বৃহস্পতিবার সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ আয়োজিত ‘গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য সংলাপ: সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান’ শীর্ষক আলোচনা সভায় রাষ্ট্রকাঠামোকে কীভাবে গণতান্ত্রিক করা যায়, সেসব নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হয়। এই সংলাপে রাজনীতিক, অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ছাড়াও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুজন প্রতিনিধি অংশ নেন।
সংলাপে সাংবিধানিক ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান যেমন নির্বাচন কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন নিয়ে আলোচনা হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের গ্রহণযোগ্যতা প্রায় শূন্যের কোঠায়। অনেকের মতে, বাংলাদেশে তো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানই গড়ে ওঠেনি। তাহলে গণতন্ত্র কাজ করবে কীভাবে? এর পাল্টা যুক্তি হলো গণতন্ত্র কাজ করেনি বলেই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দাঁড়ায়নি। আমরা গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করি, জয়ী হই, কিন্তু গণতন্ত্র অধরাই থেকে যায়।
অতীতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে দলবাজ ও অযোগ্য লোকদের নিয়োগ দেওয়ায় অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। এসব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রধানসহ বিভিন্ন পদে সাবেক আমলাদের বসানো হয়েছে, যাঁরা ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছা পূরণের কাজে ব্যস্ত থেকেছেন। এই ধারার পরিবর্তনের কথা বলেছেন প্রায় সব বক্তা। কাজটি কীভাবে হবে?
আমাদের মনে থাকার কথা, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, দুদক বা তথ্য কমিশন কোনো সরকার স্বেচ্ছায় দেয়নি। এ জন্য নাগরিক সমাজকে আন্দোলন করতে হয়েছে। উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকেও চাপ ছিল।
বাংলাদেশে একটা মানবাধিকার কমিশন আছে, অথচ সরকারের দমন–পীড়ন, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের বিষয়ে বরাবর নীরব থেকেছে। তাহলে জনগণের করের অর্থে এই প্রতিষ্ঠান রাখার যুক্তি কী? একসময় দুর্নীতি দমন ব্যুরো ছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত। স্বাভাবিকভাবেই সেই সংস্থা মন্ত্রী-এমপি ও আমলাদের দুর্নীতি তদন্ত করত না। এ কারণে স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন হলো। তারাও ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতি-লুটপাট সম্পর্কে চোখ বুজে থাকল।
অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সংস্কারে অনেক কমিশন গঠন করলেও সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। সংবিধান সংস্কার কমিশন চার মূল নীতি বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করেছে। সংবিধানের চার মূলনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী রাজনৈতিক বাস্তবতায়। আওয়ামী লীগ সরকার মূল নীতির কোনোটি মানেনি, এর অর্থ এই নয় যে এগুলোর গুরুত্ব নেই।
এখন যেমন বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র ও নয়া উদারতাবাদের জয়জয়কার, ১৯৭২ সালে সংবিধান রচনার সময় সমাজতন্ত্রের পক্ষেই প্রবল জনমত ছিল। ইংরেজি সেক্যুলারিজম শব্দের অর্থ ইহজাগতিকতা। আমরা যদি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র না চাই, মূল নীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা থাকতে আপত্তির কারণ থাকতে পারে না। বাংলাদেশ যদি রাষ্ট্রধর্ম রেখে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেয়, বিশ্বের কাছে ভুল বার্তা যাবে। তবে স্বীকার করি, ১৯৭২ সালে আওয়ামী লীগ জাতীয়তাবাদের নামে একদেশিকতার পরিচয় দিয়েছিল। তারা বাঙালি ছাড়া অন্য কোনো জনগোষ্ঠীকে স্বীকার করেনি। আওয়ামী লীগ জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্রতি যে বৈষম্যমূলক নীতি নিয়েছিল, চব্বিশের ছাত্র গণ–অভ্যুত্থানের ফসল অন্তর্বর্তী সরকার ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি একই নীতি বহাল রাখবে, সেটা মেনে নেওয়া যায় না। ইতিমধ্যে পাঠ্যবই থেকে আদিবাসী শব্দযুক্ত গ্রাফিতি মুছে দেওয়া হয়েছে। কাউকে বাদ দিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র হয় না।
আওয়ামী লীগ আমলে তিনটি নির্বাচন কমিশন সার্চ কমিটির মাধ্যমে গঠিত হলেও ফলাফল শূন্য। তারা জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত না করে ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছা পূরণ করেছে, যদিও আমলা হিসেবে তাদের কারও কারও সুখ্যাতি ছিল। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন রাজনৈতিক ঐকমত্য ও নাগরিক সমাজের মতামতের ভিত্তিতে যোগ্য ও সুনামসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে।
অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় সব কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আনতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ভারসাম্য নিশ্চিত করতে একটি জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। এনসিসির সদস্য হবেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, নিম্নকক্ষের স্পিকার, উচ্চকক্ষের স্পিকার, বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি, বিরোধী দল মনোনীত নিম্নকক্ষের ডেপুটি স্পিকার, বিরোধী দল মনোনীত উচ্চকক্ষের ডেপুটি স্পিকার, প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেতার প্রতিনিধিত্বকারী সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের উভয় কক্ষের সদস্যরা ব্যতীত, আইনসভার উভয় কক্ষের বাকি সব সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে তঁাদের মধ্য থেকে মনোনীত একজন সদস্য।
কথা হলো, যে সংসদকে কেন্দ্র করে এই কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে, সেই সংসদ কার্যকর হবে কি না। সংসদ নেতা ও বিরোধী দলের নেতা কোনো বিষয়ে একমত হতে পারবেন কি না। বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীন চারটি ভালো নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু সেসব নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ তো কার্যকর থাকেনি। সরকারি দল সবকিছু দখল করার মানসিকতা পোষণ করেছে। আর বিরোধী দল সংসদ বর্জন করে রাজপথে হরতাল–অবরোধের মাধ্যমে নিজের রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণ করতে চেয়েছে। শেখ হাসিনার আমলের শেষ তিনটি সংসদে তো কার্যকর বিরোধী দলই ছিল না।
যেকোনো আধুনিক রাষ্ট্রের তিন স্তম্ভ—আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে স্পষ্ট বিভাজনরেখা টানতে হবে। অন্যের কাজে হস্তক্ষেপ করবে না, নির্বাহী বিভাগ থেকে এই নিশ্চয়তা থাকতে হবে। যদি জাতীয় সংসদ কার্যকর করা যায়, তাহলে এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ যেমন জাতীয় সংসদের মাধ্যমে কিংবা জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের মাধ্যমেও হতে পারে। সবার আগে প্রয়োজন জাতীয় সংসদকে কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করানো। এই কাজ আমরা গত ৫৩ বছরে করতে পারিনি।
ইতিমধ্যে যেসব আভাস পাওয়া যাচ্ছে, তাতে মনে হয় না এসব প্রতিষ্ঠান জাতীয় সংসদের কাছে জবাবদিহি করতে প্রস্তুত। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন প্রস্তাব দিয়েছিল, সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে এবং শপথ ভঙ্গ করলে কমিশনারদের মেয়াদ পরবর্তী সময়ে উত্থাপিত অভিযোগ প্রস্তাবিত সংসদীয় কমিটি তদন্ত করে সুপারিশসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাতে পারবে। তবে এ ক্ষেত্রে তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনেরও সুযোগ দেওয়া হবে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার এম এম নাসির উদ্দীন বিষয়টি ভালোভাবে নেননি। তিনি বলেছেন, স্থায়ী কমিটির কাছে নির্ভরশীল হতে চাই না। এ–সংক্রান্ত সুপারিশ বাতিল করতে হবে। পার্লামেন্টারি স্ট্যান্ডিং কমিটির মুখাপেক্ষী হলে ইসির ক্ষমতা খর্ব করা হবে।
আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে যাঁরাই আসেন, তাঁরা ক্ষমতা চান কিন্তু জবাবদিহি করতে রাজি নন। যদি প্রধানমন্ত্রী সংসদের কাছে দায়বদ্ধ থাকেন, নির্বাচন কমিশনের তো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। নতুন নির্বাচন কমিশন যদি তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী একটি ‘উত্তম নির্বাচন’ দেশবাসীকে উপহার দেয়, তাহলে সংসদীয় কমিটির কাছে জবাবদিহি করতে আপত্তি কেন?
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি