বেলুন উড়িয়ে চীন আসলে কী ফায়দা হাসিল করতে চেয়েছিল?

যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে চীনের গোয়েন্দা বেলুন
এএফপি

অনেক উঁচুতে বাতাসে ভেসে চলতে পারে, এমন নজরদারি বেলুন এখন আর তেমন উন্নত কোনো গোয়েন্দা উপকরণ নয়। তবে চলতি সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের মন্টানার আকাশে এ ধরনের একটি চীনা বেলুনের উপস্থিতি দুই দেশের মধ্যে নতুন করে উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে। গবেষণার কাজে বেসরকারি উদ্যোগে এ বেলুন ওড়ানো হয়েছিল বলে চীন দাবি করা সত্ত্বেও এ ঘটনার জের ধরে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন তাঁর চীন সফর বাতিল করেছেন।

এ সপ্তাহের শুরুতে পেন্টাগন ঘোষণা করেছিল, তারা আন্তমহাদেশীয় পারমাণবিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের মজুতস্থল মন্টানার আকাশে ভাসমান একটি বেলুনের গতিবিধির ওপর নজর রাখছে। ওই সময় অতিকায় বেলুনটিকে ভূপাতিত করলে সাধারণ মানুষের ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে মনে করে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সেটিকে গুলি করে ফেলতে বারণ করেছিলেন। তবে শনিবার সেটি পূর্ব উপকূলের কাছাকাছি আসার পর মার্কিন বিমানবাহিনী সেটিকে ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ভূপাতিত করে।

গোয়েন্দাবৃত্তির উপকরণ হিসেবে বেলুনের ব্যবহার এখন হয় না বললেই চলে। ফরাসি বিপ্লবের সময় প্রথমবারের মতো গোয়েন্দা বেলুনের ব্যবহার হয়েছিল। আমেরিকায় গৃহযুদ্ধের সময় গুপ্তচরেরা বাইনোকুলার নিয়ে এ ধরনের অতিকায় বেলুনে চড়ে শত্রুপক্ষের অবস্থান শনাক্ত করত। শীতল যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন একে অপরের ওপর নজরদারির জন্য এ বেলুন ব্যবহার করেছিল।

সেই আমলে গোয়েন্দা বেলুন বাতাসের টানে অনেক সময় দিগ্ভ্রান্ত হয়ে যেত। কিন্তু এখনকার আধুনিক বেলুন ক্যামেরা, রাডার ও রেডিও ডিভাইসসজ্জিত থাকায় তা সাধারণত পথ হারায় না। আর ইতিমধ্যে স্পাই স্যাটেলাইট প্রযুক্তির প্রভূত উন্নতি হয়েছে। এ ছাড়া দূর থেকে নিয়ন্ত্রণযোগ্য মনুষ্যবিহীন ড্রোন চলে আসায় নজরদারির জন্য এখন আর বেলুন ব্যবহৃত হয় না। তবে বেসামরিক গবেষণার কাজে এখনো কোথাও কোথাও এগুলো ব্যবহার করা হয়।

এই গোয়েন্দা বেলুন ভূপাতিত করার প্রভাব এখন দুই দেশের কূটনীতির ওপর পড়েছে। পাঁচ বছরের বেশি সময় পর কোনো মার্কিন শীর্ষ কূটনীতিক হিসেবে ব্লিঙ্কেনের চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল। কিন্তু তিনি সফর বাতিল করায় দুই দেশের সম্পর্কে আরও শীতলতা নেমে এল।

পেন্টাগন বলেছে, যে বেলুনটি তারা ভূপাতিত করেছে, সেটি চীনের স্পাই স্যাটেলাইটের চেয়ে বেশি তথ্য দেওয়ার মতো সক্ষমতাবিশিষ্ট নয়। তবে সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধীরগতির কারণে কক্ষপথে স্থাপন করা কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহের তুলনায় এসব বেলুন থেকে অনেক বেশি স্পষ্টভাবে ভূপৃষ্ঠের ছবি তোলা যায়। এ ছাড়া ধাতব ড্রোন বা এয়ারক্র্যাফট যত সহজে রাডারে ধরা পড়ে, তত সহজে এসব বেলুন ধরা পড়ে না। ভূমি থেকে প্রায় ৮০ হাজার ফুট ওপরে (অর্থাৎ বাণিজ্যিক বিমানগুলো যে উচ্চতায় ওড়ে তার চেয়ে অনেক ওপরে) রাডারের চোখ ফাঁকি দিয়ে এসব বেলুন কয়েক সপ্তাহ ভেসে থাকতে পারে।

এখন প্রশ্ন হলো এই বেলুন উড়িয়ে চীন আসলে কী ফায়দা হাসিল করতে চেয়েছিল? পেন্টাগন বলেছে, বেলুনটি কানাডার আকাশসীমা পার হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে ঢোকার পরই তারা সেটির অবস্থান শনাক্ত করে। মন্টানা ও নর্থ ডাকোটা অঙ্গরাজ্যে কিছু পরমাণবিক অস্ত্র উৎক্ষেপণ ঘাঁটি আছে। এসব ঘাঁটির ওপর দিয়েই মূলত বেলুনটি উড়ছিল। বিষয়টি উল্লেখ করে একজন মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন, স্পষ্টতই বেলুনটি নজরদারির কাজে ব্যবহৃত হচ্ছিল।

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পরস্পরের বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরির অভিযোগ করা নতুন কিছু নয়। বেইজিং দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছে, মার্কিন জাহাজ ও বিমান থেকে চীনের সীমানার কাছে গিয়ে নজরদারি করে থাকে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এর জবাবে বলে আসছে, তারা আন্তর্জাতিক জলসীমা ও আকাশসীমা থেকে তাদের নজরদারি কাজ চালিয়ে থাকে। এ ছাড়া আগেও যুক্তরাষ্ট্রের সীমায় গোয়েন্দা বেলুন দেখা গেছে, যদিও সেগুলো এই বেলুনের মতো ছিল না।

কিছু বিশ্লেষক বলেছেন, বেলুনটি হয়তো ভুলক্রমে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে চলে গিয়েছিল; অথবা এমনও হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের নজরদারি সক্ষমতা পরীক্ষা করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে সেটিকে চীন যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে পাঠিয়েছিল।

আরও পড়ুন

এই গোয়েন্দা বেলুন ভূপাতিত করার প্রভাব এখন দুই দেশের কূটনীতির ওপর পড়েছে। পাঁচ বছরের বেশি সময় পর কোনো মার্কিন শীর্ষ কূটনীতিক হিসেবে ব্লিঙ্কেনের চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল। কিন্তু তিনি সফর বাতিল করায় দুই দেশের সম্পর্কে আরও শীতলতা নেমে এল।

ওদিকে চীনের পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘অনিচ্ছাকৃত এ ঘটনায়’ চীন দুঃখ প্রকাশ করছে এবং পরিস্থিতি সামাল দিতে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনা চালিয়ে যাবে। তবে এ টানাপোড়েনের রেশ কত দূর গড়াবে, তা এখনই স্পষ্ট নয়।

ফিন্যান্সিয়াল টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

হেনরি ফয় ফিন্যান্সিয়াল টাইমস-এর ব্রাসেলসভিত্তিক ইউরোপীয় কূটনৈতিক সংবাদদাতা এবং

দেমিত্রি সিভাস্তোপুলো একই পত্রিকার পররাষ্ট্র নীতিবিষয়ক সংবাদদাতা