বিশ্বকে যে কারণে দ্বিতীয় নাকবা ঠেকাতেই হবে

প্রথম নাকবার ৭৬ বছর পূর্তি উপলক্ষে ফিলিস্তিনিদের গণজমায়েতছবি: রয়টার্স

১৯৪৮ সালের মে মাসে ইসরায়েলি শাসকগোষ্ঠী ফিলিস্তিনের ঐতিহাসিক ভূখণ্ডের ৮০ ভাগের বেশি দখল করে নিয়েছিল। তারা শত শত গ্রাম ধ্বংস করে সাড়ে সাত লাখের বেশি ফিলিস্তিনিকে ভিটে থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। সেই ঘটনা ফিলিস্তিনিদের জন্য ছিল মহাবিপর্যয়।

সেই ঘটনার স্মরণে তখন থেকে আজ পর্যন্ত প্রতিবছরের মে মাসে ফিলিস্তিনিরা ‘নাকবা’ (আরবি ‘নাকবা’ শব্দের অর্থ ‘বিপর্যয়’) পালন করেন। এই বছর ফিলিস্তিনিরা নাকবাকে এমন একটি ‘দ্বিতীয় নাকবা’র মধ্যে স্মরণ করছে, যখন সম্ভবত ফিলিস্তিনিদের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর ও সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী ঘটনার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে।

আজ প্রথম নাকবার ৭৬ বছর পর আমরা দেখতে পাচ্ছি ফিলিস্তিনিদের ক্ষত থেকে এখনো রক্ত ঝরছে। লাখ লাখ ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুকে নিজের ভিটেমাটিতে ফিরে যাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। তাদের একেবারে মুছে ফেলার জন্য ফিলিস্তিনিদের অবশিষ্ট অঞ্চলগুলোও ইসরায়েল দখল করে নিয়েছে।

আরও পড়ুন

আমার বাবা সেই ভিটেহারা শরণার্থীদের একজন ছিলেন। তিনি ১৯৩১ সালে হাইফায় জন্মেছিলেন। কিন্তু নিজের জন্মস্থানে ফিরে যাওয়ার অধিকার উপলব্ধি করার আগেই তিনি মারা গিয়েছিলেন।

এ বছর ৭৬ বছর আগে বাস্তুচ্যুত হওয়া ফিলিস্তিনিদের বংশধরদের সেই অতীত বিপর্যয়ের বেদনাদায়ক স্মৃতি রোমন্থন করার কোনো দরকার নেই। কারণ, তারা তার চেয়েও ভয়ানক ঘটনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যেন ফিলিস্তিনিদের প্রত্যেক প্রজন্মের নিজেদের একটি করে নাকবার মুখোমুখি হওয়াটাই নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তবে এবার ইসরায়েল গাজা এবং অধিকৃত পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের শুধু ভিটেছাড়া করতে চাইছে না, তারা মূলত ফিলিস্তিনিদের ওপর গণহত্যা ও জাতিগত নির্মূল অভিযান চালাচ্ছে।

নাকবা এবং চলমান গাজা যুদ্ধের মধ্যকার যোগসূত্রটি শুধু ফিলিস্তিনিরাই যে উপলব্ধি করতে পারছে, তা নয়। ইসরায়েলের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারাও ‘দ্বিতীয় নাকবা’ নিয়ে খোলাখুলি কথা বলেছেন।

ইসরায়েলের কৃষিমন্ত্রী আভি দিশতার ফিলিস্তিনিদের উত্তর দিক থেকে তাড়া খেয়ে দক্ষিণ দিকে যাওয়ার ঘটনাকে ‘গাজা নাকবা ২০২৩’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ইসরায়েলের পার্লামেন্টের সদস্য এরিয়েল কালনার গাজায় ‘দ্বিতীয় নাকবা’ ঘটানোর আহ্বান জানিয়েছেন।

গত নভেম্বরে আমি যে গ্রামে থাকি, তার পাশের দেইর ইসতিয়া গ্রামে জলপাই তোলার সময় ফিলিস্তিনি চাষিদের ওপর বসতি স্থাপনকারীরা হামলা চালিয়েছিল। হামলাকারীরা আরবিতে লেখা লিফলেট ছড়িয়ে দিয়েছিল। সে লিফলেটে লেখা ছিল, ওই এলাকার ফিলিস্তিনিরা জর্ডানে পালিয়ে না গেলে তাদের নতুন নাকবার মুখে পড়তে হবে।

গাজার ওপর চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ সাত মাসের বেশি সময় ধরে চলছে। ইসরায়েলের হামলায় সেখানে এখন পর্যন্ত ৩৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। আহত ও পঙ্গু হয়েছে ৮০ হাজারের বেশি লোক। বাস্তুচ্যুত হয়েছে ২০ লাখের বেশি লোক।

গাজার এই নতুন বাস্তুচ্যুত লোকেরা মূলত ১৯৪৮ সালের নাকবায় তাড়া খেয়ে ভিটে ফেলে পালিয়ে আসা ফিলিস্তিনিদের বংশধর। নতুন করে ভিটে ফেলে পালানো ফিলিস্তিনিদের মধ্যে এমন কেউ কেউ বেঁচে আছেন, যাঁরা ১৯৪৮ সালে প্রথম নাকবার শিকার হয়েছিলেন।

এই মুহূর্তে আমি যেখানে থাকি, সেই পশ্চিম তীরের অবস্থা গাজার মতো অতটা খারাপ না হলেও সেখানেও ভয়াবহ অবস্থা চলছে। প্রতিদিনই সেখানকার গ্রাম এলাকায় ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষকে নতুন ইহুদি বসতি গড়ে তোলার জন্য ফিলিস্তিনিদের জমি দখল করতে দেখছি।

গত নভেম্বরে আমি যে গ্রামে থাকি, তার পাশের দেইর ইসতিয়া গ্রামে জলপাই তোলার সময় ফিলিস্তিনি চাষিদের ওপর বসতি স্থাপনকারীরা হামলা চালিয়েছিল। হামলাকারীরা আরবিতে লেখা লিফলেট ছড়িয়ে দিয়েছিল। সে লিফলেটে লেখা ছিল, ওই এলাকার ফিলিস্তিনিরা জর্ডানে পালিয়ে না গেলে তাদের নতুন নাকবার মুখে পড়তে হবে।

যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ এখানে বসতি গড়ে তোলা অল্পসংখ্যক ‘হিংসাত্মক’ ইহুদির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। তাদের এই নিষেধাজ্ঞা আরোপের ধরন দেখে মনে হবে, যেন বাকি অবৈধ বসতি স্থাপনকারীরা এখানে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে। অথচ এটি একেবারে প্রমাণিত মিথ্যা। এ অবস্থায় আমরা বিশ্বের কাছে একটি নতুন নাকবা ঠেকানোর এবং গাজার জনগণকে বাঁচানোর জন্য আবেদন করছি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এটি করতেই হবে, যেহেতু আজকের এই অবস্থার জন্য তারাই দায়ী।

আমরা বিশ্বব্যাপী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বিক্ষোভ এবং স্লোগানে আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। এই তরুণ আন্দোলনকারীদের পূর্বপুরুষেরা বিগত নাকবা ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। সম্ভবত তাঁদের এই সন্তানেরা নতুন নাকবা ঠেকাতে সফল হবেন।

● ফরিদ তামাল্লা রামাল্লায় বসবাসরত ফিলিস্তিনি সাংবাদিক ও পরিবেশবাদী আন্দোলনকর্মী

মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত