সিংহলি, তামিল ও মুসলিমদের ঐক্য ধরে রাখার পরীক্ষা এখন

এবার পদত্যাগের দাবির মুখে নতুন প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে। গতকাল কলম্বোয় স্বাস্থ্যকর্মীদের বিক্ষোভ
ছবি: এএফপি

গণবিক্ষোভে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে এবং প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষের পদত্যাগের মধ্য দিয়ে শ্রীলঙ্কায় গণতন্ত্রের জয় হয়েছে। গোতাবায়া এমন একজন শক্তিশালী ব্যক্তি, যিনি ২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের অবসানে ভূমিকা রাখার জন্য জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন (ওই সময় তাঁর বড় ভাই মাহিন্দা প্রেসিডেন্ট ছিলেন)। গোতাবায়া ২০১৯ সারের নভেম্বরে নির্বাচিত হয়ে জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষা এবং সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন; কিন্তু তিনি তা পূরণে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হন।

দুর্নীতি, যুদ্ধাপরাধ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও রাজাপক্ষে সরকারের জোরালো জনসমর্থন ছিল, যার ফলে তাঁদের দল শ্রীলঙ্কা পডুজানা পেরামুনা (শ্রীলঙ্কা পিপলস ফ্রন্ট) পার্লামেন্টে দুই-তৃতীয়াংশ আসন পেয়ে জয়লাভ করেছিল। তবে অল্প কিছুদিনের মধ্যে রাজাপক্ষেরা দেশকে দেউলিয়াত্ব, খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা এবং ব্যাপক মূল্যস্ফীতির দিকে নিয়ে যান।

গোতাবায়া ২০১৯ সালে ইস্টার সানডেতে বোমা হামলার কয়েক দিন পরেই সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিক্রিয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁর প্রার্থিতা ঘোষণা করেছিলেন। পরবর্তী মাসগুলোতে, সংবাদপত্র এবং রেডিও স্টেশনগুলোর উন্মত্ত উসকানিমূলক খবর পরিবেশনা মুসলমানদের (যারা দেশটির মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ) সম্পর্কে মানুষের ভয় বাড়িয়ে তোলে এবং মুসলমানদের ওপর আক্রমণ বেড়ে যায়।

গোতাবায়া এই পরিবেশকে পুঁজি করে নিজেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি-বৌদ্ধদের এমন একজন রক্ষক হিসেবে চিত্রিত করেন, যিনি শ্রীলঙ্কাকে ভারত মহাসাগরে একটি ‘সিঙ্গাপুরে’ রূপান্তরিত করতে সক্ষম। ধর্মযাজক, মিডিয়া, সামরিক নেতৃত্ব, রাজনৈতিক অভিজাত এবং স্থানীয় ধনকুবের সবাই তাঁদের ভাগ্যকে গোতাবায়ার নিয়তির সঙ্গে বেঁধে এই ভাষ্যটিকেই আরও জোরালোভাবে দাঁড় করিয়েছিলেন।

উদাহরণস্বরূপ, বৌদ্ধ ধর্মযাজকেরা গোতাবায়ার প্রেসিডেন্ট পদে থাকার পুরো সময়জুড়ে তাঁর ওপর আস্থা রাখার বিষয়টি পুনর্নিশ্চিত করেছিলেন। বিনিময়ে গোতাবায়া তাঁর নীতিগত সিদ্ধান্তগুলো পরিচালনায় সাহায্য করার জন্য উল্লেখযোগ্য ভিক্ষুদের সমন্বয়ে একটি বৌদ্ধ উপদেষ্টা পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এমনকি চলতি বছরের জানুয়ারিতে পরিবারগুলো যখন খাদ্যসংকটের মুখে পড়ে রেশনের লাইনে দাঁড়াতে শুরু করে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি আন্তর্জাতিক বন্ডের অর্থ পরিশোধ করতে তার অবশিষ্ট সোনার মজুত বিক্রি করে দেয়, তখনো বৌদ্ধ সংস্থা গোতাবায়ার পক্ষে কথা বলেছিল এবং যুক্তি দিয়েছিল, গোতাবায়াই একমাত্র নেতা, যিনি এখনো দেশটিকে বাঁচাতে পারেন।

দুর্নীতি, কর্তৃত্ববাদ এবং সহিংসতার সুবিদিত রেকর্ড থাকার পরও রাজাপক্ষেদের সমর্থন দেওয়া হয়েছিল। যখন রাজাপক্ষে পরিবার জনসাধারণের তহবিল চুরি করছিল বা সংখ্যালঘুদের অধিকারকে পদদলিত করছিল, তখন কিন্তু কোনো প্রতিবাদ হয়নি। প্রতিবাদ হয়েছে তখন, যখন শুধু খাবারের দাবিতে আন্দোলন করায় সিংহলিদের ‘চরমপন্থী এবং সন্ত্রাসী’ বলা হয়েছিল।

মার্চের মধ্যে হাসপাতালগুলো প্রয়োজনীয় ওষুধের ঘাটতির কথা জানাতে শুরু করল এবং পেট্রলের জন্য লাইনে দাঁড়ানো অবস্থায় দুজন বয়স্ক ব্যক্তি মারা গেলেন। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানির অর্থ প্রদানে অক্ষম সরকার এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং চালু করে। যার কারণে শ্বাসরুদ্ধকর তাপপ্রবাহের মধ্যেও সর্বোচ্চ ১৩ ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন অবস্থায় মানুষকে থাকতে হয়। এটাই ছিল জনগণের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙার শেষ স্তর। এরপরই বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় নেমে আসেন এবং রাজাপক্ষের পদত্যাগ দাবি করেন। বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের আশপাশের এলাকা দখল করার পর তঁাদের শান্ত করতে রাজনৈতিক শ্রেণি মন্ত্রিসভার মধ্যে মিউজিক্যাল চেয়ারের মতো চেয়ার অদলবদল শুরু করে।

রাজাপক্ষে একেকটি এলাকাকে ‘আন্দোলন এলাকা’ হিসেবে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিলেন। জনগণের সমাবেশের স্বাধীনতা সীমিত করার জন্য তাঁর ওই পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করা হয়েছিল। তখন ওই আন্দোলনের নাম পরিবর্তন করে ‘গোতাগোগামা’ (‘গোতা গ্রামে চলে যাও’) রাখা হয়েছিল। ‘গোতাগোগামা’ শিরোনামের এই আন্দোলন সরকারবিরোধী ‘আরাগালিয়া’ (সিংহলি এই শব্দের অর্থ ‘জনতার সংগ্রাম’)-এর কেন্দ্র হয়ে ওঠে। এরপরই অভিযান চালিয়ে প্রতিবাদী নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

আরাগালিয়া এই দিক থেকে অস্বাভাবিক ছিল যে এটি সব ধরনের জাতিভিত্তিক শ্রীলঙ্কানদের স্বাগত জানিয়েছে। এপ্রিল মাসে, প্রেসিডেন্ট সচিবালয়ের বাইরে বিক্ষোভকারীদের মধ্যে মুসলিম সম্প্রদায়ের কর্মীরাও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। বিক্ষোভকারীরা তামিলবিরোধী যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে মারা যাওয়া তামিল বেসামরিক নাগরিকদের স্মরণে পানি এবং চালের গুঁড়ার মিশ্রণ (কাঞ্জি) রান্না করে খেয়েছিলেন। গৃহযুদ্ধের ওই সময়ে নির্বিচার গোলাবর্ষণের কারণে মৃত্যুর আগে সেই তামিলদের পক্ষে কাঞ্জি ছাড়া অন্য খাবার জোগাড় করা সম্ভব হয়নি।

এভাবে আরাগালিয়া এমন একটি অবস্থানে চলে আসে, যেটিকে লোকেরা রাজাপক্ষের রাজনীতির বিকল্প হিসেবে ভাবতে শুরু করে। বিক্ষোভকারীরা বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য উদ্‌যাপন করতে শুরু করে। এটি এই চেতনা প্রদর্শন করে যে সুদিনের আশা নেতাদের কাছ থেকে নয়, বরং জনগণের শক্তি থেকে আসে। কিন্তু এই সংহতি কি শুধু নিজেদের সুবিধার জন্য এক ছাতার নিচে আসার বিষয়টিকে প্রতিফলিত করে? মাত্র আড়াই বছর আগে বর্তমান সরকারবিরোধী অনেক বিক্ষোভকারী রাজাপক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনীতির ধরনকে সমর্থন করেছিলেন। আজ তাঁদের অভিযোগ, পার্লামেন্ট প্রতারক ও মিথ্যাবাদীতে ভরে গেছে। তারপরও তারাই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে তোষামোদকারীদেরই ভোট দিয়েছে।

দুর্নীতি, কর্তৃত্ববাদ এবং সহিংসতার সুবিদিত রেকর্ড থাকার পরও রাজাপক্ষেদের সমর্থন দেওয়া হয়েছিল। যখন রাজাপক্ষে পরিবার জনসাধারণের তহবিল চুরি করছিল বা সংখ্যালঘুদের অধিকারকে পদদলিত করছিল, তখন কিন্তু কোনো প্রতিবাদ হয়নি। প্রতিবাদ হয়েছে তখন, যখন শুধু খাবারের দাবিতে আন্দোলন করায় সিংহলিদের ‘চরমপন্থী এবং সন্ত্রাসী’ বলা হয়েছিল।

আরও পড়ুন

যে প্রতিষ্ঠানগুলো গোতাবায়ার ক্ষমতাকে সংহত করেছিল, সেগুলো এখন বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। যে ব্যবসায়িক শ্রেণি ও অন্যান্য ক্ষেত্রের ক্ষমতাবানেরা রাজাপক্ষেদের সঙ্গে জোটবদ্ধ ছিল, তঁাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছি ছি করা হচ্ছে এবং যে অভিজাত বৌদ্ধ ধর্মযাজকই প্রতিবাদ বিক্ষোভে হাজির হওয়ার সাহস করছেন, তাঁদের নিন্দা করা হচ্ছে। সেনাবাহিনী এবং পুলিশ একসময় তঁাদের পরিষেবার জন্য প্রশংসিত হলেও এখন তাঁদের রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের বাহিনী হিসেবে দেখা হচ্ছে। সংখ্যালঘুবিরোধী মনোভাব উসকে দেওয়ার জন্য প্রধান মিডিয়া সংস্থাগুলোকে নিন্দা করা হয়েছে।

এখন প্রশ্ন হলো উদ্ভূত শূন্যতা পূরণ হবে কী দিয়ে। মর্যাদার এই সংগ্রামের ভিত্তিতে একটি নতুন পরিচয় গড়ে তোলার বিরল সুযোগ রয়েছে শ্রীলঙ্কানদের। পুলিশের টিয়ার গ্যাস ও লাঠিপেটার শিকার হওয়ার পর সিংহলি বিক্ষোভকারীরা তামিলদের প্রতি চালানো সহিংসতা ও দুর্ব্যবহারের বিষয় কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পেরেছে। বিদ্যুতের অভাবে নিজেদের ব্যবসা ভেঙে পড়তে দেখার পর তারা এখন বুঝতে পেরেছে, বিক্ষুব্ধ জনতা মুসলমানদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো পুড়িয়ে দেওয়ার পরপর ভুক্তভোগীদের মধ্যে কী নিদারুণ দহন হয়েছিল। ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব তীব্রভাবে অনুভব করার পর এখন সচ্ছল সিংহলিরা স্বীকার করছেন, বৃক্ষরোপণের কাজে নিয়োজিত জনজাতির কর্মীরা দৈনিক তিন ডলার আয়ে সংসার চালাতে পারে না। প্রতিটি ক্ষেত্রে সিংহলি-বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠদের মধ্যে বাস করা সংখ্যালঘুদের কয়েক দশক ধরে বঞ্চনার শিকার করা হয়েছে। সিংহল বৌদ্ধরা তাদের অভ্যন্তরীণ তামিল এবং মুসলমানদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করছে।

কিন্তু শুধু এই পরস্পরের ভাগ করে নেওয়া আঘাতের ওপর ভিত্তি করে শ্রীলঙ্কানরা রাজাপক্ষেদের বিরুদ্ধে অসন্তোষকে একটি নতুন সামাজিক বোঝাপড়ায় রূপান্তরিত করতে পারে। আমাদের সাম্প্রদায়িক বন্ধন এবং সম্পর্কের পুনর্বিবেচনার মাধ্যমে আমরা একটি নতুন সম্মিলিত পরিচয় তৈরি করতে পারি। এর অর্থ হলো সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ এবং দুর্নীতিকে প্রত্যাখ্যান করে একটি মুক্ত ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য আমাদের যৌথ সংগ্রামকে আলিঙ্গন করার সময় এসেছে। এই সময়টিকে আমাদের কাজে লাগাতে হবে।

সত্ত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

প্রিয়াঙ্কা কৃষ্ণমূর্তি শ্রীলঙ্কার অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাবেক গবেষণা বিশ্লেষক