‘মেড ইন বাংলাদেশ’ পণ্য যে ধীরে ধীরে বিশ্ববাজারে স্থান করে নিয়েছে, তার পেছনে যেমন রয়েছে আমাদের স্থানীয় উদ্যোক্তাদের উদ্যমী ভূমিকা, অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অভিনব ও প্রয়োজনীয় অর্থায়ন কাঠামো, তেমনি রয়েছে শ্রমিকের ঘাম-শ্রম আর ক্রেতাদের আন্তর্জাতিক নিয়মকানুনের প্রতি সংবেদনশীলতা।
আমরা জানি, রপ্তানি বাণিজ্য অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের অন্যতম উৎস। যেকোনো বিকাশমান দেশের জন্যই বৈদেশিক মুদ্রায় আয় সক্ষমতা বৃদ্ধি সমৃদ্ধি বাড়ায়। ইদানীং বৈশ্বিক নানা বাধা ও অভ্যন্তরীণ সংকটের কারণে আমাদের রপ্তানি প্রবৃদ্ধিতে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) থেকে প্রকাশিত হালনাগাদ তথ্য বলছে, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের অক্টোবরে দেশ থেকে ৩৮২ কোটি ৩৯ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। যেখানে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের একই মাসে ৪১৩ কোটি ৮ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। সে হিসাবে গত মাসে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় রপ্তানি কমেছে ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ।
এর আগে আগস্ট ও সেপ্টেম্বরেও রপ্তানি কমেছে। আগস্টে রপ্তানি কমার হার ছিল ২ দশমিক ৯৩ শতাংশ আর সেপ্টেম্বরে কমেছিল ৪ দশমিক ৬১ শতাংশ। রপ্তানি আয়ের ধারাবাহিক এ নেতিবাচক চিত্র অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করছে বলেই ধরে নেওয়া যায়।
রপ্তানির পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের আরেক অন্যতম উৎস প্রবাসী আয়। এ দুই উৎস দেশের বৈদেশিক মুদ্রা মজুতের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করে। রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স যত বাড়ে, ততই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ে। ফলে দেশের আমদানি ব্যয় মেটানো, ঋণ পরিশোধ ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা সহজ হয়। তা ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যত শক্তিশালী হয়, ততই দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা উন্নত হয়।
ফলে টেকসই উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও মুদ্রাবাজারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা সহজ হয়। কিন্তু তিন মাস ধরে ধারাবাহিকভাবে রপ্তানি আয় কমায় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব দৃশ্যমান হবে বলে ধরে নেওয়া যায়। রপ্তানি আয় হ্রাস পাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার প্রভাব কমবে ও দেশের রিজার্ভে চাপ সৃষ্টি করবে। এতে ডলার-সংকট দেখা দেবে। আমদানি ব্যয় মেটানো, ঋণ পরিশোধ ও মুদ্রার স্থিতিশীলতা বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা হুমকিতে পড়বে।
ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গেল অক্টোবরে তৈরি পোশাক, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, হিমায়িত চিংড়ি, প্লাস্টিক পণ্যের রপ্তানি কমেছে। তবে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল, চামড়াবিহীন জুতা ও প্রকৌশল পণ্যের রপ্তানি বেড়েছে।
ব্যাংক খাতে সুদের হার আর এলসি-সংক্রান্ত যেসব সমস্যা বিদ্যমান, সেগুলো দ্রুত নিরসনে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেওয়াও জরুরি। নতুন পণ্য আর নতুন বাজার তৈরির উদ্যোগেও ভাটা পড়লে হবে না। তেমনি বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার আর তারল্য ব্যবস্থাপনায়ও দেখাতে হবে মুনশিয়ানা।
মূলত তৈরি পোশাকের রপ্তানি ৮ শতাংশ কমে যাওয়ায় সামগ্রিক পণ্য রপ্তানি নেতিবাচক ধারায় চলে গেছে। তৈরি পোশাকের রপ্তানি কমে যাওয়ার পেছনে আগামী ফেব্রুয়ারির সম্ভাব্য নির্বাচন ঘিরে বা নির্বাচনকালীন অস্থিরতার আশঙ্কায় ক্রেতারা ক্রয়াদেশ কমিয়ে দিয়েছেন বলেও মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। দুর্দশাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোর সংকটের কারণে ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি খুলতে পারছেন না অনেকেই।
দেশের রপ্তানি খাতের প্রধান পণ্য তৈরি পোশাক, যা মোট রপ্তানির ৮০ শতাংশের বেশি। ফলে এ পণ্যের রপ্তানির গতিপ্রকৃতি সার্বিক রপ্তানিতে প্রভাব ফেলে। সামগ্রিক রপ্তানিতে পোশাক রপ্তানি কমার প্রভাব বিদ্যমান। যদিও দেশের সর্বোচ্চ রপ্তানি আয় অর্জনকারী পোশাক খাতকে আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের কারণে দেশের পোশাক খাত নানা চাপে রয়েছে। পাশাপাশি পণ্য বৈচিত্র্যকরণ ও নতুন বাজার অনুসন্ধানে আমরা পিছিয়ে পড়ছি। অথচ অন্যান্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে বহুমুখী উদ্যোগের মাধ্যমে রপ্তানি সম্প্রসারণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই।
রপ্তানি খাতকে বৈচিত্র্যময় ও প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য সরকারকে নীতিসহায়তা প্রদানের পাশাপাশি আমাদের অন্যান্য প্রতিবন্ধকতাও দূর করতে উদ্যোগী হতে হবে। কয়েকটি পণ্য ঘিরে নির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠতে হবে। পোশাক খাতের ওপর অতিনির্ভরতা কমিয়ে আনতে সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি। আয় বাড়াতে নির্দিষ্ট কিছু দেশের সঙ্গে রপ্তানি বাণিজ্য সীমাবদ্ধ রাখাটা কোনোভাবেই সুবিবেচনাপ্রসূত নয়। রপ্তানির জন্য অপ্রচলিত পণ্য খুঁজে বের করার পাশাপাশি রপ্তানি গন্তব্যের নতুন নতুন দেশ অনুসন্ধান করার দিকটিতে অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের অতিরিক্ত শুল্কের প্রভাবে তৈরি পোশাক খাতে একধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে, যা গোটা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এ ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যময় পণ্য রপ্তানি ঝুঁকি অনেকটাই কমিয়ে দেবে। একইভাবে অপ্রচলিত নতুন পণ্যের বাজার সৃষ্টি রপ্তানি আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশীয় শিল্পের বিকাশ ঘটাবে। রপ্তানি বহুমুখীকরণকে একক বা বিচ্ছিন্নভাবে না দেখে শিল্পনীতি, আমদানিনীতি, আর্থিক নীতি ও অন্যান্য নীতির সামঞ্জস্য রাখা জরুরি। নীতিসহায়তা ও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব।
শুধু তৈরি পোশাক খাতেই নয়, শিল্পের মূলধনি যন্ত্রপাতি, মধ্যবর্তী পণ্য ও কাঁচামাল আমদানির এলসি নিষ্পত্তিও কমেছে। অর্থাৎ শিল্প খাতের অন্যান্য ক্ষেত্রেও নতুন বিনিয়োগ বা সম্প্রসারণ কার্যক্রমে ধীরগতি দেখা দিয়েছে। মূলধনি যন্ত্রপাতির এলসি নিষ্পত্তির হার কমে যাওয়ার অর্থ নতুন কারখানা স্থাপন বা পুরোনো কারখানার আধুনিকায়ন কমেছে। ফলে শিল্প খাতে কর্মসংস্থান ও উৎপাদন উভয় ক্ষেত্রেই দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ব্যাংক জটিলতাসহ নানা কারণে শিল্প খাত বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাত স্থবির অবস্থায় রয়েছে। যদি এ প্রবণতা অব্যাহত থাকে, তাহলে রপ্তানি আয়, কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ—সবকিছুই আরও চাপে পড়বে।
বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির অবস্থা আরও হতাশাজনক। দেশের বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি এখন দুই দশকের বেশি সময়ের মধ্যে কম। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি বছরের জুনেই দেশের বেসরকারি খাতে ব্যাংকঋণের প্রবৃদ্ধি ইতিহাসের সর্বনিম্নে নেমে এসেছিল। আর জুলাই ও আগস্টে প্রবৃদ্ধি নয়, বরং বেসরকারি খাতের ঋণ স্থিতি ঋণাত্মক ধারায় চলে যায়।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ধারণা, বিগত দেড় দশকে কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়াই রাজনৈতিক প্রভাবে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। ফলে এসব ঋণের বড় অংশই এখন খেলাপির তালিকায়। এতে একাধিক ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা ব্যাপকভাবে কমেছে। কর্মসংস্থান ও উৎপাদনের মূল ভিত্তি হলো বেসরকারি খাত। অথচ এ খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি অত্যন্ত হতাশাজনক, যা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
রপ্তানি আয় হ্রাস, ঋণের উচ্চ সুদ আর ঋণপ্রবাহে স্থবিরতা ও উৎপাদন খাতের সংকট—সব মিলিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শ্লথগতি বিরাজমান। অতীত উদাহরণ আমাদের বলে, এ ধরনের সংকট সামগ্রিক অর্থনীতিকে দীর্ঘস্থায়ী মন্দার দিকে ঠেলে দিতে পারে। ইতিমধ্যে সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অনেকেই বলছেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে দ্রুত একটি গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিকল্প নেই। দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এলে অর্থনীতিতে গতিশীলতা ফিরতে পারে।
এ ছাড়া ব্যাংক খাতে সুদের হার আর এলসি-সংক্রান্ত যেসব সমস্যা বিদ্যমান, সেগুলো দ্রুত নিরসনে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেওয়াও জরুরি। নতুন পণ্য আর নতুন বাজার তৈরির উদ্যোগেও ভাটা পড়লে হবে না। তেমনি বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার আর তারল্য ব্যবস্থাপনায়ও দেখাতে হবে মুনশিয়ানা।
মামুন রশীদ : অর্থনীতি বিশ্লেষক
*মতামত লেখকের নিজস্ব
