আদানি ইস্যুতে যে কারণে বিজেপি সরকার চুপ

গৌতম আদানি

‘চক্রান্তকারীরা যখন একটি গোপন ঘরে নিঃশব্দে ষড়যন্ত্র করে, তখন সেখানে একটি সত্য শব্দও পিস্তলের গুলির মতো মনে হয়’—নোবেলজয়ী লেখক চেশোয়াভ মিউশ (১৯১১-২০০৪)।

গত ২৪ জানুয়ারি পুরো ভারত যখন প্রজাতন্ত্র দিবস (২৬ জানুয়ারি) উদ্‌যাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ সবাইকে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে ব্যাপক ধাক্কা দেয়। রিপোর্টে যা বলা হলো, তার মোদ্দাকথা হলো বিশ্বের ওই সময়কার তৃতীয় ধনী গৌতম আদানি করপোরেট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি করেছেন।

হিন্ডেনবার্গ অভিযোগ করল, আদানি গ্রুপ কয়েক দশক ধরে শেয়ার কারসাজি, অর্থ পাচার ও হিসাব জালিয়াতিতে জড়িত। তাদের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, আদানি গ্রুপের তালিকাভুক্ত যে সাতটি কোম্পানি পুঁজিবাজারে আছে, তার সব কটির শেয়ার ৮৬ শতাংশের বেশি অতিমূল্যায়িত। তবে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, আদানি গ্রুপের করপোরেট প্রশাসন ‘ট্যাক্স হেভেন’খ্যাত সাইপ্রাস, মৌরিতিয়াস, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বেশ কয়েকটি দেশে আদানি পরিবার কাগুজে প্রতিষ্ঠানের ‘একটি বিশাল গোলকধাঁধা’ তৈরি করেছে। হিন্ডেনবার্গের দাবিমতে, সেখানে তাদের না আছে কোনো কর্মচারী, না আছে ঠিকানা, না আছে ফোন নম্বর, না অনলাইন উপস্থিতি। তা সত্ত্বেও প্রায় কাগুজে এসব প্রতিষ্ঠানের নামে এই গ্রুপটি সমন্বিতভাবে কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ এনেছে এবং সেসব চুক্তির প্রয়োজনীয় যে দিকগুলো জনসমক্ষে প্রকাশ করার কথা, তা তারা করেনি। গৌতম আদানির দুই ভাই বিনোদ আদানি ও রাজেশ আদানি ছাড়াও তাঁর শ্যালক শমীর ভোরা এসব কাগজসর্বস্ব কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

আদানি গ্রুপ হিন্ডেনবার্গের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা অভিযোগগুলো খণ্ডন করার জন্য গত ২৯ জানুয়ারি ৪১৩ পৃষ্ঠার একটি বিবৃতি দিয়েছে। সেখানে তারা পাল্টা অভিযোগ করে বলেছে, হিন্ডেনবার্গ ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা করে ভারতের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, ঐক্য এবং ভারতের প্রতিষ্ঠানগুলোর ভাবমূর্তিকে খাটো করতেই এই প্রতিবেদন বানিয়েছে। আদানি গ্রুপ হয়তো আশা করেছিল, তাদের এই জাতীয়তাবাদী বিবৃতির নিচে সব অভিযোগ চাপা পড়ে যাবে। কিন্তু দেখা গেল, তাদের শেয়ারের দর হুড়মুড় করে পড়তে শুরু করেছে।

হিন্ডেনবার্গ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করার এক দিন পরই আদানি গ্রুপ শেয়ার মার্কেটে ৯০০ কোটি ডলার হারায় এবং সেই পতনের ধারা চলতেই থাকে। এখন পর্যন্ত আদানির ১২ হাজার কোটি ডলারের বেশি লোকসান হয়েছে, যা ভারতের বার্ষিক অবকাঠামো বাজেটের সমান। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো ভারতের সবচেয়ে বড় সরকারি বিমা কোম্পানি লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি অব ইন্ডিয়া (এলআইসি) আদানি কোম্পানিতে ৪ হাজার ৪৭০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছিল, যা ফেরত পাওয়ার আশা এখন হুমকির মুখে পড়েছে। এ ছাড়া সরকারি ব্যাংক থেকেও বিপুল অঙ্কের ঋণ নিয়েছে কোম্পানিটি।

কেউ কোনো দলে অর্থ চাঁদা হিসেবে দিলে তাঁকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইস্যু করা নির্বাচনী বন্ড কিনে দিতে হবে। সেই বন্ড দলগুলো ব্যাংক থেকে ভাঙিয়ে নিতে পারবে। নির্বাচনী বন্ড যিনি কিনবেন, তাঁকে তাঁর নাগরিকত্ব–সংক্রান্ত তথ্য জমা দিতে হবে। বিরোধী দলগুলো ওই সময় অভিযোগ করেছিল, তাদের টার্গেট করেই মোদি সরকার এই বন্ড চালু করেছে। তাঁদের অভিযোগ, কোন ব্যক্তি বা কোন প্রতিষ্ঠান তাদের চাঁদা দিচ্ছে, তার ওপর নজরদারি করতে এই ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে।

এখন আদানির বিপর্যয়ের অভিঘাত ভারতকে যে বড় ধাক্কা দিয়েছে, তা নিয়ে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার মুখে কুলুপ এঁটে আছে। বিরোধী দলগুলো প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির চুপ থাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে এবং এ বিষয়ে একটি যৌথ সংসদীয় কমিটি গঠনের দাবি করেছে তারা। কিন্তু সরকার গোটা ইস্যুকেই ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে।

এ অভিযোগগুলো ঢেকে রাখার চেষ্টার মূল কারণ ইতিমধ্যে বলা যায় সবার কাছেই খোলাসা হয়ে গেছে। মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকা অবস্থাতেই তাঁর সঙ্গে আদানির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সেই সম্পর্ক এত দিনে বহুদূর গড়িয়েছে, যদিও আদানি তাঁর সঙ্গে মোদির ঘনিষ্ঠতা থাকার কথা বরাবরই অস্বীকার করে আসছেন। মোদিও আদানির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতার কথা স্বীকার করেন না। কিন্তু বাস্তব অবস্থা ঠিক তার উল্টোটা বলছে।

আরও পড়ুন

মোদির সরকার চায় না আদানি ইস্যুতে পার্লামেন্টে আলোচনা হোক। এর আসল কারণ স্বয়ং মোদি। কারণ, মোদি নিজে আদানি গ্রুপের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছেন।

বিশেষ করে ২০১৭ সালে ভারতে যে নির্বাচনী সংস্কার হয়েছিল, তার সঙ্গেও এর প্রধান কারণ লেপ্টে আছে। ওই বছর মোদি ভোটে টাকার খেলা বন্ধ করতে এবং নির্বাচনে স্বচ্ছতা আনতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সেই সংস্কার উদ্যোগে বলা হয়েছিল, মূলধারার কোনো রাজনৈতিক দলকে যদি কেউ ২০ হাজার রুপির কম চাঁদা দেয়, তাহলে দলটি চাঁদাদাতার নাম গোপন রাখতে পারবে।

কেউ কোনো দলে অর্থ চাঁদা হিসেবে দিলে তাঁকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইস্যু করা নির্বাচনী বন্ড কিনে দিতে হবে। সেই বন্ড দলগুলো ব্যাংক থেকে ভাঙিয়ে নিতে পারবে। নির্বাচনী বন্ড যিনি কিনবেন, তাঁকে তাঁর নাগরিকত্ব–সংক্রান্ত তথ্য জমা দিতে হবে। বিরোধী দলগুলো ওই সময় অভিযোগ করেছিল, তাদের টার্গেট করেই মোদি সরকার এই বন্ড চালু করেছে। তাঁদের অভিযোগ, কোন ব্যক্তি বা কোন প্রতিষ্ঠান তাদের চাঁদা দিচ্ছে, তার ওপর নজরদারি করতে এই ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে।

আরও পড়ুন

দেখা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে যত বন্ড বিক্রি হয়েছে, তার দুই–তৃতীয়াংশই বিজেপির ফান্ডে জমা পড়েছে। নির্বাচন কমিশনের ২০২১ সালের রিপোর্ট বলছে, টানা সপ্তম বছরের মতো নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে বিজেপি সবচেয়ে বেশি করপোরেট চাঁদা পেয়েছে। নিশ্চিতভাবেই এখানে স্বার্থ সংঘাতের ব্যাপার ঘটেছে। যদি মোদি করপোরেটদের বিরুদ্ধে যান তাহলে নিশ্চিতভাবে বিজেপির করপোরেট চাঁদা কমে যাবে। আর যদি করপোরেশনগুলোর বিরুদ্ধে সরকার কোনো ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে তাঁদের তহবিলে করপোরেট ব্যবসায়ীদের চাঁদাদান বাড়তেই থাকবে। অর্থাৎ এ ব্যবস্থায় করপোরেট ও বিজেপি—উভয়েরই জয় নিশ্চিত হয়; কিন্তু সেটি হচ্ছে সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত সঞ্চয়কে বলি দেওয়ার বিনিময়ে।

কিন্তু এখন আদানি ইস্যু এবং করপোরেট অব্যবস্থাপনাজনিত কোটি কোটি ডলারের ক্ষতি কি ভারতের মানুষ শুধু মোদির ভাবমূর্তি বাঁচানোর স্বার্থে মেনে নেবে?

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

● রবি কান্ত এশিয়া টাইমস–এর দিল্লি সংবাদদাতা