সংবিধান, ভাষা এবং আরও কিছু প্রশ্ন

সংবিধান শব্দটি উচ্চারিত হওয়ামাত্রই কল্পনায় উদ্ভাসিত হয়, এ যেন কোনো প্রত্নপ্রতীক, যার পরিবর্তন-পরিমার্জন ইত্যাদি অচিন্তনীয়। আদতে সংবিধান কোনো প্রত্নপ্রতীক বা আর্কিটাইপ নয়। কখনো কখনো প্রতীক মানে এমন একটি বাস্তব দৃশ্যমান চিহ্ন বা ইমেজ, যা ওই ইমেজকেন্দ্রিক চিন্তাসীমা অতিক্রম করে আরও বিস্তৃত কোনো চিন্তার স্মারক হয়ে ওঠে।

আমেরিকান লেখক জোসেফ ক্যাম্পবেলের মতে, প্রতীকের ভেতর থাকে শক্তির উৎসারণ ও নির্দেশনের ক্ষমতা। সেদিক থেকে দেখতে গেলে ‘শাপলা ফুল’ কিংবা ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’ চিত্রচিহ্নের গণ্ডি ছাড়িয়ে প্রতীকে উত্তীর্ণ হতে পেরেছে। কিন্তু সংবিধান কি নিরবয়বের গণ্ডি ছেড়ে জনমানুষের চিন্তাসীমায় পৌঁছাতে পেরেছে?

বাঙালির জাতির বয়স যদিও সাল গণনা করে বলা যাবে না, কিন্তু দিনক্ষণ মেনে কার্যকর হওয়ায় বলা যায়, আমাদের সংবিধানের বয়স এখন বায়ান্নতে। বাংলা যদিও ভাষা হিসেবে বেশ প্রাচীন, এর সাহিত্যও বেশ পুরোনো, কিন্তু ১৯৭২ সালের আগে নিজ ভাষায় প্রণীত নিজ দেশের জন্য কোনো সংবিধান ছিল না (দেশ ছিল না বলেই)।

বিশ্বের সপ্তম বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ভাষা বাংলা। তারপরও আমাদের প্রচলিত অনেক আইন এখনো ইংরেজিতেই। ‘উচ্চতর আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার সমস্যা ও সমাধান’ শিরোনামের প্রবন্ধে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান লেখেন, আমাদের আইন পেশার প্রধান চারটি বই ‘ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোড ১৯৮৯’, ‘পেনাল কোড ১৮৬০’, ‘সিভিল প্রসিডিউর কোড ১৯০৮’ ও ‘এভিডেন্স অ্যাক্ট ১৮৭২’। এগুলো আইনের কোনোটিই সরকারিভাবে বঙ্গানুবাদ হয়নি। সেই বিবেচনয় সীমিত সক্ষমতা নিয়ে স্বাধীনতার প্রথম বছরেই বাংলায় সংবিধান প্রণয়ন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসাধারণ এক পদক্ষেপ। চোখধাঁধানো সব পরিকাঠামোর গরিমার চেয়েও নিজ ভাষায় নিজদের প্রণীত সংবিধান বেশ গৌরবের।

দ্য আর্ট অব রেকনিং, অর্থাৎ ভেবেচিন্তে ফলাফল নির্ণয়ের কৌশল হচ্ছে বার্ট্রান্ড রাসেলের বিখ্যাত ‘দ্য আর্ট অব ফিলোসোফাইজিং’ বইয়ের একটা আলোচিত বিষয়, যেটির ফলিত প্রকাশ আমরা দেখতে পাই বঙ্গবন্ধুর জীবনজুড়ে এবং এর চূড়া স্পর্শ করে বাংলার জন্য বাংলা ভাষায় প্রথম শাসনতন্ত্র প্রণয়নের মধ্য দিয়ে। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে বিরোধী দলে থেকে, অল্প সময়ে পাকিস্তান সরকারের অংশ ছিলেন।

সংবিধান প্রণয়ন করতে বিশেষ কমিটি গঠন ও যৌক্তিক দ্রুততায় তা পাস করা—এসব সিদ্ধান্তই রাসেলের সেই পরিভাষাকে এ বাংলায় রূপান্তর হতে দেখা যায়, যেখানে সময়ে সময়ে বঙ্গবন্ধুও নানা মত ও পরামর্শ দিয়েছেন; যেহেতু সরকারে ভেতর-বাহির দুই-ই তাঁর দেখা।

সংবিধান রচনাকালীন গণপরিষদে এবং গণপরিষদের বাইরে নাগরিক পরিসরে সংবিধান বিষয়ে যে আলোচনা, পরামর্শ ও বিতর্কগুলো তৈরি হয়েছিল, তার পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিতর্ক ও সংশোধনী প্রস্তাবগুলোর পরিণতি বিশ্লেষণ এখনো প্রাসঙ্গিক। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অনেক লেখক ও গবেষকই গণপরিষদ সদস্যরা ঠিক কী ধরনের রাষ্ট্রকাঠামো নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন, তা উদ্‌ঘাটন করতে চেয়েছেন। গত ৫২ বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে তাঁদের ওই সময়ের প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টির মূল্যায়ন করার সুযোগ পেয়েছেন অনেক তাত্ত্বিক।

প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংবিধানই শাসক আর শাসিতের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ন্ত্রক। একটি জাতির নৈতিক জীবনের জন্য একটি টেকসই ভিত অন্বেষণের ইচ্ছা, জাতিসত্তার বিকাশের পথ ও সামাজিক সম্পর্কের সূত্র সন্ধান এবং তার সাংবিধানিক যথার্থতা পরীক্ষা করে দেখার ইচ্ছা থেকে আমরা সংবিধান নিয়ে চিন্তা করতে আগ্রহী হই। এ চিন্তাই নতুন নির্মাণের পথনির্দেশক। নির্দেশক হিসেবে দায়িত্বশীলেরা যেন শাস্ত্রজ্ঞানের বিস্তার ঘটান প্রয়োগকলায়।

১৯৭২ সালে বাংলাদেশে যে গণপরিষদ গঠন করা হয় ১৯৭০ সালে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিজয়ীদের নিয়ে, এর দুই খণ্ডের কার্যবিবরণী ও খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে সংবিধান প্রণয়নের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। এসব দলিল–সাক্ষ্যের সঙ্গে ১৯৭২ সালের সংবিধান মিলিয়ে পড়লে এটি স্পষ্ট যে আমাদের আদি সংবিধানপ্রণেতারা রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছিলেন সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ওপর, অন্য দুটি মূলনীতি ছিল জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা। সাংবিধানিক এই যাত্রা অর্ধেকেরও বেশি শতাব্দী ধরে সংবিধানের বিবর্তনের পথে বিবিধ সম্ভাবনা ও গতিরেখার আবির্ভাব ও অন্তর্ধানের এক রোমাঞ্চকর যাত্রা যেন।

সংবিধানের আদি ইতিহাস বলে বিশ্বের প্রথম কনস্টিটিউশন বা সংবিধানের প্রচলন ঘটেছিল ইরাকে। ১৯৭৭ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক আর্নেস্ট ডি সারজে ইরাকে কাজ করার সময়ে দেখতে পান যে খ্রিষ্টজন্মের ২ হাজার ৩০০ বছর আগে সুমেরিয়ান সভ্যতার সময়ে লাগাশের রাজা উরুকাগিনা ন্যায়বিচার-সম্পর্কিত একটি কোড বা আইনবিধির সংকলন জারি করেছিলেন। সুপ্রাচীন এ দলিল যদিও এখনো আবিষ্কৃত হয়নি, তবে এটা জানা যায়, এ আইনের বলে সাধারণ নাগরিকেরা কিছু অধিকার পেয়েছিল। আরও জানা যায়, বিধবা ও অনাথদের কর মওকুফ করা হতো এবং সুদের কারবারি ধনীদের কাছ থেকে বিত্তহীন নাগরিকদের রক্ষা করা হতো।

সুমেরিয়ান সভ্যতায় নাগরিকদের অধিকার রক্ষার জন্য লিখিত কোড করেছিল সরকার। আরও ছিল উর-নাম্মু, লিপিট-ইশতার, হামুরাবির কোড, হিটাইট কোড, অ্যাশিরিয়ান কোড ও মোজেইক আইন। এরপর খ্রিষ্টপূর্ব ৫৯৪ সালে সোলোনিয়ান কনস্টিটিউশন জারি করা হয় গ্রিসে। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০ সালে গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল সর্বপ্রথম সাধারণ আইন ও সাংবিধানিক আইনের পার্থক্য নিশ্চিত করেন।

সংবিধানসংক্রান্ত তত্ত্বচিন্তা এবং সংবিধান মেনে দেশ পরিচালনার বিষয়ে অ্যারিস্টটল রচনা করেন ‘কনস্টিটিউশন অব এথেন্স, পলিটিকস অ্যান্ড নিকোমেচিয়ান এথিকস’। শুধু এথেন্সেই নয়, অ্যারিস্টটল স্পার্টা, কার্থেজের সংবিধান বিষয়েও লেখেন। সংবিধানের সরল মানে বলতে অ্যারিস্টটল বোঝান রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংগঠন বা দপ্তর পরিচালনার নীতি। সংবিধানকে সাধারণভাবে তিনি দুই ভাগে ভাগ করেন—ভালো ও মন্দ। গ্রিক সভ্যতার পর রোমান সভ্যতা। রোমানরা খ্রিষ্টপূর্ব ৪৫০ সালে ‘টুয়েলভ টেবলস’ নামে প্রথম তাদের সংবিধানকে বিধিবদ্ধ করে। এর কিছু পরে ভারতের মৌর্য সম্রাট অশোক খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে সাংবিধানিক নীতিমালা লিপিবদ্ধ করেন। আর আধুনিক সময়ে মাগনাকার্টা হচ্ছে সাম্প্রতিক নজির।

সংবিধানে অনুচ্ছেদে অনুচ্ছেদে বিষয়বস্তুর গভীরতা ভাষার দুরূহতা বা অবোধ্যতা, এখানে অবোধ্যতা বাধা নয়, বরং একধরনের অ্যাডভেঞ্চার, যদি দক্ষ ক্যাপ্টেনের মতো নিপুণ ব্যাখ্যাকারী থাকে। প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংবিধানই শাসক আর শাসিতের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ন্ত্রক। একটি জাতির নৈতিক জীবনের জন্য একটি টেকসই ভিত অন্বেষণের ইচ্ছা, জাতিসত্তার বিকাশের পথ ও সামাজিক সম্পর্কের সূত্র সন্ধান এবং তার সাংবিধানিক যথার্থতা পরীক্ষা করে দেখার ইচ্ছা থেকে আমরা সংবিধান নিয়ে চিন্তা করতে আগ্রহী হই। এ চিন্তাই নতুন নির্মাণের পথনির্দেশক। নির্দেশক হিসেবে দায়িত্বশীলেরা যেন শাস্ত্রজ্ঞানের বিস্তার ঘটান প্রয়োগকলায়।

  • এম এম খালেকুজ্জামান আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট