মিসর ও ইসরায়েলের মধ্যে লড়াই কি এবার বেধেই যাবে

মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি ও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুফাইল ছবি: রয়টার্স

৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পাল্টায় ইসরায়েল গাজায় সামরিক অভিযান শুরু করলে, মিসর অব্যাহতভাবে সতর্ক করে আসছে যে উপত্যকাটি থেকে যেন জোর করে সেখানকার বাসিন্দাদের বাস্তুচ্যুত করা না হয়। নির্দিষ্ট করে বললে মিসর সিনাই উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের পাঠানোর পরিকল্পনাকে জোরালোভাবে বিরোধিতা করে আসছে।

এই সংঘাত আট মাসে এসে পড়েছে এবং ইসরায়েলিরা রাফায় হামলা শুরু করেছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে মিসরের সেই অবস্থান আরও জোরালো হয়েছে। কায়রো প্রবলভাবে তেল আবিবের রাফা অভিযানের প্রতিবাদ করেছে। তারা বলছে, রাফা অভিযানের মানে হচ্ছে ১৯৭৯ সালের শান্তি চুক্তিকে ঝুঁকির মুখে ফেলা। মিসরের কিছু সরকারি কর্মকর্তা ইঙ্গিত দিয়েছেন যে তাঁরা ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক হ্রাস করবেন এবং তেল আবিব থেকে তাঁদের রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করবেন।

মিসরের সংবাদমাধ্যমগুলোও ইসরায়েলের সমালোচনার মাত্রা তীব্র করেছে। তারা বলছে, ৪৫ বছরের মধ্যে এমন মাত্রার বৈরিতা দেখা যায়নি। এই পরিস্থিতি যে প্রশ্নটি সামনে আনছে, তা হলো, ইসরায়েল ও মিসরের মধ্যে একটা সংঘাত বেধে যাওয়ার আশঙ্কা কতটা আছে?

অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে সংঘাত বেধে যাওয়ার শঙ্কা এখন বেশি। বিশেষ করে ইসরায়েল যখন গাজা থেকে সরিয়ে ফিলিস্তিনিদের সিনাইয়ে স্থানান্তর করতে বদ্ধপরিকর। মিসরের বর্তমান শাসকেরা প্রবলভাবে ইসরায়েলের পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছে। তারা এটাকে মিসরের জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি বলে মনে করে। মিসরের শাসকেরা মনে করেন, নিজ জন্মভূমিতে ফিলিস্তিনিদের নিরাপদে থাকার অধিকার রয়েছে।

গত সপ্তাহে ইসরায়েল সরকারের মুখপাত্র ডেভিড মেনস্যার বলেছেন, মিসরকে ইসরায়েল বলেছিল তারা যেন ফিলিস্তিনি বেসামরিক লোকদের জন্য রাফা সীমান্ত খুলে দেয়। কিন্তু মিসর তাতে রাজি হয়নি।

মিসরীয়দের সঙ্গে ইসরায়েলিদের সম্পর্ক সব সময়ই কঠোরভাবে আনুষ্ঠানিক, এই সম্পর্ক কখনোই স্বাভাবিক পর্যায়ে আসতে পারেনি। দুই পক্ষই এটাকে শীতল-শান্তি বলে থাকে। গাজা যুদ্ধ শুরুর পর মিসর খুব সতর্কতার সঙ্গে পদক্ষেপ নিয়ে আসছে। এতে করে বড় পরিসরের আঞ্চলিক সংঘাত ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে। মিসর মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করতে চেষ্টা করে আসছে।

মিসরের এ অবস্থান নতুন নয়। বলা যায়, ফিলিস্তিন সংকট যত পুরোনো, মিসরের এ অবস্থানও তত পুরোনো। ১৯৭০-এর দশকে মিসরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতকেও একই ধরনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তাঁকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, নেভগে মরুভূমিতে একখণ্ড ভূমির বিনিময়ে মিসর যেন সিনাই উপত্যকার একাংশ ছেড়ে দেয়। সে সময় আনোয়ার সাদাত উত্তর দিয়েছিলেন, ইসরায়েলের ইলাত বন্দর যদি দেওয়া হয় কেবল তার বিনিময়েই তিনি সিনাই উপত্যকার একটি অংশ ছাড়তে রাজি। এই উত্তরে পিছু হটেছিল আমেরিকা ও ইসরায়েলের।

হোসনি মোবারকের আমলে যখন তাবা নিয়ে বিরোধ চাঙা হয়েছিল, তখন ইসরায়েল ও আন্তর্জাতিক অন্য পক্ষগুলো মিসরকে আবারও সিনাই উপত্যকা ছেড়ে দেওয়ার চাপ দিয়েছিল। কিন্তু পুরো চাপ ও প্রলোভন উপেক্ষা করেছিলেন হোসনি মোবারক। ২০১০ সালে ইসরায়েলের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জিওরা আইল্যান্ড নতুন ফিলিস্তিনিদের মাতৃভূমি হিসেবে নতুন একটি জর্ডান রাজ্য গঠনের প্রস্তাব হাজির করেছিলেন। তার প্রস্তাবে পশ্চিম তীর ও পূর্ব ও মিসরের একটি অংশসহ বৃহত্তর গাজার কথা বলা হয়েছিল।

দীর্ঘদিন ধরে মিসর এটা খারিজ করে আসা সত্ত্বেও ইসরায়েল তাদের দিক থেকে ফিলিস্তিনিদের সিনাই উপত্যকায় পাঠানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। সেটা বড় ধরনের সংঘাতের পটভূমি তৈরি করছে।

আমেরিকান সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল এ মাসে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, সীমান্ত শহর রাফায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের কারণে মিসর ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছোট করার পরিকল্পনা করছে এবং তেল আবিব থেকে তাদের রাষ্ট্রদূতকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে চাইছে।

ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিসরের বিরুদ্ধে গাজা সীমান্তে অবরোধ তৈরির অভিযোগ তুলেছেন। তাঁর অভিযোগ এ অবরোধের কারণে ত্রাণ কার্যকর ব্যাহত হচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়ায় মিসরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ৭ অক্টোবর থেকে রাফা ক্রসিংয়ের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ ইসরায়েলের হাতে। সে কারণেই গাজার বাসিন্দাদের কাছে ত্রাণ পাঠানো যাচ্ছে না। মিসরের অনেক রাজনৈতিক দল বিবৃতি দিয়ে বলেছে, ইসরায়েলের বিবৃতি বিভ্রান্তিকর।

মিসরের দিক থেকে বারবার করে বলে আসা হচ্ছে রাফায় যেন কোনো ধরনের অভিযান পরিচালনা করা না হয়। কেননা জনাকীর্ণ শহরটিতে প্রায় ১৫ লাখ ফিলিস্তিনি আশ্রয় নিয়ে রয়েছে। এই লোকগুলোর জন্য আর কোথাও যাওয়া নিরাপদ নয়।

ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে ইসরায়েলের বিরুদ্ধ দক্ষিণ আফ্রিকার দায়ের করা মামলায় সমর্থন দেওয়ার হুমকি দিয়েছে মিসর। মিসরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলিদের হামলার তীব্রতা বৃদ্ধি, বেসামরিক লোকদের লক্ষ্যবস্তু করে পদ্ধতিগত হামলা, অবকাঠামো ধ্বংস এবং ফিলিস্তিনিদের তাদের ভূখণ্ড থেকে পালাতে বাধ্য করার পরিকল্পনার মতো বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে।

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার মামলায় মিসর চাইলে প্রয়োজনীয় আইনগত ও কারিগরি সমর্থন দিতে পারে। মিসর পার্লামেন্টের হিউম্যান রাইটস কমিটি ঘোষণা দিয়েছে তাদের কাছে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ রয়েছে, যা দিয়ে তারা ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে চলমান মামলায় মিসর অংশ নিতে পারে।

চলমান ঘটনাপ্রবাহ মিসরীয় ও ইসরায়েলিদের মধ্যে টানাপোড়েন আরও বাড়াতে পারে। তাতে শান্তি চুক্তিও ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে এসেছে যে মিসর এখন তাদের পক্ষ থেকে শান্তি চুক্তির ব্যাপারটি পুনর্বিবেচনা করতে পারে।

মিসরীয়দের সঙ্গে ইসরায়েলিদের সম্পর্ক সব সময়ই কঠোরভাবে আনুষ্ঠানিক, এই সম্পর্ক কখনোই স্বাভাবিক পর্যায়ে আসতে পারেনি। দুই পক্ষই এটাকে শীতল-শান্তি বলে থাকে। গাজা যুদ্ধ শুরুর পর মিসর খুব সতর্কতার সঙ্গে পদক্ষেপ নিয়ে আসছে। এতে করে বড় পরিসরের আঞ্চলিক সংঘাত ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে। মিসর মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করতে চেষ্টা করে আসছে।

কিন্তু রাফায় ইসরায়েলি অভিযান দুই দেশের শীতল শান্তিকে শীতল যুদ্ধের কিনারে নিয়ে এসেছে। এই শীতল যুদ্ধের শুরুটা আমরা কেবল দেখছি, এরপর কী হবে, তার জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

আবদেলাতিফ ইল-মোনায়ি লেখক, কলামিস্ট ও মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিক

আরব নিউজ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত