হাতকড়া দেখিয়ে কি চালের দামের লাগাম টানা যাবে

সার, কীটনাশক, সেচ, বীজ—ধান চাষের জন্য কৃষকের এগুলো  লাগবেই। কৃষকের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে এগুলো পৌঁছে না দিলে ধানের উৎপাদন খরচ বাড়বেই। 

ধান উৎপাদনে এগিয়ে রয়েছেন নওগাঁ জেলার কৃষকেরাফাইল ছবি

নির্বাচনের পর নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হলেও খাদ্যমন্ত্রীর পদ পরিবর্তন হয়নি। অপরিবর্তিত খাদ্যমন্ত্রী সম্প্রতি কুষ্টিয়া সফরে গিয়েছিলেন। পত্রপত্রিকা অবশ্য এ সফরকে অভিযান বলেছে। গত ৩১ জানুয়ারি সেই সফরে তিনি দেশের বৃহত্তম চালের মোকাম খাজানগরে গিয়ে চালকলমালিক তথা ব্যবসায়ীদের সৎ থাকার আহ্বান জানান। মোটা চাল সরু না করার পরামর্শ দেন। এরপর মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের হুঁশিয়ারি দিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ফিরে আসেন। সেখানে ‘চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে করণীয়’ শীর্ষক অংশীজনদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় অংশ নেন।

মতবিনিময়ের সময় উপস্থিত একজন চালকল মালিক সাহস করে বলে ফেলেন, ‘উত্তরবঙ্গের ব্যবসায়ীদের কারণে চালের মূল্য বাড়ে।’ সাহসী সেই চালকলমালিক আন্দাজে কথা বলেননি। মন্ত্রীর কুষ্টিয়া সফর মতান্তরে অভিযানের দিন দুই আগে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেছিলেন, উত্তরাঞ্চলের একটি অসাধু মিলমালিক চক্র ডিসেম্বরের পর হঠাৎ চালের দাম বাড়িয়েছে।

‘সাহসী’ চালকলমালিক মন্ত্রীকে নিজেদের লোক, মানে মিত্র ভেবেই হয়তো ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কথাটি পুনরাবৃত্তি করেছিলেন। চাল ব্যবসায় মন্ত্রীর অভিজ্ঞতার কথা সবার জানা। মন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার ১৯৭২ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সরাসরি ধান-চালের ব্যবসা করেছেন। (নির্বাচনী হলফনামা ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া মন্ত্রীর জীবনবৃত্তান্তে কৃষি ব্যবসার কথা বলা হয়েছে। তিনি নিজেও চাল ব্যবসার অভিজ্ঞতার কথা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন। বলেছেন, এখন তাঁদের পারিবারিক ধান-চালের ব্যবসা দেখাশোনা করেন তাঁর চাচাতো ভাই মুরালী মোহন মজুমদারের ছেলে দেবব্রত মজুমদার।) [দেখুন প্রথম আলো: ১২ আগস্ট ২০২১]।

উত্তরবঙ্গের বরাত দেওয়া মনে হয় মন্ত্রীর পছন্দ হয়নি। তাঁর নিজের জেলা আর নির্বাচনী এলাকা (নওগাঁ-১, নিয়ামতপুর-পোরশা-সাপাহার) ধান উৎপাদন আর ধান-চালের ব্যবসার জন্য অনেক দিন থেকেই মশহুর। কথিত চালকলমালিকের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় মন্ত্রী চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন।

তিনি বলেন, ‘আমি কুষ্টিয়ায় বসে থেকে যদি তাঁদের হাতকড়া পরাতে না পারি, তাহলে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেব। দেন আমাকে উত্তরবঙ্গের কোন কোন ব্যবসায়ী চালের দাম বাড়ানোর সঙ্গে জড়িত, তাঁদের নাম-ঠিকানা দেন। এক্ষুনি তাঁদের হাতে হাতকড়া পরানো হবে।’

বলা বাহুল্য, কুষ্টিয়ার চাল ব্যবসায়ীদের কাছে কোনো নগদ তালিকা ছিল না। তালিকা রাখা তাঁদের কাজও নয়। মন্ত্রীর চ্যালেঞ্জ হয়তো ‘রাজনৈতিক’ ধরণের বক্তব্যেরই অংশ। সিরিয়াস কিছু নয়। সিরিয়াস হলে তিনি তাঁর নিজস্ব মাধ্যমে অথবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত নানা বাহিনীর সাহায্য নিয়ে তদন্তে নামার ঘোষণা দিতে পারতেন।

হাতকড়া না হোক জরিমানার রসিদ আর সিলগালা নিয়ে অনেকে বাজার শাসনের কাজে মাঠে নেমেছেন। সংবাদমাধ্যমে সেগুলোর প্রচারও চলছে দিনরাত। কিন্তু দাম কি কমছে?

একটা সময় ছিল, যখন কোনো এক কমিশনের প্রধান প্রায় প্রতিদিন ছুটতেন। সরকারি-বেসরকারি টিভি ক্রুদের নিয়ে ঘটনার ‘হটস্পটে’ চলে যেতেন। তারপর ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে কাঁদতেন। রুমালে চোখ মুছতেন। দক্ষ ক্যামেরাম্যান সেই কান্নাকে বড় (জুম) করে স্থির (স্টিল) করে দিতেন। আর ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজত বেহালায় করুণ সুর।

একজন ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন, তিনিও একেক দিন একেকটা স্টোরি (কাহিনি) সরবরাহ করতেন গণমাধ্যমকে। টিভি ক্যামেরার সামনে রেখে ভেজাল ধরতেন, ভেজালিকে অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করতেন। দণ্ডের টাকা গোনার ছবি দেখানো হতো টেলিভিশনের সাদা-কালো আর রঙিন পর্দায়।

ভেজাল অভিযানের সেই ম্যাজিস্ট্রেট নাকি এখন নিজেই ‘ভেজালে’ আছেন। সেই কমিশনপ্রধানও এখন আলোচনায় নেই। কিন্তু তাঁদের ‘পাবলিক খাওয়ার’ চর্চা বাজার পেয়ে গেছে। সুযোগ পেলেই প্রচারের এই মোক্ষম সুযোগ কেউ হারাতে চান না।

সপ্তাহ কয়েক আগে ঝালকাঠিতে বাজার নিয়ন্ত্রণে অভিযান পরিচালনা করেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নিজেই। অবশ্য তাঁর সঙ্গে স্থানীয় জেলা প্রশাসক ও জেলা পুলিশপ্রধান ছিলেন।

তিনি শহরের বড়বাজার ও কাঠপট্টি এলাকায় চাল, ভোজ্যতেলসহ নিত্যপণ্যের কয়েকটি দোকান তদারক শেষে সাংবাদিকদের বলেন, নতুন সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতেই অযৌক্তিকভাবে চালের দাম বাড়ানো হয়েছে। দেশে প্রচুর চাল মজুত আছে। কোনোভাবেই চালের বাজার অস্থিতিশীল করা যাবে না। অতিরিক্ত মজুত করা হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আসলেই কি ধানচালের অভাব নেই

মহাপরিচালক যে অঞ্চলে গিয়েছিলেন, সেই অঞ্চলে (বরিশাল বিভাগ) গত নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড় মিধিলির প্রভাবে বৃষ্টি ও ঝোড়ো বাতাসে খেতে থাকা আমন ধানসহ বিভিন্ন ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সেই সময় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছিল, খেতে থাকা আমন ধানের শতকরা ২১ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত ফসলের মধ্যে ছিল শীতকালীন সবজি, পান, আগাম জাতের শর্ষে, খেসারি ও গম। তখন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছিল আলোচ্য বিভাগে যে ৭ লাখ ১ হাজার ৯০৩ হেক্টর জমিতে আমনের আবাদ হয়েছিল, তার মধ্যে প্রায় ১ লাখ ৭ হাজার হেক্টর জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

মিধিলির প্রভাব ছাড়াও আমনের আবাদের খরচ অনেক বেড়ে যাওয়ায় আগের দামে ধানচাল বেচার অবস্থা কৃষকের নেই। খরচে কুলাতে না পারায় অনেক জমি চাষাবাদের আওতায় আসেনি গত মৌসুমে। মেরে কেটে গত ৩০ জুলাই পর্যন্ত আমনের চারা লাগানো যায়।

বৃষ্টির পানিতে বিকশিত হয় বলে আমনের চাষে খরচ কম পড়ে। কিন্তু এবার মৌসুমে বৃষ্টির দেখা মেলেনি সেভাবে। জুলাই মাস পর্যন্ত যশোর এলাকায় সেচ দিয়েও লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৪০ শতাংশের বেশি জমিতে চারা রোপণ করা সম্ভব হয়নি।

সেচ দিয়ে চাষ করতে গেলে আমনের উৎপাদন খরচ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। অনেকে বীজতলায় চারা তৈরি করেও বৃষ্টির অভাবে আর চাষাবাদে যেতে পারেননি। বীজতলায় তৈরি হওয়া চারা ২৫ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে জমিতে লাগাতে হয়। কিন্তু অনেক কৃষকের চারার বয়স দেড় মাস পেরিয়ে গেলে তাঁরা হাল ছেড়ে দেন।

আষাঢ়-শ্রাবণে আশানুরূপ বৃষ্টি না হওয়ায় নওগাঁ, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, বগুড়াসহ আমন উৎপাদনকারী সব এলাকায় কৃষকেরা যে বিপাকে পড়েছিলেন, তার খবর তখনকার পত্রিকার পাতা খুঁজলেই পাওয়া যাবে। পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মহাপরিচালক তখন বলেছিলেন, ‘এল নিনো আবহাওয়ার প্যাটার্ন এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। আমরাও সেই প্যাটার্নে প্রবেশ করেছি।’

সরকার এবং গবেষণাপ্রতিষ্ঠানগুলো কৃষকদের বিকল্প পদ্ধতিতে, অর্থাৎ সেচের মাধ্যমে ধান রোপণের পরামর্শ দিতে থাকে। যাঁরা তেলের খরচ জোটাতে পেরেছেন, ‘তাঁদের ধানে রাধা নেচেছে।’ বাকিরা আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকেছেন। ফলে চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। অভাব আর ঘাটতি তাই কোনো গালগল্প নয়। সরকারকে ফাঁদে ফেলার কোনো ষড়যন্ত্রও নয়। যাঁরা এসব বলেন, তাঁরা বাড়তি কথার চর্চা করেন।

খরচের বহর

শুধু বগুড়া অঞ্চলে সেচ দিয়ে আমন ধান উৎপাদনে বাড়তি ২৩৩ কোটি টাকা খরচের কথা জানিয়েছিলেন সেখানকার জেলা কৃষি বিভাগ। এ তো ছিল শুধু সেচের খরচের হিসাব। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা জানাচ্ছে, বাংলাদেশে মোট ৯ কোটি ৩৩ লাখ টন কৃষিজাত দ্রব্য উৎপাদিত হচ্ছে আর ১ কোটি ২৫ লাখ টন খাদ্য আমদানি করছে।

২০২০ সাল পর্যন্ত খাদ্যের মোট চাহিদার ৯ দশমিক ৩ শতাংশ আমদানি করা হতো। ২০২২ সালে খাদ্য আমদানি চাহিদার ১১ দশমিক ২ শতাংশে পৌঁছে গেছে। কৃষি উৎপাদন আশানুরূপ না হলে আমদানি আরও বাড়বে। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ বিশ্বে খাদ্য আমদানিকারক দেশগুলোর মধ্যে তৃতীয়। চীন ও ফিলিপাইনের পর বাংলাদেশের অবস্থান।

আমদানি করেও কি চালের দাম কমানো সম্ভব

খাদ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি পেলে শূন্য শুল্কে চাল আমদানি হতে পারে। সরবরাহ যেন কমে না যায়, সে জন্য আমরা চাল আমদানির চেষ্টা করছি। শূন্য শুল্কে আমদানি করার জন্য ফাইল প্রসেসিংয়ে আছে।’ তবে দেশের বাইরেও চালের দাম বাড়ছে।

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে রপ্তানিকারক দেশগুলোর মূল্যতালিকা বিশ্লেষণের ভিত্তিতে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বিশ্ববাজারে চালের দাম এখন প্রায় দেড় দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। খাদ্যাভ্যাস এবং বিবিধ কারণে আমরা প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে বেশি চাল আমদানি করি। গৃহযুদ্ধের কারণে মিয়ানমার এখন অনেক দূরের দেশ। চালের দাম তারাও বাড়িয়েছে। ভারত দুই সপ্তাহ আগেও যে চাল (সবচেয়ে কম দামি, ৫ শতাংশ ভাঙা খুদযুক্ত) প্রতি টন ৫২৬ ডলারে রপ্তানি করেছে। গত সপ্তাহে তা বেড়ে দাঁড়ায় সর্বোচ্চ ৫৪৬ ডলারে।

দাম বেড়েছে থাইল্যান্ডেও। দুই সপ্তাহ আগে দেশটি থেকে রপ্তানির জন্য যে চালের টনপ্রতি মূল্য ছিল ৬৫২ ডলার, গত সপ্তাহে তা আকস্মিকভাবেই ৬৬৫ ডলারে উঠে যায়। ভিয়েতনাম থেকে জানা যাচ্ছে, দেশটি থেকে প্রতি টন ৫ শতাংশ ভাঙা চাল রপ্তানি হচ্ছে ৬৫৩ ডলারে। কাজেই শতভাগ শুল্ক তুলে দিলেও চালের দাম আর আগের জায়গায় ফিরবে না।

নতুন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম বলেছেন, ভয়ভীতি দেখিয়ে বা জরিমানা করে বাজারদর নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। সব পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের আস্থায় এনেই সরকার পণ্য তদারক করবে। অন্যদিকে খাদ্যমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, ‘আপনারা (ব্যবসায়ীরা) যত চালাক, আইন তার চেয়ে বেশি চালাক। আইন বসে থাকবে না। ভরা মৌসুমে চালের দাম বাড়ার কোনো যুক্তি নেই। এখনই সাবধান হয়ে যান। নতুন আইন হচ্ছে। শুধু জরিমানাই নয়, প্রয়োজনে জেলেও যেতে হতে পারে।’

ব্যবসায়ীদের আস্থায় নেওয়া হবে, না জেলে চালান করা হবে, সেটা নির্ভর করছে মন্ত্রীদের বিবেচনার ওপর, সরকারের সামর্থ্য ও সদিচ্ছার ওপর। তবে সবার আগে ভাবতে হবে কৃষকের কথা। আসল উৎপাদকের কথা। যে আমন সে ঘরে তুলতে পারেননি, তিনি কীভাবে বোরো আবাদে সর্বস্ব উজাড় করে দেবেন। তেল, সার, কীটনাশক, সেচ, বীজ—এগুলো লাগবেই। প্রকৃত কৃষকের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে এগুলো পৌঁছে দেওয়ার একটা পথ আমাদের বের করতেই হবে।

  • গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও গবেষক