জিডিপির হিসাব থেকে নারীর কোনো কাজ যেন বাদ না পড়ে

নারীর সাংসারিক কাজকে মূল্য দেওয়া হয় না এ কারণে যে নারী তাঁর সময়ের একটা বড় অংশ ‘বাজারকেন্দ্রিক’ কাজের চেয়ে ‘বাজারবহির্ভূত’ কাজে ব্যস্ত থাকেন।

নারীর অমূল্যায়িত গৃহস্থালি কাজের স্বীকৃতির জন্য বহু বছরের প্রতীক্ষা, বহুদিনের কাজের ফল আজ বাস্তব হতে চলেছে। দেশের সরকারপ্রধানের বক্তব্যের মাধ্যমে বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারীর অমূল্যায়িত ও অস্বীকৃত গৃহস্থালি কাজকে জাতীয় জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নারীরা ঘরের সব কাজ করেন, অথচ সেই কাজ কারও নজরে আসে না, সেই কাজের কোনো স্বীকৃতি নেই।

অর্থনীতিবিদেরা দেখিয়েছেন, ৪৩ শতাংশের বেশি নারী পুরোপুরিভাবে গৃহস্থালি কাজের সঙ্গে যুক্ত। পুরুষের সংখ্যা সেখানে ১ শতাংশের কম। দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান ২০ শতাংশ। তবে নারীর এই গৃহস্থালি কাজকে জাতীয় আয় পরিমাপের পদ্ধতিতে (এসএনএ) যোগ করা গেলে জিডিপিতে নারীর অবদান দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ। আগামী অর্থবছরের বাজেটে সেই প্রতিফলন দেখতে পারলে নারী সমাজ, এর চাইতে খুশির আর কিছু হবে না।

শুধু ঘরের কাজই নয়, বাংলাদেশের শ্রমবাজারে দু-তিন দশক ধরে নারীর অংশগ্রহণ ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৮০ সালের মাঝামাঝিতে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ৮ শতাংশ, ২০১৬-১৭ সালে এসে তা হয়েছে ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশ, বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ৪২ দশমিক ৮৫ শতাংশ। পিতৃতান্ত্রিক ও রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থার কারণে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ার পরও এ সংখ্যাগত হার তেমন গুরুত্ব পায়নি। সেই সঙ্গে গুরুত্ব পায়নি ঘরের কাজে নারীর শতভাগ অংশগ্রহণের দিকটিও। সারা দিন সব কাজ করার পরও একজন স্ত্রীকে শুনতে হয়, ‘তুমি সারা দিন করোটা কী?’

নারীর সাংসারিক কাজকে মূল্য দেওয়া হয় না এ কারণে যে নারী তাঁর সময়ের একটা বড় অংশ ‘বাজারকেন্দ্রিক’ কাজের চেয়ে ‘বাজারবহির্ভূত’ কাজে ব্যস্ত থাকেন। বিনা মূল্যের এই গৃহস্থালি কাজগুলোকেই অ-অর্থনৈতিক কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই অস্বীকৃত ও অদৃশ্য কাজগুলো শুধু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, রান্না, শিশুযত্ন, বয়স্ক মানুষের যত্নই নয়, এর সঙ্গে আছে কৃষিকাজ, গবাদিপশুর দেখাশোনা ও বীজ সংরক্ষণ।

অনেক আগে থেকেই গ্রামীণ নারীরা কৃষি খাতে অবদান রাখছেন। অধুনা সেই হার বেড়েছে। বাংলাদেশে মোট ৫ কোটি ৬৭ লাখ কর্মজীবী মানুষের মধ্যে ৪৭ দশমিক ৬ শতাংশ লোক কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। আবার তাঁদের মধ্যে ৬৪ দশমিক ৮ শতাংশই নারী। সংসারের কাজ করার পাশাপাশি আবাদ-পরবর্তী কাজ, গবাদিপশুর দেখাশোনা, দুধ আহরণ, ছাগলের চাষ, বাড়ির ভেতরের সবজিবাগান এবং বীজ সংরক্ষণের মতো জরুরি কাজগুলো নারীরাই করেন। আরও আছে জমি তৈরি, চারা রোপণ, সার দেওয়া, পোকানাশকের ব্যবহার, বীজ তৈরি, চাষাবাদ, শস্য জমি থেকে বাড়িতে নেওয়া, ফসল ভাঙানো, বাছাই ও প্যাকেটজাত করা।

অর্থনীতিবিদ ফাহমিদা খাতুন ২০১৫ সালে একটি গবেষণায় দেখিয়েছেন, নারীর এই অমূল্যায়িত গৃহস্থালি কাজকে যদি পরিমাপ করা হতো, তাহলে তা হতো বাংলাদেশের জিডিপির ৭৬ দশমিক ৮ শতাংশের সমান। এখন পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছেন, নারীর গৃহস্থালি কাজের অবদানকে জিডিপিতে যোগ করা হলে বাংলাদেশের জিডিপি ৯০০ বিলিয়ন ডলারের মতো হতে পারে।

যেহেতু আর্থিক মূল্য ছাড়া কোনো কাজই বাজার অর্থনীতির অন্তর্ভুক্ত হয় না, তাই বিশ্বের অনেক দেশের অর্থনীতিবিদেরা সাধারণত স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্ট সিস্টেমের ওপর নির্ভর করেন। স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে নারীর অমূল্যায়িত কাজকে চিহ্নিত করে অর্থনীতিবিদেরা জাতীয় আয় পরিমাপের পদ্ধতি বা সিস্টেম অব ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টসের (এসএনএ) কঠিন কাজটি করতে পারবেন।

স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্ট সিস্টেম হচ্ছে এমন একটি হিসাবপদ্ধতি, যা দিয়ে ঘরের অ-অর্থনৈতিক সেবামূলক বা গৃহস্থালি কাজ মাপা হয়। এই স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে সরকারি নীতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণকালে লিঙ্গসমতা, পরিবারের আয়-ব্যয়, সার্বিক দায়িত্বপালন, শিশুর যত্ন, বয়স্ক মানুষের যত্ন, সন্তানের পড়াশোনার দায়িত্ব ইত্যাদি বিষয়গুলোকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই কাজগুলো কোনো অর্থনৈতিক লেনদেন বা ক্ষতি পূরণ পাওয়ার আশা ছাড়াই গৃহিণীরা করে থাকেন।

এই স্যাটেলাইট পদ্ধতি নারীর অ-অর্থনৈতিক কাজগুলোকে জিডিপিতে মূল্যায়িত করার জন্য মূল সূচকগুলোকে সহায়তা করবে। আমরা আশা করব, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পরপরই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় অর্থনীতিবিদদের সহায়তায় স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্ট সিস্টেম নিয়ে কাজ শুরু করে দেবেন। কারণ, এখন বৈশ্বিক অ্যাজেন্ডা হচ্ছে এমন সমাধান খুঁজে বের করা, যার মাধ্যমে নীতি বা পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটিয়ে নারীর অর্থনৈতিক কাজকে উৎসাহিত করা যায়। সেই সঙ্গে এমন সুযোগ সৃষ্টি করা, যেন নারী কোনো সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাজে যোগ দিয়ে আরও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারেন।

লিঙ্গসমতার ক্ষেত্রে এসডিজি ৫ অর্জন করতে চাইলে অবশ্যই নারীর এই অস্বীকৃত গৃহস্থালির কাজকে মূল্যায়ন করতে হবে। অর্থনৈতিক দৃষ্টিতে সেবাকাজ মূল্যায়নের ভালো উদাহরণ হচ্ছে নেপাল, মেক্সিকো, ব্রাজিল, কেনিয়া, নরওয়ে ও ফিনল্যান্ড। অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, কোনো দেশ যদি অধিকতর বাস্তবসম্মত শ্রম ও কর্মসংস্থান নীতি গ্রহণ করতে চায়, তাহলে অবশ্যই নারীর অ-অর্থনৈতিক কাজকে শ্রমবাজার অর্থনীতির আলোকে বিশ্লেষণ করতে হবে। এসডিজি লক্ষ্য ৫.৪-এ স্পষ্টতই পরিবারে কাজের দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়ার বা পুরুষকে সাংসারিক কাজে নিয়োজিত করার কথা বলা হয়েছে।

নারীর অস্বীকৃত কাজকে তুলে ধরার জন্য, তাঁদের কাজের শ্রমঘণ্টা বা টাইম ইউজ সার্ভের মাধ্যমে নিয়মিতভাবে তথ্য উপস্থাপনের ব্যবস্থা সরকারকে নিতে হবে। নারীর কর্মঘণ্টার হিসাব দিয়ে একটি নিয়মিত ও সমন্বিত তথ্যভান্ডার তৈরি করাটা জরুরি। এ কাজে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) একটি মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারবে। সেই সঙ্গে অবকাঠামোতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, যেন গৃহস্থালি কাজে ও সেবামূলক কাজে নারীর দায়িত্ব সহজ করা যায়। মোটকথা, অমূল্যায়িত সেবাকাজকে জেন্ডার রেসপনসিভ বাজেটিংয়ের সঙ্গে একীভূত করতে হবে।

আরও পড়ুন

এবার গ্রামীণ নারী ও অনানুষ্ঠানিক কাজে নিয়োজিত নারীর কাজের দিকে একটু দৃষ্টি ফেরাতে চাই। ২০২২ সালে পাঁচটি বেসরকারি সংস্থার একটি ফোরাম ‘ফরমাল রিকগনিশন অব দ্য ওম্যান’স আনকাউন্টেড ওয়ার্ক’-এর উদ্যোগে একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে কাজে নিযুক্ত মানুষের মধ্যে ৯১ দশমিক ৩ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন, যাঁদের মধ্যে ৯৬ দশমিক ৭ শতাংশ নারী। এ ছাড়া দেশে নারীপ্রধান পরিবারগুলো অধিকাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতের।

অনেক আগে থেকেই গ্রামীণ নারীরা কৃষি খাতে অবদান রাখছেন। অধুনা সেই হার বেড়েছে। বাংলাদেশে মোট ৫ কোটি ৬৭ লাখ কর্মজীবী মানুষের মধ্যে ৪৭ দশমিক ৬ শতাংশ লোক কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। আবার তাঁদের মধ্যে ৬৪ দশমিক ৮ শতাংশই নারী। সংসারের কাজ করার পাশাপাশি আবাদ-পরবর্তী কাজ, গবাদিপশুর দেখাশোনা, দুধ আহরণ, ছাগলের চাষ, বাড়ির ভেতরের সবজিবাগান এবং বীজ সংরক্ষণের মতো জরুরি কাজগুলো নারীরাই করেন। আরও আছে জমি তৈরি, চারা রোপণ, সার দেওয়া, পোকানাশকের ব্যবহার, বীজ তৈরি, চাষাবাদ, শস্য জমি থেকে বাড়িতে নেওয়া, ফসল ভাঙানো, বাছাই ও প্যাকেটজাত করা।

তাই আমরা আশা করব, খুব তাড়াহুড়ো না করে নারীর অমূল্যায়িত কাজের হিসাব এমনভাবে নির্ধারিত হওয়া উচিত, যাতে শহর ও গ্রামের কোনো নারীর কাজই হিসাব থেকে বাদ না পড়ে।

  • শাহানা হুদা যোগাযোগকর্মী