম্ভাব্য নীতি প্রতিক্রিয়ার অগ্রদূত হিসেবে কাজ করছে। অর্থাৎ এ ধরনের আরও পদক্ষেপ হয়তো বাইডেন প্রশাসন নিতে যাচ্ছে।

অনলাইনে যেসব কাণ্ড ঘটছে, তাতে আমেরিকানরা খুব যৌক্তিকভাবেই উদ্বিগ্ন। ব্যক্তিজীবনের গোপনীয়তা লঙ্ঘনজনিত ক্ষতির বাইরে অন্যান্য ডিজিটাল ক্ষতি নিয়ে (যেমন ভুল তথ্য ও অপতথ্য, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দ্বারা প্ররোচিত কিশোর উদ্বেগ, বর্ণবাদী উসকানি ইত্যাদি) তাঁরা দুশ্চিন্তায় থাকেন।

যে প্রযুক্তি সংস্থাগুলো আমাদের ব্যক্তিগত উপাত্ত (ব্যক্তিগত শারীরিক, আর্থিক এবং অবস্থানগত তথ্যসহ) হাতিয়ে নিয়ে অর্থকড়ি উপার্জন করে থাকে, তারা তাঁদের এই কাজকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য বছরের পর বছর ‘ফ্রি ফ্লোজ অব ডেটা’ (অবাধ উপাত্ত প্রবাহ) আর ‘ফ্রি স্পিচ’ বা বাক্‌স্বাধীনতাকে এক পাল্লায় চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

এ কারণে সেই স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী জনস্বার্থ সুরক্ষায় বাইডেন প্রশাসনের নেওয়া পদক্ষেপগুলোকে সংবাদ ওয়েবসাইটগুলোতে প্রবেশাধিকার বন্ধ করার, ইন্টারনেটকে অচল করে দেওয়ার এবং কর্তৃত্ববাদীদের ক্ষমতায়িত করার চেষ্টা হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করবে। কিন্তু এগুলো একেবারেই আজেবাজে কথা।

একজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট আমেরিকানদের গোপনীয়তা এবং জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে সর্বোচ্চ মাত্রায় সচেষ্ট হবেন—সেটাই স্বাভাবিক। তিনি নিশ্চয়ই জানেন, আমরা যে বিপুল পরিমাণ উপাত্ত উৎপাদন করি, তা কোথায় এবং কী উপায়ে প্রক্রিয়াজাত ও সংরক্ষণ করা হয় তার ওপর ব্যক্তির উপাত্ত–গোপনীয়তা ও জাতীয় নিরাপত্তা কতটা ঝুঁকিতে আছে, তা নির্ভর করে।

প্রযুক্তি সংস্থাগুলো খুব ভালো করে জানে, তাদের কাজকারবার নিয়ে যদি একটি উন্মুক্ত ও গণতান্ত্রিক বিতর্ক হয়, তাহলে ডিজিটাল সুরক্ষার বিষয়ে গ্রাহকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়বে। তাদের কর্মকাণ্ডে গ্রাহকদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হলে মুনাফার পারদ পড়তে থাকবে।

এ কারণে প্রযুক্তিশিল্পের লবিস্টরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে পাশ কাটানোর চেষ্টায় ব্যস্ত আছে। তাদের চালাকিপূর্ণ পদ্ধতিগুলোর একটি হলো, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের যে বাণিজ্য বিধানগুলো ব্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষায় রক্ষাকবচের ভূমিকা রাখে, সেই বাণিজ্য বিধানগুলোকে ভাষার মারপ্যাঁচে যতটা সম্ভব অস্পষ্ট, দুর্বোধ্য ও তমসাবৃত করে তোলা।

একজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট আমেরিকানদের গোপনীয়তা এবং জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে সর্বোচ্চ মাত্রায় সচেষ্ট হবেন—সেটাই স্বাভাবিক। তিনি নিশ্চয়ই জানেন, আমরা যে বিপুল পরিমাণ উপাত্ত উৎপাদন করি, তা কোথায় এবং কী উপায়ে প্রক্রিয়াজাত ও সংরক্ষণ করা হয় তার ওপর ব্যক্তির উপাত্ত–গোপনীয়তা ও জাতীয় নিরাপত্তা কতটা ঝুঁকিতে আছে, তা নির্ভর করে।

কিন্তু তারপরও আশ্চর্যজনকভাবে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে ‘ব্যক্তিগত তথ্যের আন্তসীমান্ত স্থানান্তরে’ যেকোনো ধরনের বিধিনিষেধ আরোপের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে চেয়েছিল।

ট্রাম্প প্রশাসনের ভাষ্য ছিল, ব্যক্তিগত তথ্য–উপাত্ত স্থানান্তর যদি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করা কোনো বিদেশি বিনিয়োগকারী কিংবা সার্ভিস প্রোভাইডার বা পরিষেবা প্রদানকারীর ব্যবসার সঙ্গে সম্পর্কিত হয়, তাহলে সে তথ্য–উপাত্ত স্থানান্তরে কোনো ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করা যাবে না।

ট্রাম্পের ওই প্রস্তাব বিশ্বব্যাপী বাস্তবায়নের উদ্দেশে্য তা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) তোলা হয়েছিল। তবে তা শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি।

আন্তসীমান্ত তথ্য আদান–প্রদান নিয়ন্ত্রণের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার প্রস্তাবটি ছিল মূলত বিগ টেক লবিস্টদের পেশ করা চারটি প্রস্তাবের মধ্যে একটি। লবিস্টরা চারটি প্রস্তাব ট্রাম্পের কর্মকর্তাদের ডব্লিউটিও-সম্পর্কিত আলোচনায় তুলতে রাজি করিয়েছিলেন।

এই প্রস্তাবের বিভ্রান্তিকর শর্তগুলো সরকারগুলোকে কিছু নীতি গ্রহণ করতে নিষেধ করে। প্রস্তাবের শর্তাবলি মার্কিন কংগ্রেসে ভোক্তা, শ্রমিক এবং ছোট ব্যবসার প্রতি বিগ টেকের অন্যায্য আচরণ ঠেকাতে দ্বিদলীয় চেষ্টাকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়।

এসব প্রস্তাব আমাদের গোপনীয়তা এবং নাগরিক অধিকার রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত মার্কিন নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকেও খাটো করে।

উপাত্ত প্রবাহের ওপর সরকারি বিধিনিষেধের ওপর নিষেধাজ্ঞাসংবলিত ট্রাম্প–যুগের নিয়মগুলো যদি আসলে ডব্লিউটিওতে কার্যকর হতো, তাহলে সেগুলো খোদ বাইডেন প্রশাসনের নিজস্ব নতুন উপাত্ত-নিরাপত্তা নীতির পথেই বাধা হয়ে দাঁড়াত।

ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন বিগ টেক বিভ্রান্তিকর চুক্তির মারপ্যাঁচে যুক্তরাষ্ট্রের তথ্য বাইরে স্থানান্তর করতে পেরেছিল।

২০২০ সালের নির্বাচনে ট্রাম্প হেরে যাওয়ার পর বিগ টেক শিল্পের লবিস্টরা এই অস্বাভাবিক নিয়মগুলো চালু রেখে নতুন আদর্শ সৃষ্টি করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক শীর্ষক বাইডেন প্রশাসনের চুক্তিতে এই ধরনের বিধি যুক্ত করা তাদের পরিকল্পনায় ছিল। কিন্তু লবিস্টদের সঙ্গে বসার বদলে বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা কংগ্রেসের সদস্যদের সঙ্গে বসেছেন।

ট্রাম্পের আমলের প্রস্তাবগুলো যে ডিজিটাল গোপনীয়তা ও নিয়ন্ত্রণ ইস্যুতে কংগ্রেস ও প্রশাসনের লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, তা বাইডেন প্রশাসন প্রমাণ করতে চেয়েছে। এর মধ্য দিয়ে বিগ টেকের বড় পরাজয় হয়েছে।

● জোসেফ ই স্টিগলিৎজ নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ