শত শত বছর ধরে বয়ে চলা একটি প্রবাহ, যার নাম ভক্তি নদ। নদের পাড়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ভক্তি নদ নিয়ে একটি সাইনবোর্ড থাকলেও ঠাকুরগাঁও পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী সেই নদকে অস্বীকার করেছেন।
গত বছর জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন বাংলাদেশের নদ-নদী: সংজ্ঞা ও সংখ্যা শীর্ষক একটি বই প্রকাশ করেছে। বইটিতে এ নদের নাম নেই। কমিশন বরাবর বিষয়টি আমি লিখিত জানিয়েছিলাম। নদটি সম্পর্কে জানতে চেয়ে কমিশন ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসকের কাছে চিঠি দিয়েছিল। জেলা প্রশাসনের আটজনের একটি কমিটি সরেজমিন অনুসন্ধান করে যে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, ভক্তি নামে কোনো নদ সরকারি নথিতে নেই। সরকারি নথিতে নদী থাকলেই নদী, নয়তো নদী নয়, এই বিদ্যা নিয়ে আমাদের দেশে পাউবোর প্রকৌশলী ও নদী রক্ষার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা প্রতিবেদন দিয়েছেন।
নদী অনুসন্ধান কমিটি যে প্রতিবেদন দিয়েছে, সেখানে ঠাকুরগাঁও পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলীর উদ্ধৃতিতে বলা হয়েছে, ‘তিনি জানান যে ভক্তি নামে যে জলাশয় আছে, তার কোনো উৎসমুখ ও পতিত মুখ নেই।’ দীর্ঘ প্রায় ১৮ কিলোমিটারের একটি প্রবাহের উৎসমুখ ও পতিত মুখ স্পষ্ট থাকার পরও পাউবোর একজন প্রকৌশলী খুঁজে পাননি।
অতীতেও নদটি অনেকবার সরেজমিন দেখেছি। নদটি সরকারিভাবে অস্বীকার করার পর আবারও সরেজমিন ঘুরতে গিয়েছিলাম। ঠাকুরগাঁও জেলা শহর থেকে বালিয়াডাঙ্গী যাওয়ার পথে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে ভেলাজান বাজার। বাজারের পাশে একটি জলপ্রবাহ। পাউবো কর্তৃক টানানো সাইনবোর্ডে লেখা আছে ‘ভক্তি নদী’। ভেলাজান বাজারে অন্তত ২০ জন বিভিন্ন বয়সী মানুষের সঙ্গে কথা হলো। তাঁরা প্রত্যেকে ভক্তি নদ সম্পর্কে জানেন।
ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশংকৈল নেকমরদ আলিম উদ্দীন সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক রেজওয়ানুল হক। তাঁর বাড়ি ভেলাজান বাজারের পাশে ভক্তি নদের তীরবর্তী। তাঁর বাবা মোস্তফা কামালের সঙ্গে কথা হলো নদটি সম্পর্কে।
তিনি তথ্য দিলেন, নদটি ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ২ নম্বর আখানগর ইউনিয়নের চতুরাখোল মৌজার নিম্নাঞ্চল থেকে উৎপন্ন। বিশেষ করে কালীতলা, ডাগরপাড়া, ভেলাজান মৌজার পানিতে এ নদের প্রবাহের সূত্রপাত। নিম্নাঞ্চলকে সেখানে স্থানীয় ভাষায় ‘কান্দর’ বলে।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার চিলারং ও রুহিয়া ইউনিয়নের কিছু পানিও ভক্তি নদ দিয়ে প্রবাহিত হয়। নদটি চতুরাখোল, মহাদেবপুর, ভেলাজান, বাঁশগাড়া, দেহন, ভাউলার হাট এলাকা হয়ে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার সিন্দুরনা মৌজায় কুলিক নদে মিলিত হয়েছে।
মোস্তফা কামালের কথার সূত্র ধরে রেজওয়ানসহ নদটির উৎপত্তিস্থলের দিকে মোটরসাইকেলে যাত্রা করি। যাওয়ার সময়ে ডাকোপাড়া গ্রামে গিয়ে রেজওয়ান দেখাল কীভাবে আরেকটি পানির ধারা এসে ভক্তি নদে মিলিত হয়েছে। মিলিত হওয়া ধারাটির নাম ‘শাকাতি’।
ডাকোপাড়া গ্রামেই দেখা হলো ষাটোর্ধ্ব আরিফুর নামের জনৈক ব্যক্তির। তাঁর ভাষ্যমতে, শাকাতি অনেক গভীর ছিল। তিনি ছোটবেলা ওই প্রবাহে মই দিয়ে উঁচু পাড়ে মাছরাঙা পাখির বাসা থেকে বাচ্চা ধরেছিলেন। উল্লেখ্য, মাছরাঙা পাখি উঁচু পাড়ে গর্ত করে বাসা করে। তার কাছে আরও জানতে পারি বিন্নাগুড়ি নিম্নাঞ্চলের পানি শাকাতি দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভক্তি নদে পড়ে।
এরপর দেখতে গেলাম বিন্নাগুড়ি কান্দর। কয়েকজন প্রবীণের সঙ্গে কথা হলো। তাঁরা প্রত্যেকে বললেন, শাকাতি খাসজমি। তাঁদের কাছে জানতে পারি ইউনিয়ন পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতা লুৎফর রহমানের কাছে মৌজার নকশা আছে। তাঁর বাড়ি গিয়ে সেই নকশায় দেখলাম, বিন্নাগুড়ি থেকে শাকাতি পর্যন্ত নালাটি খাস খাল শ্রেণিভুক্ত।
প্রবাহটি দেখার পর গেলাম ভক্তি নদের উৎসমুখ দেখতে। উৎসস্থলে গিয়ে দেখলাম কয়েকটি এলাকার পানি এসে ভক্তি নদের প্রবাহ সৃষ্টি করেছে। এরপর ভাটিতে যাই। উৎসস্থল থেকে ৮ থেকে ১০ কিলোমিটার ভাটিতে দক্ষিণ ভেলাজানে দেখলাম নদটিতে স্রোতে আছে। সেখান থেকে আরও ভাটিতে ভাউলার হাটের সামান্য উজানে নাচনা নামের স্থানে ভক্তি নদটিতে স্রোত আরও বেড়েছে। নাচনা সদর উপজেলার ৯ নম্বর রায়পুর ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত।
ভাউলার হাট থেকে আরও প্রায় চার কিলোমিটার দূরে রাসের হাটে যাই। ওখানে কুলিক নদের সঙ্গে ভক্তি নদ মিলিত হয়েছে। ওই স্থানেও নদটি তীব্র স্রোতে বয়ে যাচ্ছে। ভাউলার হাট থেকে ভক্তি নদের নাম হয়েছে নেহালা।
ভক্তি নদের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৮ কিলোমিটার। কুলিক নদের উপনদী। নদটির একেক স্থানে একেক প্রস্থ। নদে অন্তত ১২টি ছোট সেতু আছে। এক দিনে শিশু-বৃদ্ধ মিলিয়ে শতাধিক লোকের সঙ্গে আলাপ করেছি ভক্তি নদ নিয়ে। তাঁরা প্রত্যেকেই প্রবাহকেই দেখিয়েছেন ভক্তি নদ নামে। নদটিতে বহুকাল আগে একটি বাণিজ্যতরি পানিতে ডুবে যাওয়ার কথা প্রচলিত।
উল্লেখিত সরেজমিন বর্ণনায় ভক্তি নামে একটি নদ এখনো বহমান। নদটিতে কোথাও কোথাও তীব্র স্রোতও আছে। সরকারি নথিতে নদী আছে কি না, এটা জানতে চায়নি কমিশন। কমিশন জানতে চেয়েছিল নদী আছে কি না। ফলে প্রতিবেদনে দেওয়া তথ্য আর জানতে চাওয়া তথ্য এক নয়।
দীর্ঘকাল ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসন যে নদীকে তালিকাভুক্ত করেনি, এটাই তো অন্যায়! কমিশনের সংজ্ঞাতেও এটি নদ। পাউবো পানি কিংবা জেলা প্রশাসন নদীর প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন করলে, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন নামের প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন হতো না। এমনকি এক ইঞ্চি নদীও বেহাত হতো না। এখন কমিশনের দায়িত্ব আবার নদটি সরেজমিন অনুসন্ধান করে তালিকাভুক্ত করা।
● তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক