গণতান্ত্রিক ইউরোপে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাস একটি অশুভ সময় হিসেবে চিহ্নিত হবে। ইউরোপীয় রাজনীতিতে সামাজিক গণতান্ত্রিক ও উদারবাদী রক্ষণশীলদের ঘুরেফিরে ক্ষমতায় আসার যে ঐতিহ্য, তা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। সুইডেনের পর এবার ইতালিতে রক্ষণশীলদের বিজয় পতাকা উড়ল। দুই সপ্তাহের ব্যবধানে উত্তর ও দক্ষিণ ইউরোপের এ দুটি দেশের নির্বাচনে কট্টরবাদীদের উত্থান ঘটেছে। দেশ দুটিতে শিগগিরই চরম রক্ষণশীল দলগুলো ক্ষমতা গ্রহণ করতে বা অনুঘটক হিসেবে উত্থিত হচ্ছে।
বিগত বছরে করোনা মহামারিকালের সংকট এবং সাম্প্রতিক কালের রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সর্বত্র অস্থির অর্থনীতি ও মুদ্রাস্ফীতির সময়কালে দক্ষিণপন্থীদের এ বিজয় বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। এ বিজয় নিঃসন্দেহে ভবিষ্যতে ২৭ দেশের জোট ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমন্বিত রাজনীতি, সমাজ ও অর্থনীতিবিষয়ক সিদ্ধান্ত গ্রহণে জটিলতা তৈরি করবে।
১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তের পর বা ১৯৮৯ সালে বার্লিনের প্রাচীর পতনের পর থেকে ইউরোপের দেশে দেশে যে নিও লিবারেলদের বা উদারনৈতিক রাজনীতির স্রোত বহমান ছিল, আপাতত তাতে ভাটা পড়েছে। ইউরোপ মহাদেশের উত্তরের দেশ নরওয়ে, ডেনমার্ক, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, লিথুনিয়া, মধ্য ইউরোপে জার্মানি, পোল্যান্ড, হল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, চেক প্রজাতন্ত্র, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স আরও দক্ষিণে গ্রিস, ইতালি প্রভৃতি দেশগুলোর কোথাও এরা, কোথাও ক্ষমতাসীন বা কোয়ালিশন সরকারের সঙ্গে আর কোথাও কোথাও পার্লামেন্টে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপের অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতিকেরা যে সামাজিক অর্থনীতির ভিত্তি স্থাপন করেন সেই সামাজিক বাজার অর্থনীতি সেখানে নানা ধকল সামাল পেরেছে এবং এটা বিশ্বে একটি সফল মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছিল। এখন তা অনেকটা চ্যালেঞ্জের মধ্য পড়েছে। বিগত সময়ে করোনা মহামারি, সাম্প্রতিক কালের ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে জ্বালানিসংকট, মুদ্রাস্ফীতি আর সারা বছর ইউরোপ অভিমুখে শরণার্থীদের স্রোত কট্টরবাদী দলগুলোর আরও জনপ্রিয়তা অর্জনে সহায়ক হয়েছে।
ইউরোপের উত্তরাঞ্চলের দেশগুলো, বিশেষত সুইডেনের রাজনীতির দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য গণতন্ত্র ও উদারনীতি। কিন্তু গত মধ্য সেপ্টেম্বরের নির্বাচনে সুইডেনের উদারবাদী রাজনীতির ধারক সামাজিক গণতান্ত্রিক জোট সরকারের পতন ঘটছে। সুইডেনে এবারের নির্বাচনে সফল ব্যক্তি হলেন বর্ণবাদী সুইডেন ডেমোক্রেটিক পার্টির ৪৩ বছর বয়সী নেতা জিমি একেসন। তিনি অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের কট্টরবাদী নেতাদের মতো উগ্র নন। রাষ্ট্রবিজ্ঞান, আইন ও অর্থনীতি বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন, বক্তৃতা করেন বুদ্ধিজীবীসুলভ। তাঁর সাফল্যের কারণ শরণার্থী-অভিবাসীবিরোধী অবস্থান ও পরধর্মের প্রতি অসহিষ্ণুতা। তাঁর দল সুইডেন গণতান্ত্রিক দল আসন্ন রক্ষণশীল জোট সরকার গঠনে মূল অনুঘটক হিসেবে থাকছে।
সুইডেনের নির্বাচনী প্রচারে অপরাধও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। এ ছাড়া জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, স্বাস্থ্য খাতে অব্যবস্থাসহ সারা সুইডেনে অপরাধী গ্যাংদের মাত্রা ছড়িয়ে পড়ছে। আর দুঃখজনক হলেও সত্য, বেশির ভাগ অপরাধীদের একটি অভিবাসন পটভূমি রয়েছে। এ বছর গত ১০ মাসে দেশটিতে সহিংস ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪৭ জন। অপরাধী অভিবাসী নিয়ে বিতর্ক এবারের নির্বাচনে অন্যতম ইস্যু। ক্ষমতাসীন সামাজিক গণতান্ত্রিক দলের বিগত জোট সরকার এই অপরাধীদের দমন করতে অপরাগ হয়েছে।
সুইডেনের মতো ইতালির নির্বাচন রক্ষণশীলদের বিজয় ঘটছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ইতালিতে চরম রক্ষণশীলদের বিজয় ইইউ জোটের জন্য একটি বড় ধাক্কা। এই বিজয় ইইউ জোট রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে, ইতালীয় পার্লামেন্টে কখনোই চরম ডানপন্থীদের এতটা প্রভাব দেখা যায়নি।
নির্বাচিত ব্রাদার্স অব ইতালি নেত্রী জর্জিয়া মেলোনির নব্য ফ্যাসিস্ট শিকড় রয়েছে। মাত্তেও সালভিনির ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী নর্দার্ন লিগ এবং সিলভিও বের্লুসকোনির ফরজা ইতালি ইতালি দলের সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ জোট গঠন করতে সক্ষম হবে। ইতালির এবারের নির্বাচনে প্রায় ৩০ শতাংশ ভোটার ভোট দিতে যাননি। ইতালির জনগণ গত চার বছরে মোট তিনটি সরকার দেখেছেন। রাজনৈতিক দল ও নেতাদের আচারণে জনগণ অসন্তুষ্ট ও হতাশ। প্রাথমিক অনুমান অনুযায়ী, জর্জিয়া মেলোনি প্রজাতন্ত্রের ইতিহাসে ইতালীয় সরকারের প্রধান হিসেবে প্রথম নারী হতে যাচ্ছেন।
নির্বাচিত ব্রাদার্স অব ইতালি নেত্রী জর্জিয়া মেলোনির নব্য ফ্যাসিস্ট শিকড় রয়েছে। মাত্তেও সালভিনির ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী নর্দার্ন লিগ এবং সিলভিও বের্লুসকোনির ফরজা ইতালি ইতালি দলের সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ জোট গঠন করতে সক্ষম হবে। ইতালির এবারের নির্বাচনে প্রায় ৩০ শতাংশ ভোটার ভোট দিতে যাননি।
সদ্য বিজয়ী এই রক্ষণশীল জোট ভবিষ্যতে অভিবাসন রাজনীতির পরিবর্তনসহ প্রধানত মুসলিম দেশ থেকে আসা অভিবাসীদের বিষয়ে কড়াকড়ি আরোপ করবে। এ ছাড়া কর হ্রাস, অবাধ গর্ভপাত বা লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল এবং ট্রান্সজেন্ডার বিষয়ে নতুন আইনের কথা বলেছে। এই বিজয় নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়েছেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যরা। তাঁরা বলেছেন, দেশটি একটি গণতন্ত্রবিরোধী ও ইউরোপীয় বিরোধী সরকারের গঠনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সহকারী স্পিকার ও জার্মানির সাবেক আইনমন্ত্রী সামাজিক গণতান্ত্রিক দলের ক্যাথারিনা বার্লে সম্প্রতি জার্মানির ডের ভেল্ট পত্রিকাটিতে বলেছেন, ‘জর্জিয়া মেলোনি ইতালির নির্বাচনে কৌশলগত কারণে ইউরোপীয় ঐক্যের বিষয়ে সত্য কথা বলেননি। কিন্তু ইউরোপে গঠনমূলক সহাবস্থানের জন্য তিনি হুমকিস্বরূপ।’
ইইউ পার্লামেন্টে জার্মানি সবুজ দলের মুখপাত্র রাসমুস আন্দ্রেসেন বলেছেন যে ‘ইইউ র প্রতিষ্ঠাতা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের চতুর্থ শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ ইতালিতে ডানপন্থীদের এ বিজয় ইউরোপ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে।’ অন্যদিকে রক্ষণশীল ঘরানার দল জার্মানির অলটারনেটিভ ফর ডয়েচল্যান্ড, ফ্রান্সের ডানপন্থী রাসেম্বলমেন্ট ন্যাশনাল, পোল্যান্ডর পিআইএসের রাজনীতিবিদেরা জর্জিয়া মেলোনিকে নির্বাচনে জয়ের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন। ইইউবিরোধী ফরাসি রক্ষণশীল সংসদ সদস্য জর্ডান বারডেলা বলেছেন, ইতালীয়রা ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডের লেয়েনকে ‘নম্র হওয়ার পাঠ’ দিয়েছেন।
ইইউ জোটের ২৭ সদস্যদের মধ্য ক্ষমতায় আসীন আরও দুই রক্ষণশীল দেশের প্রধানমন্ত্রী হাঙ্গেরির ভিক্টর অরবান ও পোল্যান্ডে মাথিউস মোরাউইকি ইতালিতে রক্ষণশীল জর্জিয়া মেলোনির বিজয়ে বেশ উল্লাস করছেন। তাঁরা ইইউ জোটে দর-কষাকষির জন্য আরেকজন হেভিওয়েট মিত্র পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন।
তবে ইতালিতে করোনাপরবর্তী এবং বর্তমানের যুদ্ধকালীন অর্থনৈতিক সংকটে, ইইউ-অর্থায়নকৃত করোনা উন্নয়ন তহবিল থেকে অনুদান এবং সস্তা ঋণের প্রবাহ রয়েছে। সেখানে ইতালির জন্য বরাদ্দ রয়েছে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ইউরো। তাই এই আর্থিক সহযোগিতার খাত প্রত্যাখ্যান করে ইতালির রক্ষণশীলেরা শিগগিরই ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিয়মনীতি ভঙ্গ করে সংঘর্ষের পথ নেবে, তা মনে হয় না।
সরাফ আহমেদ প্রথম আলোর জার্মানি প্রতিনিধি
[email protected]