গুজরাটে ধর্ষকেরা মুক্ত: বিলকিসের ন্যায়বিচার এভাবে শেষ হবে?

গুজরাটের ওই গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া কিন্তু দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার মুসলিম নারী বিলকিস বানু

কয়েকজন ধর্ষক ও খুনির জন্য ভারতের এবারের স্বাধীনতা দিবস আক্ষরিক অর্থেই স্বাধীনতা দিবস ছিল। ২০০২ সালে গুজরাটে মুসলমানদের ওপর গণহত্যা চালানো এবং মুসলিম নারীদের দলবদ্ধ ধর্ষণ করার দায়ে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ১১ আসামিকে ১৫ আগস্ট খালাস দেওয়া হয়। রাজ্য সরকার তাঁদের সাজা মওকুফের নির্দেশ দিয়েছে। এটা কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয় যে তাঁদের মুক্তি এমন দিনে দেওয়া হয়েছে, যে দিনে ভারত উপনিবেশবাদ থেকে স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকী উদ্‌যাপন করছিল। কারাগার থেকে বের হওয়ার সময় খালাসপ্রাপ্ত আসামিদের গলায় মালা পরানো হয়, যেন তাঁরা বীরোচিত কোনো কাজ করেছিলেন।

গুজরাটের ওই গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া কিন্তু দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হওয়া মুসলিম নারীদের একজন হলেন বিলকিস বানু। ধর্ষকদের খালাস পাওয়ার খবর শুনে তিনি হতবাক হয়েছেন। তিনি অবিশ্বাসমাখা কণ্ঠে বলেছেন, ‘যেকোনো নারীর ওপর এমন অত্যাচারের কীভাবে এমন বিচার হতে পারে?’

এই যে যাঁরা খালাস পেলেন, তাঁরা যে তিনজন নারীকে দলবদ্ধ ধর্ষণ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে বিলকিসও ছিলেন। সে সময় তিনি পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। এই আসামিরা তাঁকে দলবদ্ধ ধর্ষণ করার সময় তাঁর চোখের সামনে তাঁর তিন বছরের মেয়ে সালেহার মাথা থেঁতলে দিয়ে হত্যা করেন। সেখানে উপস্থিত থাকা স্বজনদের মধ্যে একমাত্র বিলকিস প্রাণে বেঁচে যান। বাকি ১৪ জনকে সেখানেই এই আসামিরা মেরে ফেলেন।

সেই মুহূর্ত থেকে বিলকিস তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন গুজরাট রাজ্য সরকারের শক্তির সামনে দাঁড়িয়ে লড়াই করে আসছিলেন। ভারতের প্রধান তদন্তকারী সংস্থা সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (সিবিআই) প্রতিবেদনমতে, বিলকিস প্রায় নগ্ন অবস্থায় স্থানীয় থানায় গিয়ে মামলা করেছিলেন এবং যে পুলিশ কর্মকর্তা তাঁর মামলাটি নথিভুক্ত করেছিলেন, তিনি মামলাটিকে দুর্বল করতে তাঁর জবানবন্দিকে বিকৃত করেছিলেন। একটি আদালত পরে দেখেছেন, পুলিশ কর্মকর্তারা এবং চিকিৎসকেরা তাঁদের প্রতিবেদনে ফাঁকি দিয়েছেন; তাঁরা ময়নাতদন্তের প্রক্রিয়ায় নয়ছয় করার চেষ্টা করেছেন এবং রেকর্ডগুলোকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে আলামত নষ্ট করার চেষ্টা করেছেন। ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশন (এনএইচআরসি) যখন বিলকিসের মামলাটি নিয়েছিল, তখনই বিচারের চাকা ধীরে ধীরে ঘুরতে শুরু করেছিল। মামলাটি গুজরাটের বাইরে সরানো হয়েছিল। কারণ, সুপ্রিম কোর্ট নিশ্চিত হয়েছিলেন, গুজরাটে এই মামলার সুষ্ঠু বিচার সম্ভব নয়। ২০০৮ সালে মুম্বাইয়ের একটি বিশেষ আদালত ধর্ষণ ও হত্যায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দোষী সাব্যস্ত করেন এবং উচ্চ আদালতের রায়েও তা বহাল ছিল।

এই রায়ের মধ্য দিয়ে বিলকিস এবং তাঁর পাশে দাঁড়ানো সবাইকে এই বার্তা দেওয়া হয়েছে: মোদির ভারতে ন্যায়বিচারের লড়াই এভাবেই শেষ হবে; মুসলমানদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ, এমনকি তা যদি গণহত্যা এবং দলবদ্ধ ধর্ষণও হয়, সেটিকেও হালকাভাবে নেওয়া হবে। মোদির শাসনাধীন গুজরাটে বিলকিসকে প্রথমে তাঁর জীবন বাঁচাতে পালাতে হয়েছিল এবং রাজ্য সরকারের কাছ থেকে লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল। আজকে মোদির শাসনাধীন গোটা ভারতে তাঁর লড়াই চালানো আরও অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতের ২০ কোটি মুসলমানের ওপর এর প্রভাব আরও ভয়ানক।

এটা শুধু একা বিলকিস বানুর বিষয় ছিল না। এটি গুজরাটে ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া মুসলিম নারী-পুরুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয় ছিল। মামলা চলাকালে বিলকিস বানুকে নিরাপত্তার জন্য লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল এবং প্রতিনিয়ত আশ্রয় বদল করতে হয়েছিল। সে সময় বহু নারীবাদী, মানবাধিকার আন্দোলনকর্মী ও সংগঠন বিলকিসের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। ২০০২ সালে যাঁরা ওই ঘটনা ঘটিয়েছিলেন, তাঁদের কারুরই কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের রেকর্ড ছিল না। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত না থাকা মানুষও যখন শুধু ধর্মের দোহাই দিয়ে নিরপরাধ নারীদের ধর্ষণ এবং পুরুষদের হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন ব্যাপারটি অধিকতর জঘন্য হয়ে ওঠে।

এখন ন্যায়বিচারকে পদদলিত করা হচ্ছে। দোষী সাব্যস্তদের মধ্যে একজন মুক্তির জন্য সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করার পর শীর্ষ আদালত গুজরাট রাজ্য সরকারকে সাধারণ ক্ষমার বিষয়ে রাজ্যের ২০০২ সালের মওকুফ নীতি মেনে কাজ করতে বলেছিলেন। সেই নীতির ফাঁকফোকর ব্যবহার করে গুজরাট সরকার বিজেপি সদস্যদের বেছে নিয়ে একটি কমিটি নিযুক্ত করে। সেই কমিটি আসামিদের সাজা মওকুফের সুপারিশ করে। বিলকিস যেখানে থাকেন, তার আশপাশেই ছাড়া পাওয়া এই ধর্ষকদের বাড়ি। এ কারণে আরও একবার তাঁর জীবনহানির আশঙ্কা থাকছে।

আরও পড়ুন

কিন্তু কথা হলো স্বাধীনতা দিবসেই কেন আসামিদের খালাস দেওয়া হলো? বিশেষ করে মোদি রায়টি ঘোষণার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে নারীদের সম্মান করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন, ঠিক সে সময় এই রায় সবাইকে হতবাক করেছে। এটি অকল্পনীয় যে গুজরাট সরকার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর সম্মতি ছাড়াই দোষী ব্যক্তিদের মুক্তির ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছিল।

এই রায়ের মধ্য দিয়ে বিলকিস এবং তাঁর পাশে দাঁড়ানো সবাইকে এই বার্তা দেওয়া হয়েছে: মোদির ভারতে ন্যায়বিচারের লড়াই এভাবেই শেষ হবে; মুসলমানদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ, এমনকি তা যদি গণহত্যা এবং দলবদ্ধ ধর্ষণও হয়, সেটিকেও হালকাভাবে নেওয়া হবে। মোদির শাসনাধীন গুজরাটে বিলকিসকে প্রথমে তাঁর জীবন বাঁচাতে পালাতে হয়েছিল এবং রাজ্য সরকারের কাছ থেকে লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল। আজকে মোদির শাসনাধীন গোটা ভারতে তাঁর লড়াই চালানো আরও অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতের ২০ কোটি মুসলমানের ওপর এর প্রভাব আরও ভয়ানক।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

অপূর্বানন্দ দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দি বিষয়ের শিক্ষক