শৌচাগার পরিচালনার ভার কি শুধু সিটি করপোরেশনের

গাবতলী আন্তজেলা বাস টার্মিনালের পাবলিক টয়লেট, ঢাকা শহরে ওয়াটারএইডের অর্থায়নে নির্মিত প্রথম পাবলিক টয়লেট।ফাইল ছবি : প্রথম আলো

বর্তমানে ঢাকা শহরে প্রায় আড়াই কোটি মানুষের বসবাস। কাজের তাগিদে এবং নানা সেবার উদ্দেশ্যে ঢাকার আশপাশের শহর এবং গ্রাম থেকে আসা মানুষের হিসাব করলে এই সংখ্যা আরও বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে, এই বিশাল জনসংখ্যার প্রায় ৫০ ভাগ প্রতিদিন বাইরে যাতায়াত করে এবং এর মধ্যে ৫০ ভাগ মানুষ ভাসমান।

প্রয়োজনের তাগিদে হরহামেশাই এসব মানুষ গাছের আড়ালে, ফুটপাতে, রাস্তার পাশে, বাস কাউন্টারের পাশে, ফ্লাইওভার-ফুটওভারের নিচে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিচ্ছেন। ঢাকা শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পাবলিক টয়লেট–সংকটের কারণে নাগরিকদের এ ভোগান্তির চিত্র প্রতিদিনের। অথচ ঢাকাবাসীর নিরাপদ পাবলিক টয়লেট নিশ্চিত করার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের।

সিটি করপোরেশনের তথ্য–উপাত্তের ভিত্তিতে দেখা গেছে, ঢাকা শহরে দুই সিটি করপোরেশন পরিচালিত টয়লেট আছে ১৩৮টি। যার মধ্যে বেশ কিছু টয়লেট মেরামত না করায় ব্যবহারের অনুপযোগী।

অপর দিকে, প্রতি ৭৫ হাজার মানুষের জন্য টয়লেট আছে মাত্র একটি। পাবলিক টয়লেট–সংকটের কারণে প্রতিদিনই সাধারণ নাগরিকদের বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে।

নগরে জনসংখ্যার তুলনায় পাবলিক টয়লেট অত্যন্ত অপ্রতুল এবং এর কারণে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েন নারীরা। আধুনিকায়নের সঙ্গে সঙ্গে শুধু উপার্জন ছাড়াও নারীদের বাইরে কাজের সঙ্গে বহুগুণে সম্পৃক্ততা বেড়েছে।

ঘরের কাজের পাশাপাশি নারীরা এখন বাজার করা থেকে শুরু করে বাচ্চাদের বিদ্যালয়েও নিয়ে যাচ্ছেন। অথচ ব্যস্ত নগরীর দীর্ঘ সময় বাইরে অবস্থানকালে গণশৌচাগারের সুবিধা তো দূরের কথা, অনেক নারী নিজের কর্মক্ষেত্রেও স্বাস্থ্যকর টয়লেটের সুবিধাটুকু পাচ্ছেন না। এ ই প্রতিকূল অবস্থায় খুঁজে নিতে হয় নিকটস্থ শপিং মল, যার অধিকাংশই অস্বাস্থ্যকর।

সম্প্রতি ওয়াটারএইডের একটি গবেষণায় দেখা যায়, বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের পরিচালিত ঢাকা শহর ব্যবহারের উপযোগী ৬০৯টি টয়লেট রয়েছে। এর মধ্যে রাস্তার পাশে পথচারীদের জন্য আছে ২২ শতাংশ, পার্কে ৮ শতাংশ, কাঁচাবাজারে ৪ শতাংশ, পরিবহন কাউন্টারে ১১ শতাংশ এবং বিভিন্ন বিপণনকেন্দ্রে ৩১ শতাংশ এবং অন্যান্য ২৪ শতাংশ। অনেক নগর–পরিকল্পনাবিদ মনে করেন, একটি আধুনিক শহরে প্রতি ৫০০ মিটার পর পর একটি স্বাস্থ্যসম্মত পাবলিক টয়লেট থাকা প্রয়োজন।

এখানে যেমন আছে ইজারাদারদের একচেটিয়া স্বার্থান্বেষী মনোভাব, অপর দিকে কেউ কেউ ব্যক্তি উদ্যোগে বহু বছর যাবৎ বিনা মূল্যে টয়লেট–সেবা দিয়ে যাচ্ছে। নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত পাবলিক টয়লেট আমাদের অধিকার। ওয়াটারএইডসহ অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিরাপদ নারীবান্ধব পাবলিক টয়লেট তৈরি করছে। শুধু সিটি করপোরেশনের একার নয়, পাবলিক টয়লেট সঠিকভাবে ব্যবহার করে অন্যের ব্যবহারের উপযোগী করে রাখাও আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।

পাবলিক টয়লেটের পরিবেশ কেমন হবে, সেই কথা ভাবলেই আমাদের প্রথম চিন্তায় আসে দুর্গন্ধ, নোংরা প্যান, মেঝেতে জমে থাকা পানি, ভাঙা দরজা, আস্তর খুলে আসা দেয়াল এবং অপর্যাপ্ত আলো এবং সেই সঙ্গে জরাজীর্ণ প্রবেশমুখের সামনে একজন পুরুষ পরিচালনাকরী, যিনি টয়লেটটি দেখভালের দায়িত্বে আছেন।

এই সীমিতসংখ্যক পাবলিক টয়লেটগুলোর অধিকাংশেরই নারী পরিচালনাকরী থাকে না। জরাজীর্ণ পরিবেশ ও যা নারীদের পাবলিক টয়লেট ব্যবহার না করার অন্যতম কারণ।

রাজধানীর প্রবেশদ্বার গাবতলী ব্যবসায়িক দিক থেকেও গুরুত্ব অনেক। সরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও এখানে রয়েছে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। বর্তমান গাবতলী বাস টার্মিনাল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাগবাড়ী এলাকায় তুরাগ নদের পাড়ে অবস্থিত। এটি ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশন জোন ৪–এর অন্তর্ভুক্ত।

ডিএসকের সার্বিক সহযোগিতায় গাবতলী আন্তজেলা বাস টার্মিনালের পাবলিক টয়লেট, ঢাকা শহরে ওয়াটারএইডের অর্থায়নে নির্মিত প্রথম পাবলিক টয়লেট। যা গত ১০ বছর যাবৎ স্থানীয় জনগণ, পরিবহনশ্রমিক এবং আন্তজেলায় ভ্রমণকারী যাত্রীদের সেবা দিয়ে আসছে।

সেবা প্রদানের প্রথম দিন থেকেই টয়লেটটিতে আছে পুরুষ, নারী ও প্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা। নারী ও পুরুষ পরিচালনাকরী টয়লেটের ভেতরে নারী ও পুরুষের জন্য পৃথক হাত ধোয়া, নিরাপদ খাওয়ার পানি সংগ্রহ, সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য জেনারেটর সিস্টেম, ভেন্ডিং মেশিনের মাধ্যমে স্যানিটারি প্যাড বিক্রি ও গোসলের ব্যবস্থা রয়েছে।

এমনকি ব্যবহারকারীদের মালামাল রাখার জন্য লকারের ব্যবস্থাও রয়েছে। আর নিরাপত্তার জন্য সামনে বসানো হয়েছে সিসি ক্যামেরা, যার মাধ্যমে প্রবেশপথ দূর থেকে মনিটরিং করা যাচ্ছে।

সেই সঙ্গে টয়লেটের মেঝে পরিষ্কার রাখার স্বার্থে এখানে শু–কভারের ব্যবস্থাও আছে। যে কেউ প্রয়োজনে টয়লেটের জুতো ব্যবহার না করতে চাইলে শু–কভার কিনতে পারবেন।

উদ্বোধনের প্রথম দিন থেকে গত ১০ বছরে এই টয়লেটের পুরুষ চেম্বার ব্যবহৃত হয়েছে ২৪ লাখ বার এবং নারী চেম্বার ব্যবহৃত হয়েছে ৯ লাখ বার। যা প্রমাণ করে সেবার মান ভালো থাকলে মানুষ টয়লেট ব্যবহারে আগ্রহী হয়।

আমাদের দেশের জীবনব্যবস্থায় পাবলিক টয়লেট এখনো এক অন্ধকার অধ্যায়।

এখানে যেমন আছে ইজারাদারদের একচেটিয়া স্বার্থান্বেষী মনোভাব, অপর দিকে কেউ কেউ ব্যক্তি উদ্যোগে বহু বছর যাবৎ বিনা মূল্যে টয়লেট–সেবা দিয়ে যাচ্ছে। নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত পাবলিক টয়লেট আমাদের অধিকার। ওয়াটারএইডসহ অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিরাপদ নারীবান্ধব পাবলিক টয়লেট তৈরি করছে। শুধু সিটি করপোরেশনের একার নয়, পাবলিক টয়লেট সঠিকভাবে ব্যবহার করে অন্যের ব্যবহারের উপযোগী করে রাখাও আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।

(লেখাটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন: কে এ আমিন, প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর এবং বাবুল বালা, প্রোগ্রাম লিড, ইউনিভার্সাল এক্সেস, ওয়াটারএইড বাংলাদেশ।)

  • মো. তানজিল হাসান, সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার, ওয়াটারএইড বাংলাদেশ