হাওরের পানি নাইরে হেথায়/ নাইরে তাজা মাছ,/ বিলের বুকে ডানা মেলা/ নাইরে হিজলগাছ। —হেমাঙ্গ বিশ্বাস।
‘গত বছর যখন বালু তোলা বন্ধ আছিল, সেবার দুই বিঘা জমি ভাসিছিল (জেগেছিল)। তহন ওই জমিত পিঁয়াজ ও বোরো নাগাইছলাম। বেটিজামাই আরেকটা বিয়া করি আলাদা খায়। এবার জমি নাই, কী খামো?’ বলছিলেন তিনটা নাতি-নাতনি, বেটিসহ পাঁচজনের সংসার সামলানো মোমেনা বেওয়া (৬৫)। থাকেন বাণ্ডালের চরের সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে।
বজলার রহমান (৬০)। আগে রমনা রেলস্টেশনে দোকান ছিল। ট্রেন চলে না, তাই ব্যবসাও নেই। বাড়ি ব্যাঙমারা ঘাটসংলগ্ন সরকারবাড়ি গ্রামে। তিনি বলেন, ‘এক যুগ আগে গণকমিটির আন্দোলনে নদী যখন বান্ধিল, তখন কিনার দিয়া জমি জাগি উঠছিল। ভাইবলেম, এখন তো বছর বছর জমি উঁচা হইবে। দোকান গেইছে, আল্লাহ জমি দিছে। ব্রহ্মপুত্রের পলি পড়া জমি। সেই উর্বর জমি। কিসের কী, বালুওলারা বোলগেট (বাল্কহেড) দিয়ে জমি খায়া ফেলাইল। কত মিছিল-মিটিং কইরলেম। যামরা বালু তোলে, তামরায় তো মেম্বর-চেয়ারম্যান-এমপি।’
যারা একসময় অন্যের কাছ থেকে ‘বিড়ি চেয়ে’ খেত, তাদের অনেকে এখন কোটি টাকার মালিক। তিন–চারতলার বিশাল প্রাসাদের মালিক। সেই দাপটে তারা কেউ জনপ্রতিনিধি, কেউ জনপ্রতিনিধির লোক। এরাই চেয়ারম্যান বানায়, এমপি বানায়। ইউরোপ–আমেরিকায় যাদের বাড়ি-গাড়ি, তাদের স্থানীয় লাঠিয়াল এরাই। এদের আশ্রয়দানকারীরা লাভের গুড় ইউরোপ-আমেরিকায় পাঠায়।
অজিত সরকার (৫০)। পেশায় ভাসমান শ্রমিক। বালু উত্তোলনবিরোধী একজন সংগঠক। বর্ষায় মাছ ধরেন। যখন যে কাজ পান, তা-ই করেন। চরে তাঁর দু-তিনটি গরু চরে বেড়ায়, পেট ভরলে নদী পার হয়ে বাড়ি ফেরে। আগে কাশিয়া কেটে আনতেন জ্বালানির জন্য। সেই এজমালি জমিগুলো ভূমিহীনের নামে মেম্বর-চেয়ারম্যান আর দলের লোকেরা ভাগ করে নিয়েছে। ব্রহ্মপুত্র জমি ভেঙে নেওয়ার আগে যে দু-চার বিঘা জমি ছিল, তা দিয়ে ছিল তাঁর সুখের সংসার। ঢাকা যাওয়ার দরকার পড়েনি কখনো। তিনি বলেন, ‘ভাই, নিজের বাড়িতে থাকি, মাঝে মাঝে মাছ মারি, গরুর দুধ খাই, লাউ-কুমড়া ঘরের ওপরে তুলি দিছি। জমির আবাদ পাইলে হামরা ক্যা ঢাকা যাই। বালুওলারা হামার জীবনডা শ্যাষ করি দিলে। যাকে ভোট দেই, তাই পদ পায়া বালুর পয়েন্টের মালিক হয়।’
‘নদীত মাছ নাই। বউ-ঝিরা চর থাকি খড়ি কাটি আনে। সেই জমিত এলা ভুট্টা নাগাইছে। বাঁচার রাস্তা নাই। গ্রামোত কোনো পুরুষ মানুষ খুঁজি পাবার নন। সবাই ধারদেনা করি ঢাকা চলি গেইছে। সরকারের খালি ইলিশত নজর, বাকি মাছও যে শ্যাষ হয়া গেইলো, সেইগলে দেখে না।’ বলছিলেন জোড়গাছ মাঝিপাড়ার ভারত চন্দ্র দাস (৪৫)।
আচ্ছা, বালু না তুললে বিল্ডিং কেমনে হবে? জানতে চাইলে চিলমারীর সাবেক উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবদুল মান্নান সরকার বলেন, ‘বাল্কহেড আসার আগে নৌকায় করে তুলত। বেশি শ্রমিক লাগত, বেশি কর্মসংস্থান হতো। ফলে যতটুকু বালু লাগত, ততটুকুই বালু উঠত। এখন চিলমারীর বালু সারা দেশে যাচ্ছে। রাস্তার পাশের পুকুর-দিঘি সবকিছুই ভরাট করা হচ্ছে। আগে সড়ক বানাতে হলে সড়কের পাশে জলাধার সৃষ্টি হতো। রাস্তার ধুলাকে খালের জলীয় বাষ্প মেকআপ করত। এখন রাস্তায় শ্বাস নেওয়া যায় না। কৃষক-জেলের ওপর এই জুলুম কি সহ্য হবে?’
ফলাফল হিসেবে প্রাণবৈচিত্র্য, মাটির স্বাস্থ্য, খাদ্যনিরাপত্তা, খাদ্যবৈচিত্র্য, খাদ্যের ভারসাম্য ও তাজা খাবারের জোগান অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে কৃষক-জেলে-তাঁতির ও গ্রামবাসীর।
সুস্ফীত জোয়ার নাকি সব নৌকাকেই ওপরে তোলে। বরং উল্টো ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সবার ঘরে হয়তো টেলিভিশন এসেছে, কিন্তু পুষ্টি ভোগের পরিমাণ কমে গেছে। রাষ্ট্রের কর্তব্য ছিল, যে স্থানিক জীবনে নাগরিকেরা আছেন, সেটাকে অব্যাহত রাখা। কিন্তু জনগণকে গ্রাম থেকে উচ্ছেদ না করলে তো বিদেশে বাড়ি হবে না।
২.
বন কেটে সেই গাছ দিয়ে ফার্নিচার বানালে তা জিডিপিতে যুক্ত হয়, কিন্তু প্রতিবেশের জন্য জরুরি বন জিডিপির হিসাবের মধ্যে পড়ে না। বাজারের কর্মকাণ্ড আর টাকার হাতবদলের একধরনের মাপ হলো জিডিপি। ক্যানসার কিংবা অপরাধ সংঘটন কিংবা নদীদূষণে যে ব্যয় হয়, তা–ও জিডিপির অংশ।
ফলে খুব সামান্য পয়সার লেনদেনে সচল থাকতে পারে—এমন স্বনির্ভর স্থানীয় অর্থনীতি অবিরত ধসে পড়তে থাকে। প্রান্তিক মানুষ টিকে থাকতে না পেরে শহরমুখী হয়। জানা কথা যে, জিডিপি বাড়লেও রাষ্ট্র ও সমাজের সম্পদ কমতে পারে। যেমন একজন বালুদস্যুর টাকা বাড়লে কয়েক শত কৃষক-জেলের জীবনযাত্রার মান হ্রাস পায়।
জিডিপির বিকল্প হিসেবে দুটি পরিমাপ পদ্ধতি ইদানীং চালু হয়েছে। একটি হচ্ছে ‘জিপিআই’ পদ্ধতি, যার পূর্ণরূপ হচ্ছে জেনুইন প্রোগ্রেস ইন্ডিকেটর বা প্রকৃত অগ্রগতি সূচক। এ ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক, পরিবেশগত ও সামাজিক জটিল বিষয়ের প্রকৃত লাভ-ক্ষতি একটি সমন্বিত হিসাবের মধ্যে আনা হয়। পৃথিবীর ২০টি দেশে ও যুক্তরাষ্ট্রের ২০টি অঙ্গরাজ্যে এই পদ্ধতিতে পরিমাপ করা হয়। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে ভুটানের ‘জাতীয় সুখের সূচক’ বা ‘গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস’।
করোনাকালে অনেকেই ঢাকা থেকে ফিরেছেন। ভূমিনির্ভর অর্থনীতিকে একেবারে খানখান করে ভেঙে দেওয়া হয়েছে। মানুষকে আশ্রয় খুঁজে নিতে হয়েছে শহরের রুক্ষ-কঠিন বস্তিতে। সমস্ত মানবিক মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে নামতে হয়েছে নির্মম প্রতিযোগিতায়। কারণ, দেশজ পদ্ধতিতে ন্যূনতম যান্ত্রিকতা ব্যবহার করে হরেক রকম খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করা যায়। ভূমিতে বহু মানুষকে যুক্ত করার মাধ্যমে কর্মসংস্থান হয়। স্থানীয়করণ সম্পর্কজালের মধ্যে মানুষকেন্দ্রিক অর্থনীতি এগিয়ে যায়।
পথ দুটি। একটি অতি গতিসম্পন্ন, বৃহৎ, একমুখী ও প্রযুক্তিতাড়িত যান্ত্রিক সংস্কৃতির মহাসড়ক। আরেকটি ধীরগতির। ফিরে আসার, গভীর আত্মীয়তার ও সম্পর্ক পুনরুজ্জীবনের। করোনাকাল দ্বিতীয় পথটি গ্রহণের ডাক দিয়েছে।
৩.
যারা একসময় অন্যের কাছ থেকে ‘বিড়ি চেয়ে’ খেত, তাদের অনেকে এখন কোটি টাকার মালিক। তিন–চারতলার বিশাল প্রাসাদের মালিক। সেই দাপটে তারা কেউ জনপ্রতিনিধি, কেউ জনপ্রতিনিধির লোক। এরাই চেয়ারম্যান বানায়, এমপি বানায়। ইউরোপ–আমেরিকায় যাদের বাড়ি-গাড়ি, তাদের স্থানীয় লাঠিয়াল এরাই। এদের আশ্রয়দানকারীরা লাভের গুড় ইউরোপ-আমেরিকায় পাঠায়। এখানে দুদকও চুপ। সুষ্ঠু নির্বাচন চাইলে স্থানীয় লাঠিয়াল, বালুদস্যুদেরও ঠেকাতে হবে।
নাহিদ হাসান লেখক ও সংগঠক।
[email protected]