ইসি কি তার ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা রাখে

নির্বাচন কমিশন সম্প্রতি গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ (আরপিও) সংশোধনের একটি প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের জন্য পাঠিয়েছে, যাতে এর ১৭টি ধারা সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে তিনটি প্রস্তাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি এবং দুটি প্রস্তাব নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন।

নির্বাচন কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবগুলোর একটি হলো রাজনৈতিক দলের সব কমিটিতে ২০৩০ সালের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা (ধারা ৯০-বি), যা আমরা সমর্থন করি।

দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবটি হলো, মনোনয়নপত্রের সঙ্গে প্রার্থীদের টিন সার্টিফিকেট ও আয়কর প্রদানের রসিদ বা প্রত্যয়নপত্র প্রদান (ধারা ১২-তে সংযুক্তি)। বর্তমানে আরপিওর ৪৪ক (২) ধারায় আয়কর রিটার্ন প্রদানের বিধান রয়েছে।

তাই আরপিওর ১২ ধারায় শুধু আয়কর রিটার্নের প্রত্যয়নপত্র-সম্পর্কিত নতুন বিধান যুক্ত করলে একটি ভুল-বোঝাবুঝি সৃষ্টি হতে পারে—কোনো কোনো প্রার্থী মনে করতে পারেন যে তাঁদের আর আয়কর রিটার্ন জমা দিতে হবে না। আরপিওর ৪৪ক(২) ধারায় আয়কর রিটার্নের কপি জমা দেওয়ার সুস্পষ্ট বিধান থাকলেও অতীতে অনেকেই শুধু প্রত্যয়নপত্র জমা দিয়ে, এমনকি আয়কর প্রদানের কোনোরূপ দালিলিক প্রমাণ জমা না দিয়েই নির্বাচনী বৈতরণি পার হতে পেরেছেন। তাই সম্ভাব্য ভুল-বোঝাবুঝি এড়াতে আরপিওর ধারা ১২-তেই আয়কর রিটার্ন দেওয়ার বিধান সংযুক্ত করা যুক্তিযুক্ত বলে আমরা মনে করি।

আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিংয়ের জন্য প্রেরিত নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাবে তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, কোনো ব্যক্তি বলপূর্বক নির্বাচনী কর্মকর্তাদের স্বাভাবিক নির্বাচনী কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে বাধা প্রদান করলে প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে তাৎক্ষণিকভাবে নির্দিষ্ট কেন্দ্র, এমনকি পুরো নির্বাচনী এলাকার ভোট গ্রহণ বন্ধ করার ক্ষমতা প্রদান (ধারা ২৫ এ-তে সংযুক্তি)।

একই সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের কারণে ভোট চলাকালে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করা সম্ভব নয় বলে প্রতীয়মান হলে নির্বাচন কমিশনকে তদন্ত সাপেক্ষে পুরো নির্বাচনী এলাকার নির্বাচনী ফলাফলের গেজেট প্রকাশ ঘোষণা স্থগিত, নির্বাচনী ফলাফল বাতিল ও পুনর্নির্বাচনের নির্দেশ প্রদানের ক্ষমতা প্রদান। এ প্রস্তাব নিয়ে আমরা কিছুটা বিভ্রান্ত। কারণ, নির্বাচন ও গেজেট প্রকাশ স্থগিত ও পুনর্নির্বাচনের নির্দেশ প্রদানের ক্ষমতা ইতিমধ্যে কমিশনের রয়েছে এবং কমিশন তা ব্যবহারও করে আসছে।

আমাদের উদ্বেগের কারণটি হলো যে সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশন যেন তার ক্ষমতার ব্যাপ্তি সম্পর্কে অবগত নয় বা উপলব্ধি করতে পারছে না।

আমরা মনে করি, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে বর্তমানে সবচেয়ে বড় বাধা বিদ্যমান বিধিবিধানের পরিপূর্ণ প্রয়োগ না হওয়া। তাই বিদ্যমান বিধিবিধানগুলোর কঠোর প্রয়োগের দিকে কমিশনের নজর দিতে হবে

আমাদের নির্বাচন কমিশন অসামান্য ক্ষমতাধর একটি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশনকে চারটি সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। নির্বাচন ‘তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কমিশনকে সুস্পষ্টভাবে দেওয়া হয়েছে।

আলতাফ হোসেন বনাম আবুল কাসেম মামলায় [৪৫ ডিএলআর (এডি) (১৯৯৩) ] আমাদের আপিল বিভাগ রায় দেন, ‘আমাদের নির্বাচন-সংক্রান্ত আইনি কাঠামোতে “তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণে”র বিধানের অধীনে প্রদত্ত অন্তর্নিহিত ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে নির্বাচন কমিশন শুধুমাত্র সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে আইনি বিধিবিধানের সঙ্গে সংযোজনও করতে পারে।’ অর্থাৎ, নির্বাচনের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা প্রায় নিরঙ্কুশ এবং আইন যেখানে অসম্পূর্ণ, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে কমিশন নির্দেশনা জারির মাধ্যমে সেই অসম্পূর্ণতাও দূর করতে পারে।

সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে শুধু বিধিবিধানের সঙ্গে সংযোজনই নয়, ফলাফল ঘোষণার পরও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতা কমিশনকে সুস্পষ্টভাবে দেওয়া হয়েছে। নূর হোসেন বনাম মো. নজরুল ইসলাম মামলার [৫ বিএলসি (এডি) (২০০০)] রায়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বলেন, ‘আমরা এ কথা পুনর্ব্যক্ত না করে পারি না যে নির্বাচন চলাকালে গোলযোগের, ব্যালট পেপার কারচুপির বা নির্বাচন সঠিক, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন হয়নি বলে রিপোর্ট বা অভিযোগ উত্থাপিত হলে, উক্ত রিপোর্ট বা অভিযোগের সত্যতা যাচাইপূর্বক কমিশনের ফলাফল বাতিল ও পুনর্নির্বাচনের নির্দেশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক।’

নির্বাচন কমিশন যদি মনে করে যে নূর হোসেন বনাম নজরুল ইসলাম মামলার রায় আইনে অন্তর্ভুক্ত হওয়া প্রয়োজন, তবু এর জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হওয়াটা আত্মঘাতী হতে পারে—মন্ত্রণালয় কমিশনের প্রেরিত প্রস্তাবটি নাকচ করে দিতে পারে। আমাদের উদ্বেগ এ কারণেই। কমিশন পরিপত্র জারি করে বা বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা ব্যবহার করেই তা করতে পারে।

আমরা উদ্বিগ্ন যে কমিশনের প্রস্তাবগুলো অসম্পূর্ণ এবং এতে আরও অনেক বিষয় যুক্ত হওয়া আবশ্যক। আমাদের উদ্বেগের আরেকটি কারণ হলো, মন্ত্রণালয়ে প্রেরণের আগে প্রস্তাবটি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে নাগরিকদের মতামত গ্রহণের প্রয়োজনীয়তাও কমিশন উপলব্ধি করেনি।

নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও অর্থবহ করার লক্ষ্যে নিম্নের বিষয়গুলো আরপিওতে অন্তর্ভুক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ বলে আমরা মনে করি: ১. ‘না-ভোটে’র পুনঃপ্রবর্তন করা; ২. হলফনামার ছকে পরিবর্তন আনা এবং এতে নতুন কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা; ৩. হলফনামায় মিথ্যা তথ্য প্রদান বা তথ্য গোপনকারীদের মনোনয়নপত্র বাতিলের সুস্পষ্ট বিধান করা; ৪. হলফনামার তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের বিধান করা;

৫. প্রত্যেক প্রার্থীর নির্বাচনী ব্যয়ের হিসাব যাচাই-বাছাইয়ের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করা; ৬. নির্বাচনী ব্যয় কমানোর লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রার্থী ও ভোটারদের নিয়ে প্রতিটি সংসদীয় এলাকায় একটি ‘জনগণের মুখোমুখি অনুষ্ঠান’ আয়োজন এবং হলফনামার তথ্য ছাপিয়ে তা ভোটারদের মধ্যে বিলির বিধান করা; ৭. সংরক্ষিত নারী আসনের ক্ষেত্রে মনোনয়নপত্রের সঙ্গে হলফনামা ও আয়কর বিবরণী দাখিলের বিধান করা;

আরও পড়ুন

৮. রাজনৈতিক দলের প্রাথমিক সদস্যদের নাম ওয়েবসাইটে প্রকাশ ও নিয়মিত আপডেটের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করা; ৯. নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া রাজনৈতিক দলের অডিট করা হিসাব যাচাই-বাছাইয়ের বিধান করা; ১০. বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশের নাগরিকদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পোস্টাল ব্যালটের ব্যবস্থা করা;

১১. সংসদ নির্বাচনে নির্বাচনী বিরোধ নিষ্পত্তিতে ব্যয় সংকোচন ও দীর্ঘসূত্রতা অবসানের লক্ষ্যে জেলা জজদের নিয়ে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল গঠন করা এবং উচ্চ আদালতে আপিলের সুযোগ রাখা; ১২. রিটার্নিং কর্মকর্তার মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনে দায়েরকৃত আপিল নিষ্পত্তি করার সময়সীমা বর্তমানের তিন দিনের পরিবর্তে এক সপ্তাহ করা।

আমরা মনে করি, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে বর্তমানে সবচেয়ে বড় বাধা বিদ্যমান বিধিবিধানের পরিপূর্ণ প্রয়োগ না হওয়া। তাই বিদ্যমান বিধিবিধানগুলোর কঠোর প্রয়োগের দিকে কমিশনের নজর দিতে হবে।

  • ড. বদিউল আলম মজুমদার সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)