সাকিবের ক্যাপ কেন ‘ব্যাট’ হলো?

বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামে ইংল্যান্ডকে প্রথম টি-টোয়েন্টিতে হারানোর পর সাকিব গিয়েছিলেন একটা অনুষ্ঠানে। সেখানে তাঁর ক্যাপ ছিনিয়ে নিয়ে এক ভক্ত পালিয়ে যেতে চান।
ছবি: সংগৃহীত

সাকিব আরও একবার আলোচনায়। দুদিন আগে চট্টগ্রামে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশকে ওয়ানডে জেতালেন। কাল তাঁর নেতৃত্বে টি-টোয়েন্টি দল জিতল সিরিজের প্রথম ম্যাচ। টি-টোয়েন্টির অধিনায়ক সাকিবের এখন আলোচনায় থাকারই কথা। কিন্তু গত রাত থেকে সাকিব যে কারণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পর্দায় ভাসছেন, সেটি আরও একবার মাঠের বাইরের ঘটনা নিয়েই।

মূল বিষয়ে যাওয়ার আগে সপ্তাহখানেক আগের একটা কথা বলি। সেদিন এক আড্ডায় সাকিব বলেছিলেন, ‘আমি এখন আর কোনো কিছুতেই বিরক্ত হই না, রাগ করি না। সব স্বাভাবিকভাবে নেই। মনে হয়, রেগে আর কী হবে!’

এর মাত্রই কয়দিনের মধ্যে সেই সাকিব প্রকাশ্যে মাথার ক্যাপটাকে রীতিমতো ব্যাট বানিয়ে কারো ওপর চড়াও হচ্ছেন, এমন একটা ভিডিও দেখে আমার অবাক হওয়াই উচিত। সাকিব না এখন কোনো কিছুতেই রাগেন না, বিরক্ত হন না। তাহলে এটা কী!
না, আমি এতে অবাক হইনি। বরং কীভাবে এক হাতে ওয়ানডে ম্যাচ জেতাতে হয়, কীভাবে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের আগ্রাসী মানসিকতা দলের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হয়—   মাঠে এসব দেখানোর পর মাঠের বাইরে কীভাবে ‘টানা পার্টিকে’ শায়েস্তা করতে হয়, সাকিব সেটিও দেখানোয় আমার কেন যেন ভালোই লেগেছে।

বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামে ইংল্যান্ডকে প্রথম টি-টোয়েন্টিতে হারানোর পর সাকিব গিয়েছিলেন একটা অনুষ্ঠানে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখলাম, সেখান থেকে বের হওয়ার সময় ভক্ত-সমর্থকদের প্রচণ্ড ভিড়। সাকিব কোনোরকমে জনস্রোত ঠেলে গাড়ির দিকে এগোচ্ছেন। এর মধ্যেই এক সুযোগসন্ধানী ‘ভক্ত’ সাকিবের মাথার ক্যাপটা ছোঁ মেরে নিয়ে যায়। কাল ম্যাচে হাত থেকে একটা ক্যাচ পড়লেও ক্যাপ ছিনিয়ে নেওয়া লোকটাকে ধরে ফেলতে সাকিবের কোনো সমস্যাই হয়নি। নিজের ক্যাপটা কেড়ে নিয়ে সেটা দিয়েই বেদম ‘ব্যাটিং’ চালালেন তার ওপর।

তারকারাও যে মানুষ সেটি আমরা প্রায়ই ভুলে যাই। আমরা মনে করি তারা সর্বংসহা। তাঁদেরকে যা ইচ্ছা তা-ই বলা যাবে, একবার কাছে পেলে তাঁদের সঙ্গে যা ইচ্ছা তাই করা যাবে। বেশির ভাগ সময় মানুষ সেরকম করেও যাচ্ছে। তারকাদের কাছে পেলেই কিছু মানুষের সেলফি তোলার নেশা পেয়ে বসে। ছবি, লাইভ ভিডিও কিছুই বাদ যায় না। কেউ কেউ তো ছবির পোজ ঠিক করতে ‘ভাই একটু হাসেন। ডানে ঘোরেন, বামে ঘোরেনও’ করতে থাকেন।

আসলে তারকারাও যে মানুষ সেটি আমরা প্রায়ই ভুলে যাই। আমরা মনে করি তারা সর্বংসহা। তাঁদেরকে যা ইচ্ছা তা-ই বলা যাবে, একবার কাছে পেলে তাঁদের সঙ্গে যা ইচ্ছা তাই করা যাবে। বেশির ভাগ সময় মানুষ সেরকম করেও যাচ্ছে। তারকাদের কাছে পেলেই কিছু মানুষের সেলফি তোলার নেশা পেয়ে বসে। ছবি, লাইভ ভিডিও কিছুই বাদ যায় না। কেউ কেউ তো ছবির পোজ ঠিক করতে ‘ভাই একটু হাসেন। ডানে ঘোরেন, বামে ঘোরেনও’ করতে থাকেন।

কেউ একবারের জন্য ভাবতেও চান না, তাঁদের প্রত্যেকের সঙ্গে একটা করে ছবি তুললেও ওই তারকাকে এক দাঁড়ানোয় কয়েকশ ছবি তুলতে হয়। সাম্প্রতিক কয়েকটি অনুষ্ঠানে সাকিবসহ কয়েকজন তারকা ক্রিকেটারকে দেখেছি কতটা বিরক্তি আর সমস্যার মধ্যেও তাঁরা বেশির ভাগ সময় চেষ্টা করেছেন হাসিমুখে ভক্তদের খুশি করতে।

দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া এসব ক্ষেত্রে তারকাদের দিক থেকে প্রতিবাদ হয় কমই। কারণ বিরক্তি প্রকাশ করা মানেই নেতিবাচক খবরের বিষয় হয়ে ওঠা। উল্টো সমালোচনার মুখে পড়া। ফেসবুকে ট্রলের শিকার হওয়া। এর চেয়ে মুখ বুজে সব সহ্য করে যাওয়াই ভালো।

কখনো কখনো ধৈর্যের সে সীমাও ছাড়িয়ে যায় বলেই সাকিব চট্টগ্রামে ক্যাপ হাতে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন, মিরপুরে আশরাফুল কাউকে চড় মেরে বসেন, দক্ষিণ আফ্রিকায় মুশফিক ফুঁসে ওঠেন। ধৈর্য হারিয়ে তারা যখন পাল্টা কিছু করেন বা বলেন, তখনই মানুষ জানে এ রকম কিছু ঘটেছে। নইলে বাইরে বেরোলে বা কোনো অনুষ্ঠানে গেলে যেরকম অসহ্য ‘আবদার’ ক্রিকেটারদের মেটাতে হয়, অনেক সময় যেরকম মুখের ওপর কটু মন্তব্য হজম করে আসতে হয়; সেই খবর আমরা কয়জন রাখি!

খ্যাতির বিড়ম্বনা বলে একটা কথা তো আছেই। আপনি যত বিখ্যাত হবেন, যত জনপ্রিয় হবেন, যত আপনার ভক্ত বাড়বে; ততই আপনাকে তাঁদের আবদারও মেটাতে হবে। সেলফির ফ্রেমে হাসিমুখ দিতে হবে। অদ্ভুত সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। এমনকি কেউ কোনো বাজে মন্তব্য করলেও এমন ভাব করতে হবে যেন কথাটা কানেই যায়নি। এসবই তারকা হওয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। তারকা হলে বিরক্তি প্রকাশ না করে সব মেনে নিতে হবে বলেই আমরা ধরে নেই।

কিন্তু কাঁহাতক! বেশির ভাগ সময় তারকারা এসব মেনে নেন বলেই সাকিবের ক্যাপ দিয়ে পেটানোর মতো ঘটনা নিয়মিত ঘটে না। বেশির ভাগ সময় তাঁরা এসব মেনে নেন বলেই এ নিয়ে খবরও হয় না। কারণ ভক্তের যন্ত্রণা মেনে নেওয়াটা খবর নয়। ভক্তের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ কেউ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেই খবর। খবর মানেই তো যা স্বাভাবিক নয়, তা।
চট্টগ্রামে সাকিবও সে কারণেই ক্যাপটাকে ব্যাট বানিয়ে খবর হয়েছেন। তাঁর ক্যাপ হাতে কারো ওপর চড়াও হওয়ার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে।

সেটি অনেকের কাছ দৃষ্টিকটু মনে হতেই পারে। তা ছাড়া একটা আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে সে রাতেই কেন সাকিবকে শো-রুম উদ্বোধন করতে যেতে হবে? সিরিজ তো এখনো শেষ হয়নি! গেলেও সাকিবের নিশ্চিত হওয়া উচিত ছিল সেখানে তাঁর জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে কি না।

এই সব অগ্রাহ্য করে তিনি যখন সেখানে গেছেনই, কেউ তাঁর ক্যাপ টেনে নিলেও সেটার জবাবে সাকিবের মতো তারকা পাল্টা আক্রমণ করতে পারেন কি না, সেটিও প্রশ্ন। ‘হিট অব দ্য মোমেন্টে’ ওরকম একটা ঘটনা ঘটিয়ে কাল রাতে সাকিবেরও ভালো ঘুম হয়েছে বলে মনে হয় না।

এই ঘটনার অন্তর্নিহিত বার্তাটাও সে কারণেই নিতে হবে—তারকারাও মানুষ। রেগে গেলে তাঁরাও হিতাহিতজ্ঞান শূন্য হয়ে পড়তে পারেন। আমরা সাধারণ মানুষ যেমন তাঁদের কাছে তারকাসুলভ আচরণ আশা করি, আমাদের আচরণও বোধ হয় তারকাদের সঙ্গে মানুষের মতোই হওয়া উচিত।

  • তারেক মাহমুদ প্রথম আলোর ক্রীড়া সম্পাদক