বাধ্যতামূলক অবসর: সরকারের ইচ্ছাই কি ‘জনস্বার্থ’

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার সম্প্রতি পুলিশ ও প্রশাসনের বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে। সরকারের এ সিদ্ধান্ত ও এর উদ্দেশ্য নিয়ে নানা রকম প্রশ্ন উঠেছে। সিদ্ধান্তটি ‘বেআইনি’ না হলেও, আইনের যে ধারা অনুযায়ী তা বাস্তবায়ন করা হয়েছে, সেখানেই ‘অস্পষ্টতা’ রয়েছে।

গত ৩১ অক্টোবর পুলিশের দুই কর্মকর্তাকে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই অবসরে পাঠানো হয়। অবসরে পাঠানো দুই কর্মকর্তা হলেন ঢাকায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের অতিরিক্ত উপপুলিশ মহাপরিদর্শক মো. আলমগীর আলম ও ঢাকা ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত উপপুলিশ মহাপরিদর্শক মো. মাহবুব হাকিম। এর আগে গত ১৮ অক্টোবর পুলিশ সুপার (এসপি) পদমর্যাদার তিন কর্মকর্তাকে অবসরে পাঠায় সরকার। তাঁরা হলেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) মীর্জা আবদুল্লাহেল বাকী ও মো. দেলোয়ার হোসেন মিঞা এবং পুলিশ সদর দপ্তরের এসপি (টিআর) মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চৌধুরী। এরও আগে ১৬ অক্টোবর চাকরির নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তথ্য ও সম্প্রচারসচিব মো. মকবুল হোসেনকে অবসরে পাঠায় সরকার।

নির্বাচনে পুলিশ, প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকায় তাদের কাজে লাগিয়ে বিশেষ সুবিধা নেওয়ার ইচ্ছা ক্ষমতাসীনদের থাকতেই পারে। এ রকম অবস্থায় সরকারের পক্ষ থেকে পুলিশে, প্রশাসনে শুধু ‘নিজেদের লোক’ বসানো নয়, সন্দেহভাজন ভিন্নমতাবলম্বীদের সরিয়ে দেওয়ারও তৎপরতা শুরু হয়েছে কি না, সেই প্রশ্নও সামনে এসেছে

এই ছয় কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদানের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া প্রজ্ঞাপনে সরকারি চাকরি আইনের (২০১৮ সালের ৫৭ নম্বর আইন) ৪৫ ধারা এবং ‘জনস্বার্থের’ কথা উল্লেখ করা হয়। ৪৫ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো সরকারি কর্মচারীর চাকরির মেয়াদ ২৫ (পঁচিশ) বৎসর পূর্ণ হইবার পর যেকোনো সময় সরকার, জনস্বার্থে, প্রয়োজনীয় মনে করিলে কোনোরূপ কারণ না দর্শাইয়া তাহাকে চাকরি হইতে অবসর প্রদান করিতে পারিবে: তবে শর্ত থাকে যে, যে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ, সেই ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন গ্রহণ করিতে হইবে।’

ধারাটিতে উল্লেখিত ‘জনস্বার্থ’ শব্দটির কোনো সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা এই আইনে দেওয়া হয়নি। এতে ‘জনস্বার্থ’ বলতে আসলে কী বোঝানো হয়েছে, তা নিয়ে ‘অস্পষ্টতা’ তৈরি হয়েছে। তার চেয়ে বড় কথা, সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা না থাকায় এই আইন ব্যবহার করে সরকার রাজনৈতিক বা দলীয় স্বার্থকে ‘জনস্বার্থ’ হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে। এই ছয় সরকারি কর্মকর্তার বাধ্যতামূলক অবসরের ক্ষেত্রে এমনটা হয়েছে কি না, এমন প্রশ্ন ওঠাটা তাই অসংগত নয়।

সরকারি চাকরি আইন ২০১৮ কার্যকর হওয়ার আগে বিভিন্ন সময় রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে জারিকৃত বিধিমালা দ্বারা সরকারি কর্মচারীদের নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, অবসর ইত্যাদি বিষয় নিয়ন্ত্রিত হতো। সেই বিধিমালাতেও ২০১৮ সালের সরকারি চাকরি আইনের ৪৫ নম্বর ধারার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ ধারা অর্থাৎ চাকরির বয়স ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ার পর ‘জনস্বার্থে’ বাধ্যতামূলক অবসরদানের বিষয়টি ছিল। এর ফলে বিভিন্ন সরকারের আমলেই ‘অপছন্দের’ বা ‘ভিন্নমতাবলম্বী’ সরকারি কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদানের ঘটনা ঘটেছে। তাঁদের মধ্যে কোনো কোনো কর্মকর্তা উচ্চ আদালতে মামলা করে তাঁদের চাকরি ফেরত পেয়েছেন। আবার যাঁদের চাকরিতে ফেরত যাওয়ার বয়স পেরিয়ে গিয়েছিল, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ ভূতাপেক্ষ সুযোগ-সুবিধা নিয়ে অবসরে গেছেন। এ রকম একটি মামলায় (ডা. নুরুল ইসলাম বনাম বাংলাদেশ) সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পর্যবেক্ষণ ছিল, কোনো ‘নীতি’ বা ‘নির্দেশনা’ ছাড়া জনস্বার্থের কথা বলে কাউকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কেননা এটা বৈষম্যমূলক এবং সব নাগরিকের সমান অধিকারের নীতির পরিপন্থী।

সংবিধানের ২৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’ ২৯(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকবে।’ সংবিধানের এই দুটি অনুচ্ছেদ বিবেচনায় নিলে ২০১৮ সাল থেকে কার্যকর হওয়া সরকারি চাকরি আইনের ৪৫ ধারাটিও সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং এই কারণে তা বাতিলযোগ্যও।

একটা বিষয় লক্ষণীয় যে তথ্যসচিবকে নিয়ে সরকারের তরফ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া না গেলেও পুলিশ কর্মকর্তাদের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান তাঁদের ‘দেশপ্রেম ও দক্ষতায় ঘাটতি’ থাকার কথা জানান (৩ নভেম্বর, প্রথম আলো)। পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে অভিযোগগুলোর কথা জানিয়েছেন, তা গুরুতর, কিন্তু প্রমাণসাপেক্ষ। কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে শৃঙ্খলাবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া উচিত। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সেগুলোর কোনো তোয়াক্কা না করে যথেচ্ছভাবে সরকারি চাকরি আইনের ৪৫ ধারা ব্যবহার করা হয়েছে।

সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ, পদোন্নতি বা বদলির অভিযোগ নতুন নয় এবং কোনো কোনো অভিযোগের সত্যতাও পাওয়া গেছে। বিশেষ করে কয়েক বছর ধরে পুলিশ ও প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে ‘নিজেদের লোক’ বসানোর একটা প্রবণতা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের তরফ থেকে লক্ষ করা গেছে। বিভিন্ন সময় দলীয় অনুষ্ঠানে মন্ত্রী-উপদেষ্টারা এগুলো নিয়ে বেফাঁস মন্তব্যও করেছেন।

আরও পড়ুন

বর্তমান বাংলাদেশ একটি দ্বিধাবিভক্ত রাজনীতির দেশ এবং নির্বাচন সামনে রেখে এই দ্বিধাবিভক্তি আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা রয়েছে। নির্বাচনে পুলিশ, প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকায় তাদের কাজে লাগিয়ে বিশেষ সুবিধা নেওয়ার ইচ্ছা ক্ষমতাসীনদের থাকতেই পারে। এ রকম অবস্থায় সরকারের পক্ষ থেকে পুলিশে, প্রশাসনে শুধু ‘নিজেদের লোক’ বসানো নয়, সন্দেহভাজন ভিন্নমতাবলম্বীদের সরিয়ে দেওয়ারও তৎপরতা শুরু হয়েছে কি না, সেই প্রশ্নও সামনে এসেছে। সরকারি চাকরি আইনে ‘জনস্বার্থের’ কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা বা নীতিমালা না থাকায় আইনের এই ধারা তাই সরকারের উদ্দেশ্য পূরণের ‘হাতিয়ার’ হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে।

মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক