বিজয়ী সরকারের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, যে ইতিহাস এখনো সংরক্ষণ হয়নি

আওয়ামী লীগের নির্বাচিত নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালিত হলেও দল-মতের ঊর্ধ্বে স্বাধীনতাকামী ভিন্ন ভিন্ন দলকে নিয়ে জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠন এই সরকারের সাফল্যকে বেগবান করে
ছবি : আনন্দবাজার পত্রিকার সৌজন্যে

১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর। ৫১ বছর আগের এই সোনালি দিনে স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী ও বিজয়ী গণপ্রজাতন্ত্রী প্রথম বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যরা স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তাঁদের বিদায় জানাতে কলকাতার দমদম বিমানবন্দরে এসেছিলেন ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) মহাপরিচালক কে এফ রুস্তামজি এবং বিএসএফের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের ইন্সপেক্টর জেনারেল গোলক মজুমদার। রুস্তামজি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে বলেন, ‘আমরা আশা করব, ভারত-বাংলাদেশের মৈত্রীর বন্ধন চিরকাল অটুট থাকবে।’ প্রধানমন্ত্রী তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, তা হবে সমানে সমানে। স্বাধীন বাংলাদেশের ওপর যদি চাপ সৃষ্টি না করা হয়, বাংলাদেশের কাজকর্মে যদি কোনো প্রভাব বিস্তার না করা হয়, তাহলে স্বাধীন বাংলাদেশ ও স্বাধীন ভারতের মৈত্রী চিরকাল অক্ষুণ্ন থাকবে।’ গোলক মজুমদার এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘যে রুস্তামজির চেষ্টায় বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতের অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ এবং যাঁর সঙ্গে তাঁর এত মধুর সম্পর্ক, স্বদেশের স্বার্থে তাঁকেও স্পষ্ট ভাষায় ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্পর্কে দৃঢ় মনোভাব জানাতে তাজউদ্দীন সাহেব বিন্দুমাত্র দ্বিধা করলেন না।’

হ্যাঁ, ব্যক্তি, পরিবার, দল-উপদলের সংকীর্ণ স্বার্থ রক্ষার ঊর্ধ্বে উঠে স্বদেশের স্বার্থ ও কল্যাণে এমন তেজস্বী মনোভাব, চারিত্রিক দৃঢ়তা, দূরদর্শিতা ও ত্যাগী নেতৃত্বর কারণেই মাত্র ৯ মাসে বাংলাদেশের বিজয় অর্জন সম্ভব হয়েছিল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরও পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভ ও স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন সম্ভব হয় এই নেতৃত্বর কারণেই।

অথচ কী অদ্ভুত কারণে আজ পর্যন্ত জাতীয়ভাবে এবং রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও তাঁর নেতৃত্বাধীন প্রথম বাংলাদেশ সরকার, যা ‘মুজিবনগর’ (বাংলাদেশের প্রথম রাজধানীর মুজিবনগর নামকরণটি করেছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ) সরকার নামেই বহুল পরিচিত, তার গঠন, কার্যাবলি, বক্তব্য, গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, সিদ্ধান্ত এবং ভয়ংকর সব প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে প্রিয় মাতৃভূমিকে বিজয়ের দ্বারে পৌঁছে দেওয়ার গৌরবদীপ্ত ইতিহাসকে সংরক্ষণ করা হয়নি। যতটুকু তথ্য পাওয়া যায়, তা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, দায়সারা ও খণ্ডিতভাবে এবং যতটা সম্ভব এই মুজিবনগর সরকারের অবদান ও কৃতিত্বকে আড়াল করে। বলা বাহুল্য, সামরিক, বেসামরিক, কৃষক, মজুর, ছাত্র ও জনতাকে নিয়ে আপামর গণমানুষের মুক্তিযুদ্ধ এবং জাতির ক্রান্তিলগ্নে নেতৃত্বদানকারী প্রথম বাংলাদেশ সরকারের অভ্যুদয় নিবিড়ভাবে জড়িত। এই দুই বিষয়কে খণ্ডন করে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস উপস্থাপন করা সম্ভব নয়; ঠিক যেমন সম্ভব নয় ইতিহাসের ধারাবাহিতাকে বিপন্ন করে সত্যকে তুলে ধরা।

এ প্রসঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের ১০ এপ্রিলের বেতার ভাষণটি উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, ‘বিদেশি বন্ধুরাষ্ট্রসমূহের কাছে যে অস্ত্রসাহায্য আমরা চাইছি, তা আমরা চাইছি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে—একটি স্বাধীন দেশের মানুষ আরেকটি স্বাধীন মানুষের কাছে...এই সাহায্য আমরা চাই শর্তহীনভাবে এবং আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রতি তাদের শুভেচ্ছা ও সহানুভূতির প্রতীক হিসেবে। হানাদারদের রুখে দাঁড়াবার এবং আত্মরক্ষার অধিকার হিসেবে। স্বাধীনতার জন্য আমরা যে মূল্য দিয়েছি, তা কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের উপরাষ্ট্র হওয়ার জন্য নয়।’

বঙ্গবন্ধু লাখো কোটি মানুষকে উজ্জীবিত করেছিলেন স্বাধীনতা অর্জনে। আর তাঁর অবর্তমানে তাজউদ্দীন আহমদ একটি স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা করে স্বাধীনতাযুদ্ধের সফল নেতৃত্ব দেন। যুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শরিক হওয়া অগণিত সাধারণ মানুষের আত্মত্যাগের অমর কাহিনিতে ভরপুর ইতিহাসের এই শ্রেষ্ঠ পর্ব ধারাবাহিকভাবে উঠে আসেনি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসকে গুটিকতক শব্দজালে আবদ্ধ করে তারপর একলাফে ১৯৭২ সালে পদার্পণের কারণে ইতিহাসে যে ফাঁক সৃষ্টি হয়েছে, তাতে ঢুকে পড়েছে জঞ্জাল; খলনায়কেরা জায়গা করে নিচ্ছে ইতিহাসের শূন্যস্থানগুলোয়। ওদিকে ইতিহাসের বাতিঘরসম মানুষের স্থান হচ্ছে ফুটনোটে। এর ফলে তরুণসমাজ বিভ্রান্ত হচ্ছে; জাতি বঞ্চিত হচ্ছে তার দেশের সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায় মুক্তিযুদ্ধের পর্বটি সম্পর্কে জানা থেকে।

পৃথিবীতে এমন ঘটনা নজিরবিহীন যে, বিজয়ের ৫১ বছর পরও জনগণ জানেন না তার জন্ম ও তার দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের গৌরব উজ্জ্বল ইতিহাসকে। এর লজ্জাজনক দৃষ্টান্ত হলো বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ল অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স (বিলিয়া) পরিচালিত সাম্প্রতিক গবেষণাভিত্তিক সমীক্ষায় বিভিন্ন স্কুলের চার শতাধিক শিক্ষার্থীর একজনও মুক্তিযুদ্ধ-সম্পর্কিত কোনো প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারেনি! কিন্তু দোষ তো তাদের নয়। দোষ আমাদের দেশের ভঙ্গুর শিক্ষাব্যবস্থার এবং যারা এমন আঁধার পরিবেশের জন্ম দিয়েছে, তাদের।

এখন দৃষ্টিপাত করা যাক বিজয়ী প্রথম সরকারের মূল অবদান ও বৈশিষ্ট্যের দিকে, যা জানলে জাতি উপকৃত হবে এবং খুঁজে পাবে ভবিষ্যতে পথচলার দিগ্‌গদর্শন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।

১. ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে ইতিহাসের মোড় পরিবর্তনকারী একটি আইনানুগ সরকার ও সার্বভৌম রাষ্ট্রর প্রতিষ্ঠা। এর ফলে আগ্রাসী গণহত্যাকারী পাকিস্তান সরকারের বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী অপতৎপরতা এই আখ্যার বিরুদ্ধে বিশাল প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়; আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায়ের পথ উন্মুক্ত হয়।

২. স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের সংজ্ঞাকে সুস্পষ্টভাবে এবং প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার সঙ্গে তুলে ধরা।

এ প্রসঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের ১০ এপ্রিলের বেতার ভাষণটি উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, ‘বিদেশি বন্ধুরাষ্ট্রসমূহের কাছে যে অস্ত্রসাহায্য আমরা চাইছি, তা আমরা চাইছি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে—একটি স্বাধীন দেশের মানুষ আরেকটি স্বাধীন মানুষের কাছে...এই সাহায্য আমরা চাই শর্তহীনভাবে এবং আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রতি তাদের শুভেচ্ছা ও সহানুভূতির প্রতীক হিসেবে। হানাদারদের রুখে দাঁড়াবার এবং আত্মরক্ষার অধিকার হিসেবে। স্বাধীনতার জন্য আমরা যে মূল্য দিয়েছি, তা কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের উপরাষ্ট্র হওয়ার জন্য নয়।’

আরও পড়ুন

৩. প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বাংলাদেশ নীতি সেল গঠন এবং তার মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে বাংলাদেশের পক্ষে যুক্তিমালা দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরা। এই সরকারের নেতৃত্বের প্রজ্ঞা ভারত এবং বিশ্বশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের আস্থা ও শ্রদ্ধা অর্জন করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ,  যান সাফল্যের অন্যতম ভিত্তি ছিল ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি এবং তা অপর বিশ্বশক্তি যুক্তরাষ্ট্রর নিক্সন-কিসিঞ্জার প্রশাসনের পাকিস্তানের গণহত্যায় সহায়তার পথকে দুর্বল করে দেয়, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে ভারতের স্বীকৃতি প্রদানের পথকে প্রসারিত করে।

৪. মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি করে জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠন। আওয়ামী লীগের নির্বাচিত নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালিত হলেও দল-মতের ঊর্ধ্বে স্বাধীনতাকামী ভিন্ন ভিন্ন দলকে নিয়ে জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠন এই সরকারের সাফল্যকে বেগবান করে।

৫. স্বাধীনতাযুদ্ধের ঐক্য বিনষ্টকারী তৎপরতা ও ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাকের পাকিস্তান ও সিআইয়ের পক্ষ হয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন গঠনের ষড়যন্ত্র এবং যুব নেতাদের একাংশের সরকার ও সরকার পরিচালিত মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে হিংসাত্মক অপকাণ্ডকে প্রতিহত করে এই সরকার। খন্দকার মোশতাকের জাতিসংঘে যোগদান করে পাকিস্তানের পক্ষে কনফেডারেশনের প্রস্তাব দেওয়ার পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদটিও তাঁকে ছাড়তে হয়।

৬. বাংলাদেশের ইতিহাসের মর্যাদাশীল চুক্তির প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। বিজয়ের আগেই প্রণীত এই চুক্তিগুলো থেকে বোঝা যায় যে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষার প্রশ্নে কতখানি নিবেদিত ছিল এই সরকার।

স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের পক্ষে ভারতের স্বীকৃতি অর্জন এবং স্বীকৃতি প্রদানের পরেই মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় মিত্রবাহিনী বাংলাদেশে প্রবেশ করবে, যেদিন বাংলাদেশ সরকার ভারতীয় সেনাবাহিনীকে প্রত্যাহার করতে বলবে, সেদিন তারা সৈন্য উঠিয়ে নেবে—এই শর্তগুলোর উল্লেখ ও বাস্তবায়ন।

৭. আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রেখে জাতির জনকের নিঃশর্ত মুক্তি নিশ্চিত করে তাঁকে মুক্ত স্বদেশে ফিরিয়ে আনা।

একটি স্বাধীন, জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী ও রাষ্ট্রচিন্তাসম্পন্ন সফল সরকারের উজ্জ্বল উদাহরণ হলো বাংলাদেশের প্রথম সরকার। তার কীর্তি ও অবদানকে গৌণ করে ভবিষ্যতের সঠিক পথের ঠিকানা কি খুঁজে পাওয়া যাবে?

  • শারমিন আহমদ লেখক ও গবেষক, বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা।