ব্যাংক খাতে বরকতের ফজিলত

ঘনত্ব বিচারে বাংলাদেশ পৃথিবীর নবম জনবহুল দেশ, প্রতি বর্গকিলোমিটারে গড়ে ১ হাজার ৩৩৩ জন। তবে এর চেয়ে জনবহুল দেশ আছে। বিশ্বের সবচেয়ে ঘন জনবসতির দেশ ম্যাকাউয়ে বর্গকিলোমিটারে গড় জনসংখ্যা প্রায় ২০ হাজার আর মাথাপিছু জিডিপি ১ লাখ ২৫ হাজার ডলারের বেশি। মালদ্বীপে এই সংখ্যা ১ হাজার ৮০০। মাথাপিছু জিডিপি ১২ হাজার ৬৫৭ ডলার। বাংলাদেশের জিডিপি ২ হাজার ৬৬৬ ডলার। এসব দেশ অর্থনৈতিকভাবে আমাদের চেয়ে অগ্রসর। 

সম্প্রতি একটি ইংরেজি দৈনিকের প্রতিবেদনে দেশের ক্রেডিট রেটিং এজেন্সির এমন বরকতের ফজিলত দেখা গেছে। ক্রেডিট রেটিং এজেন্সিগুলো মূলত কোনো প্রতিষ্ঠানে ঋণ বা দায়শোধের সক্ষমতা নিরূপণ করে সে অনুযায়ী মূল্যায়ন করে। এই মূল্যায়নে এজেন্সিগুলো সবচেয়ে ভালো প্রতিষ্ঠানের জন্য ব্যবহার করে AAA। তার পরেরগুলো ক্রমেই নিম্নমুখী। যেমন AA, A, BBB, BB, B ইত্যাদি। সবচেয়ে খারাপ বা খেলাপি হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে ব্যবহার করা হয় D।

এই মূল্যায়ন প্রতিষ্ঠানের মতো কোনো সার্বভৌম দেশের জন্যও প্রযোজ্য। বিশ্বখ্যাত এজেন্সি স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর ও মুডিজ ২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং করে আসছে। ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশের রেটিং ছিল সব সময় B–এর ঘরে, যেমন BB-, B1, Ba3, BB। এই রেটিংয়ের সঙ্গে একটা আভাসও দেওয়া থাকে, যা প্রায় প্রতিবছরই ছিল ‘স্থিতিশীল’। কেবল ২০২৩ সালের জুলাইয়ের রেটিংয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে আভাস দেওয়া হয়েছিল ‘নেগেটিভ’।

রেটিং এজেন্সির এই বরকতের ফজিলত দেখুন। আজ যে ব্যাংকগুলোকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে, সেসব ব্যাংকের কোনো কোনোটি এসব এজেন্সির রিপোর্টে অবিশ্বাস্য ভালো রেটিং পেয়েছে। আবার অন্যদিকে ব্যাংকগুলো তাদের ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের রেটিংয়ের ওপর ভিত্তি করে সেসব প্রতিষ্ঠানের ঋণের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণের হিসাব বের করে।

সুতরাং দুর্বল প্রতিষ্ঠানকে অন্যায্যভাবে দেওয়া ভালো রেটিং দেখিয়ে ব্যাংকগুলোও ঋণঝুঁকির বিপরীতে কম মূলধন সংরক্ষণ করে নিজেদের আরও বড় ঝুঁকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। আমাদের মতো দেশে মুড়িমুড়কির মতো রেটিং পাওয়ার সুযোগ আছে বলেই অর্থবাজারের মূল ভিত্তিটা দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। 

এখানে চলে আসে বাংলাদেশের ব্যাংকের আধিক্যের কথা। বর্তমানে সরকারি, বেসরকারি, বিদেশি ও বিশেষায়িত মিলে আমাদের মোট বাণিজ্যিক ব্যাংক ৬০টি। তার মধ্যে ব্যক্তিমালিকানাধীন ৪৩টি। অথচ প্রতিবেশী বিশাল দেশ ভারতে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে এই সংখ্যা ৩৩। পাকিস্তানে বেসরকারি ব্যাংকের সংখ্যা ২০, মালয়েশিয়ায় দেশি-বিদেশি মিলিয়ে ৪৩টি।

বাংলাদেশে বেসরকারি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ইতিহাস ও কারণ বিবেচনা করলে ব্যাংক মালিকানার একটা রাজনৈতিক চরিত্র পাওয়া যায়। বেসরকারি খাতের প্রথম প্রজন্মের ব্যাংক বলে পরিচিতি পাওয়া ১০টি ব্যাংকের জন্ম ১৯৮০–এর দশকে এরশাদ সরকারের শাসনামলে। এগুলোর মধ্যে সত্যিকার অর্থে নতুন ব্যাংক ছিল ছয়টি। বাকি চারটির মধ্যে প্রকৃত মালিকদের হাতে ছেড়ে দেওয়া দুটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, বিদেশি মালিকানার একটা ও সমস্যায় পড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে ব্যাংকে রূপান্তরিত করা একটা। 

এরশাদের শাসনামলের পর বিএনপির শাসনামলে অনুমোদন পায় সাতটি ব্যাংক। এগুলো দ্বিতীয় প্রজন্মের ব্যাংক বলে পরিচিত। এর মধ্যে একটি বহুজাতিক ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান বিসিসিআই বন্ধ হয়ে গেলে যাত্রা শুরু করে দেশি বেসরকারি ব্যাংক হিসেবে।

১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মোট ১৩টি ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়। এর মধ্যে একটা ছিল সমস্যায় পড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে রূপান্তরিত বাণিজ্যিক ব্যাংক। এগুলো তৃতীয় প্রজন্মের ব্যাংক হিসেবে পরিচিত। ২০০১ সালে আবার শুরু হওয়া বিএনপি আমলে নতুন কোনো ব্যাংক লাইসেন্স পায়নি।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। সেই আমলে ২০১৩ সালে একই বছরে অনুমোদন পায় ৯টি ব্যাংক। এগুলো চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংক। তারপর ২০১৬ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে আবারও চারটি ব্যাংক খোলার অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। ১৯৯৬ সাল থেকে বিভিন্ন মেয়াদে আওয়ামী লীগের পরবর্তী ২০ বছরের শাসনামলে মোট ২৬টি ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়।

রাজনৈতিক বিবেচনায় লাইসেন্স দেওয়ার দৌড়ে শেয়ারবাজারের অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিও পিছিয়ে নেই। গত ১৫ বছরে এসব প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১৪ থেকে বেড়ে হয়েছে ৬৭। ১৮টি মার্চেন্ট ব্যাংকের জায়গায় হয়েছে ৬৬টি। স্টক ব্রোকারেজ ফার্ম ৩৭০ থেকে বেড়ে হয়েছে ৪০২টি। দেশের ইতিহাসে শেয়ারবাজারের সবচেয়ে বড় ধসও নেমেছিল সে সময়। একটি ১৯৯৬ সালে, আরেকটি ২০১০ সালে। দুবারই কারসাজির তদন্তে গঠিত কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পুঁজিবাজারের বিভিন্ন মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানের এমন বাড়বাড়ন্ত অবস্থা সত্ত্বেও অর্ধেক হয়ে গেছে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা।

অর্থনৈতিক বিবেচনায় প্রথম দুই প্রজন্মের ব্যাংকের প্রতিষ্ঠা ছিল যৌক্তিক ও প্রয়োজনীয়। স্বাধীনতা–পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত হওয়া ব্যাংকগুলোর অদক্ষতা, সুশাসনের অভাব এবং আমলাতান্ত্রিকতার পটভূমিতে বেসরকারি ব্যাংকের অভ্যুদয় ছিল প্রয়োজনীয়। সে সময় বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর জন্ম না হলে বাংলাদেশের শিল্পায়ন ও ব্যবসা–বাণিজ্যের এমন দ্রুত উন্নয়ন সম্ভব হতো না। উপরন্তু বেসরকারি ব্যাংকগুলো ত্বরিত সেবা দিয়ে দ্রুততম সময়ে মানুষের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছিল।

সে সময় ব্যাংক অনুমোদনে রাজনৈতিক বা অন্য কোনো বিবেচনা থাকলেও সেসব খুব বড় হয়ে দেখা দেয়নি। কিন্তু দেখা গেছে, তৃতীয় প্রজন্ম থেকে ব্যাংকগুলোর অনুমোদন প্রক্রিয়ায় মূলত রাজনৈতিক বিবেচনাই গুরুত্ব পেয়েছিল। এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকও এ রকম ঢালাও অনুমোদনের পক্ষে ছিল না। কারণ, এসব নতুন ব্যাংক স্থাপনের পেছনে বেশি ছিল রাজনৈতিক স্বজনপ্রীতি। এমনকি সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রকাশ্যে স্বীকারও করেছিলেন যে ব্যাংকগুলোর অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে রাজনৈতিক বিবেচনায়।

এ সময় সাফাই গেয়ে সরকারিভাবে বলা হচ্ছিল যে ব্যাংক সেবাকে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার জন্যই অনেক বেশি ব্যাংক দরকার। যুক্তিটা হাস্যকর। সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে ব্যাংকের শাখা–উপশাখা খোলাই যথেষ্ট। ডিজিটাল যুগে তো ব্যাংকের শাখাও অপ্রয়োজনীয়। একশ্রেণির মানুষকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার জন্য অবাধে খোলা নতুন ব্যাংকগুলো পুরো ব্যাংক খাতকে করে তুলছিল দুর্বল ও ভঙ্গুর। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল প্রথম প্রজন্মের ব্যাংক থেকে শুরু করে পরবর্তী প্রজন্মের বেশ কিছু ব্যাংকে ঋণদানের নামে যথেচ্ছাচার।

ফলে আজ বিভিন্ন ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংকের আইসিইউতে রেখে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করতে হচ্ছে। কেবল ব্যাংকই নয়, দেশে ৩৫টি অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া বেশির ভাগের অবস্থাই শোচনীয় ও করুণ, কয়েকটি অবসায়নের পথে।

রাজনৈতিক বিবেচনায় লাইসেন্স দেওয়ার দৌড়ে শেয়ারবাজারের অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিও পিছিয়ে নেই। গত ১৫ বছরে এসব প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১৪ থেকে বেড়ে হয়েছে ৬৭। ১৮টি মার্চেন্ট ব্যাংকের জায়গায় হয়েছে ৬৬টি। স্টক ব্রোকারেজ ফার্ম ৩৭০ থেকে বেড়ে হয়েছে ৪০২টি।

দেশের ইতিহাসে শেয়ারবাজারের সবচেয়ে বড় ধসও নেমেছিল সে সময়। একটি ১৯৯৬ সালে, আরেকটি ২০১০ সালে। দুবারই কারসাজির তদন্তে গঠিত কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পুঁজিবাজারের বিভিন্ন মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানের এমন বাড়বাড়ন্ত অবস্থা সত্ত্বেও অর্ধেক হয়ে গেছে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা।

আমাদের এমন বরকতের আরও বহু নজির আছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, টিভি চ্যানেলসহ আরও বহু খাতে। অর্থ খাতে এই বরকত আমাদের জন্য নেয়ামত না এনে কেয়ামত নাজিল করার পরিস্থিতি সৃষ্টি করছিল। সে রকম অবস্থা যাতে আবার সৃষ্টি না হয়, সেদিকে লক্ষ রেখে বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজে বের করতে হবে।

ফারুক মঈনউদ্দীন ব্যাংকার ও লেখক

[email protected]