ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: যেখানে এখনো অন্ধকার কাটেনি

ইলেকট্রনিক বর্জ্য বা ই-বর্জ্য বলতে পরিত্যক্ত বৈদ্যুতিক বা ইলেকট্রনিক সরঞ্জামাদিকে বোঝায়

২০১০ সালে বাংলাদেশে এক গবেষণায় দেখা যায়, ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত থাকার কারণে ১৫ শতাংশের বেশি শিশু মারা যায় এবং ৮৩ শতাংশের বেশি শিশু বিষাক্ত পদার্থের সংস্পর্শে এসে অসুস্থ হয়ে পড়ে। সে সময়ের হিসাবমতে, ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা শিল্পে কাজ করত প্রায় ৫০ হাজার শিশু। সবচেয়ে বেশি ই-বর্জ্য উৎপাদিত হতো জাহাজভাঙা শিল্প থেকে। এরপর তালিকায় ছিল যথাক্রমে টেলিভিশন, কম্পিউটার ও মোবাইল ফোন। (ই-বর্জ্য: বাংলাদেশের অবস্থা, ইএসডিও, ২০১০)।

ইলেকট্রনিক বর্জ্য বা ই-বর্জ্য বলতে পরিত্যক্ত বৈদ্যুতিক বা ইলেকট্রনিক সরঞ্জামাদিকে বোঝায়। ই-বর্জ্যের মধ্যে সিসা-পারদের মতো অস্বাস্থ্যকর বিষাক্ত পদার্থ যেমন থাকে, তেমনি আবার কিছু পরিমাণে থাকে সোনা-রুপার মতো মূল্যবান ধাতব পদার্থ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ই-বর্জ্য পুনর্ব্যবহার (রিসাইক্লিং) প্রক্রিয়ায় সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করা না হলে, সেটি প্রক্রিয়ায় যুক্ত মানুষের গর্ভাবস্থা, শৈশব ও কৈশোরকালে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশকে ব্যাহত করতে পারে, ফুসফুসের গঠনগত বিকাশ এবং কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করতে পারে।

শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বেই বাড়ছে ই-বর্জ্যের পরিমাণ। বৈশ্বিক ই-ওয়েস্ট মনিটর প্রতিবেদন ২০২৪ অনুযায়ী, ২০২২ সালে সারা বিশ্বে ৬২ মিলিয়ন টন ই-বর্জ্য তৈরি হয়েছে, যেটি পরিবহন করতে প্রায় সোয়া কোটি সংখ্যক ট্রাকের প্রয়োজন হবে

২০১০ সালের পর বাংলাদেশের যে ডিজিটাল রূপান্তর, তার ফলে কী পরিমাণ ইলেকট্রনিক পণ্য এ দেশের বাজারে প্রবেশ করেছে, সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদন এবং সেটির ব্যবহার। এইচএসবিসি বৈশ্বিক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের নবম বৃহত্তম ভোক্তা বাজারে পরিণত হবে, যেটির বড় একটি অংশ হবে ইলেকট্রনিক পণ্য। বিটিআরসির হিসাব অনুযায়ী, দেশে মুঠোফোন গ্রাহকের সংখ্যা ১৯ কোটি ১৩ লাখ। নষ্ট হওয়ার আগে একটি সেটের মেয়াদকাল দুই থেকে তিন বছর ধরলেও, কয়েক কোটি মুঠোফোন ডিভাইস প্রতিবছর যুক্ত হচ্ছে দেশের ই-বর্জ্যের ভান্ডারে। এর সঙ্গে সঙ্গে কম্পিউটার, টিভি, ফ্রিজ, এসি, মাইক্রোওয়েভসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় ইলেকট্রনিক সামগ্রী তো রয়েছেই।

বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তরের অর্থায়নে, পরিবেশ ও সম্পদ ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র এবং বুয়েট কর্তৃক পরিচালিত ২০১৮ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০১৬ ও ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ই-বর্জ্যের আনুমানিক পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ১০ হাজার মিলিয়ন টন ও ৪ লাখ টন। এর মধ্যে প্রতিবছর মাত্র ১৩ হাজার ৩০০ টন ই-বর্জ্য রিসাইক্লিং ব্যবসায় প্রবেশ করে। প্রতিবছর উৎপাদন বৃদ্ধির হার প্রায় ২০ শতাংশ, যেটি ২০৩৫ সালে গিয়ে পৌঁছাবে ৪৬ লাখ ২০ হাজার টনে।

শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বেই বাড়ছে ই-বর্জ্যের পরিমাণ। বৈশ্বিক ই-ওয়েস্ট মনিটর প্রতিবেদন ২০২৪ অনুযায়ী, ২০২২ সালে সারা বিশ্বে ৬২ মিলিয়ন টন ই-বর্জ্য তৈরি হয়েছে, যেটি পরিবহন করতে প্রায় সোয়া এক কোটি সংখ্যক ট্রাকের প্রয়োজন হবে। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ ই-বর্জ্য উৎপাদনকারী (বছরে ৩ লাখ ৫০ হাজার টন) দেশ হওয়া সত্ত্বেও এখানে গুটি কয়েক লাইসেন্সপ্রাপ্ত ই-বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ প্রতিষ্ঠান আছে, যাদের কর্মপদ্ধতিও আবার অনিরাপদ ও দূষণ সৃষ্টিকারী।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিভিন্ন উৎস থেকে ক্রমাগত দাবি জানানোর প্রায় ১০ বছর পর বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ২০২১ সালে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা জারি করে। এই বিধি অনুযায়ী, ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোর নিবন্ধনের নিয়ম রাখার পাশাপাশি ২০২২ সালের মধ্যে ১০ শতাংশ এবং ২০২৬ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ ই-বর্জ্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, এ অগ্রগতি সত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকার নিয়মগুলো বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়নি।

রিসাইক্লিংয়ের জন্য বাংলাদেশে যে মুষ্টিমেয় উদ্যোক্তা কাজ করছেন, তাঁদের প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হচ্ছে লাইসেন্সবিহীন অননুমোদিত প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে। অননুমোদিত প্রতিষ্ঠানগুলোর দেশ ও দেশের বাইরে বিস্তৃত নেটওয়ার্ক থাকায় ই-বর্জ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের তুলনায় অনেক বেশি দাম দিতে সক্ষম।

২০২৩ সালের ২ জানুয়ারি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১১ সালে যাত্রা শুরু করা একটি প্রতিষ্ঠান, ই-বর্জ্য থেকে মূল্যবান সামগ্রী পুনরুদ্ধার করে, জাপান, কাতারের মতো দেশে রপ্তানি করে বছরে প্রায় ৩০ কোটি আয় করছে। প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো ই-বর্জ্যের একটি ক্ষুদ্র অংশ সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়। কারণ, অননুমোদিত স্ক্র্যাপ ব্যবসায়ীরা ব্যবসার সবচেয়ে বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে এবং তারা সরাসরি চীনে স্ক্র্যাপ রপ্তানি করে।

সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী, ১ টন পরিমাণ র‍্যাম (মেমোরি কার্ড) ও পিসিবি (মাদারবোর্ড) থেকে প্রায় ৬০০ গ্রাম সোনা, সাড়ে ৭ কেজি রুপা, ১৩৬ কেজি তামা ও ২৪ কেজি টিন পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। যেটির বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৫০ লাখ টাকা। ২০৩০ সালের মধ্যেই এ খাতে বছরে ১ বিলিয়ন ডলারের শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব।

আমাদের বিধিমালা থাকলেও সেটির শিথিল প্রয়োগ এ সম্ভাবনাময় খাত বিকশিত হচ্ছে না। অনুমোদনপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষার দায়িত্ব অনুমোদনদানকারী কর্তৃপক্ষের। ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় যে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির দিক রয়েছে, সেটি বিবেচনায় নিলে অনিরাপদ ও অনুমোদনবিহীন উদ্যোগগুলোকে অচিরেই লাইসেন্সের আওতায় আনতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে সেগুলোর ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য সরকারের বিভিন্ন ধরনের সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি নিরাপত্তা মান নিশ্চিত করতে হবে। ধারণা করা কঠিন নয় যে একটি নির্দিষ্ট মান বজায় না রাখলে ইলেকট্রনিক পণ্য ও সংশ্লিষ্ট কাঁচামাল আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে অদূর ভবিষ্যতেই আমাদের বাধার সম্মুখীন হতে হবে।

● বি এম মইনুল হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও পরিচালক

[email protected]