রাশিয়ায় পুতিন ও ইরানে খামেনির পতনের পরের বিপদ

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও ইরানের প্রেসিডেন্ট সাঈদ ইব্রাহীম রাইসিছবি : রয়টার্স

কখনো কখনো কোনো একটি সংবাদ ঘূর্ণিপাকের মতো হয়ে গোলমালের চেয়ে বেশি কিছু তৈরি করে বসে। দিগন্তের ওপারে কী থাকতে পারে, সে বিষয়ে ভালোভাবে না জেনেই সংবাদের সেই ঘূর্ণাবর্ত উচ্চ নিনাদে অদ্ভুত সব সংকেত দিতে থাকে।

অধিকতর আশাব্যঞ্জক, অধিকতর বিপজ্জনক ও অধিকতর ভিন্ন ধরনের ভূরাজনৈতিক অস্থিরতাপূর্ণ ঘটনার সুবাদে এ ধরনের একটি ব্যাপার এ মাসেই ঘটে গেছে। আক্ষরিক অর্থে কয়েক দিনের ব্যবধানে আমরা ইউক্রেনে রাশিয়ান সেনাবাহিনীর নাকানিচুবানি খাওয়া এবং ইরানের শহরগুলোর রাস্তায় রাস্তায় সেখানকার কর্তৃত্ববাদী শাসনের জন্য অপমানজনক বিক্ষোভ প্রত্যক্ষ করেছি।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সেনারা তাঁদের নিয়ন্ত্রণে থাকা বেসামরিক নাগরিকদের নির্যাতন করেন ও তাঁদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে নিজেদের হঠাৎ করে ধেয়ে আসা উন্মত্ত জনতার চেয়ে খুব একটা উন্নততর কোনো শক্তি হিসেবে দেখাতে পারেননি।

ইউক্রেনের বাহিনী অগ্রসর হওয়ার পর তাঁরা দখল করা এলাকা থেকে দ্রুত পালিয়ে গেছেন। পুতিনের পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকি শুধু এটাই দেখাচ্ছে যে স্বৈরাচারী শাসনগুলো তাদের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে চরম বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।

ইরানের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, সেখানে শাসকদের বিরুদ্ধে নাগরিকেরা বিক্ষুব্ধ হয়েছেন, সেখানে শাসনব্যবস্থার কদর্য রূপ সম্পূর্ণভাবে প্রদর্শন করা হয়েছে এবং ইসলামি প্রজাতন্ত্রের অবসানের দাবিতে কয়েক ডজন শহরে জনতা ব্যাপক বিক্ষোভ করেছে। হিজাব ঠিকমতো না পরার অভিযোগে মাসা আমিনি নামের ২২ বছর বয়সী এক তরুণীকে পুলিশ আটক করার পর কারা হেফাজতে তাঁর মৃত্যু হওয়াকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় বিক্ষোভ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লেও এই ক্ষোভের আসল জ্বালানি ছিল কয়েক দশকের দমন-পীড়ন ও দুর্নীতি এবং দেশটির ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতি।

এ কারণে আগামী বছরগুলোতে এই শাসনের পতনের মধ্য দিয়ে যে গণতান্ত্রিক জয় আসবে, তা দ্রুত মস্কো ও তেহরানে একটি ভয়ংকর রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি করবে এবং সম্ভবত আরও উগ্রবাদী শক্তির উত্থানের সুযোগ তৈরি করবে। অত্যাচারের অবসান-উত্তর এই বিশৃঙ্খল পরিবেশে শৃঙ্খলার খোঁজ করাটা তখন প্রাধান্য পাবে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ইতিমধ্যে ইউরোপীয় এবং প্রকৃতপক্ষে বৈশ্বিক ভূরাজনীতির আদলকেই বদলে দিয়েছে। কিন্তু পুতিনের শাসনের পরিসমাপ্তি অনেক বেশি অগণনীয় পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যাবে। যেমন পুতিনের পতনের পর রাশিয়ান ফেডারেশন আপনা-আপনিই ভেঙে যেতে পারে এবং তার ধারাবাহিকতায় ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন পূর্ব দিকে প্রসারিত হতে পারে।

একইভাবে ইরানের ধর্মীয় নেতাদের শাসনের পতন পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে বদলে দেবে। সেটি কার্যত কয়েক দশকের পুরোনো সুন্নি-শিয়া সাম্প্রদায়িক যুদ্ধের অবসান ঘটাবে এবং ইসরায়েল ও রক্ষণশীল আরব রাষ্ট্রগুলোর কৌশলগত অবস্থানকে ব্যাপকভাবে উন্নত করবে। এমনকি ইরাকও স্থিতিশীল হবে আর লেবানন এবং সিরিয়ার স্থিতিশীলতার যে উন্নতি হবে, তা বলাই বাহুল্য।

রাশিয়া বা ইরানের সরকার আরও কয়েক বছর ঝুলে থাকতে পারত। কিন্তু এই মাসের ঘটনাবলিতে তাদের আশু অবসানের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। কারণ, পুতিন ইউক্রেনে জিততে পারবেন না, এমনকি এই লড়াইয়ে ড্রও করতে পারবেন না; অন্যদিকে ইরানে ধর্মীয় নেতারা তাঁদের জনগণের একটি বড় অংশের মধ্যে ঘৃণিত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। অবস্থাটি এমন, তাঁদের পতন এখনই যদি না-ও হয়, তাহলে ঠিক কখন হতে যাচ্ছে, সে প্রশ্নটিকে যৌক্তিক করে তুলেছে।

আমরা এমন একটি বিশ্বে বাস করছি, যেখানে কোনো একটি সামরিক বাহিনীর পরাজয়ের খবর বা একটি সরকারবিরোধী বিক্ষোভের খবর তাৎক্ষণিকভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে পারে। সে অবস্থায় পুতিন ও ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলী খামেনির মতো নেতারা স্বস্তিতে ঘুমাতে পারেন না। পুতিন ও খামেনির শাসনব্যবস্থাগুলোর সামনে বাস্তবিকই কোনো ভবিষ্যৎ নেই, আবার তাঁদের প্রতিস্থাপনের কোনো সুস্পষ্ট ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কার্যকর বিকল্পও নেই। সেখানেই ভূরাজনৈতিক বিপদ নিহিত।

যখন কোনো রাষ্ট্রে গণতন্ত্র সফল হয়, তখনো সেই রাষ্ট্রের যে রাজ্য বা অঞ্চলগুলো ঐতিহ্যগতভাবে গণতন্ত্রের সঙ্গে পরিচিত নয়, সেখানে রাতারাতি গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। সেসব জায়গায় বছরের পর বছর অশান্তি ঘটতে থাকে।

১৯৯০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়ায় রাজনৈতিক রূপান্তর সংঘটনের সময় অপরাধ ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায় এবং সংস্কারের ক্ষেত্রে চরম অব্যবস্থাপনা দেখা দেয়। এই সময়ে ৭০ শতাংশ রুশ নাগরিককে দারিদ্র্যসীমার নিচে নিয়ে আসে। অকার্যকর গণতন্ত্রের এই বিপর্যয় থেকেই শেষ পর্যন্ত পুতিনের আবির্ভাব ঘটে।

আরও পড়ুন

তবে ইরানকে ১৯৭৯ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময় অপেক্ষাকৃত কম বেদনা ভোগ করতে হয়েছে। কারণ, সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা কখনোই ধর্মীয় নেতাদের লক্ষ্য ছিল না। এর বদলে তাঁরা দ্রুত শাহের স্বৈরাচারের স্থলে মৌলবাদী স্বৈরতন্ত্রকে স্থলাভিষিক্ত করেন।

কিন্তু সেই ধর্মীয় নেতারা ইরানের সমাজকে এতটাই ধ্বংস করেছেন যে তাঁদের সরিয়ে নতুন ধরনের কোনো শাসন প্রতিষ্ঠা করলেও তখন ইরানকে শাসনযোগ্য রাখা সম্ভব না-ও হতে পারে—এমনকি দেশটি তখন বিভিন্ন জাতিগত ও ভৌগোলিক লাইনে ভেঙে যেতে পারে।

এ কারণে আগামী বছরগুলোতে এই শাসনের পতনের মধ্য দিয়ে যে গণতান্ত্রিক জয় আসবে, তা দ্রুত মস্কো ও তেহরানে একটি ভয়ংকর রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি করবে এবং সম্ভবত আরও উগ্রবাদী শক্তির উত্থানের সুযোগ তৈরি করবে। অত্যাচারের অবসান-উত্তর এই বিশৃঙ্খল পরিবেশে শৃঙ্খলার খোঁজ করাটা তখন প্রাধান্য পাবে। বুদ্ধিজীবী ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে আগে স্বৈরাচারের যে ভয় ছিল, সেই জায়গা নৈরাজ্যের ভয় দখল করে নেবে। স্বৈরাচারের পতন গণতন্ত্রের কার্যকারিতাকে তখন আরও কঠিন করে তুলবে।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

  • রবার্ট ডি কাপলান আন্তর্জাতিক সংস্থা ফরেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের জিওপলিটিকসের চেয়ারম্যান