২৮ অক্টোবরের পর পুলিশ যা করেছে, যা করেনি

আসুন দেখে নেওয়া যাক, গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ ভন্ডুল হওয়ার পর থেকে পুলিশ যা করেছে আর যা করেনি, তার খতিয়ানটা।

সমাবেশের এক দিন পর পুলিশ বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে ৩৬টি মামলা করে। এ মামলার আসামি বিএনপির শীর্ষ নেতাসহ ১ হাজার ৫৪৪ জন। অজ্ঞাতনামা আসামি আরও কয়েক হাজার জন। অভিযোগ, পুলিশকে হত্যা ও হত্যার উদ্দেশ্যে ককটেল বিস্ফোরণ; সরকারি কাজে বাধা; প্রধান বিচারপতির বাসভবনে ভাঙচুর; অগ্নিসংযোগ; পুলিশের অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়া ইত্যাদি।

এর তিন দিন পর খবর আসে, কিশোরগঞ্জে পৌর বিএনপির সভাপতি ও জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আশফাককে না পেয়ে পুলিশ তাঁর দুই যমজ ছেলে শহীদুল ইসলাম অনিক ও মাকসুদুল ইসলাম আবিরকে ধরে নিয়ে গেছে।

আরও পড়ুন

সপ্তাহখানেক বাদে খবর বের হয়, বিএনপির সাবেক আইনবিষয়ক সম্পাদক আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়ার বিরুদ্ধে মৌচাকে পুলিশের ওপর ককটেল ছোড়ার অভিযোগে মামলা করেছে রামপুরা থানা। মামলার বাদী উপপরিদর্শক মো. আবদুর জলিল। ওই মামলার আরেক আসামি মো. নাসির রহমান।

ঘটনা হলো, আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া মারা গেছেন সাড়ে তিন বছর আগে আর নাসির রহমান এক বছর আগে। ঢাকার বাইরে মৌলভীবাজারের জুড়ী থেকেও একই ধরনের খবর আসে। পুলিশের ওপর হামলা, সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে এখানে আসামি লোকমান হোসেন। তিনি প্রয়াত হয়েছেন ছয় বছর আগে।

হাজার হাজার আসামির তালিকায় আরও আছেন প্রবাসী ও সাংবাদিকেরা। যেমন মৌলভীবাজারের জুড়ীর ওই মামলাতেই পুলিশ আসামি করেছে ফুলতলার বুরহান মিয়াকে। তিনি দুই বছর ধরে আরব আমিরাতে আছেন। আসামি নাইম আহমেদ থাকেন ফ্রান্সে, আরেক আসামি হামিদপুর গ্রামের জায়েদ আহমেদ থাকেন সৌদি আরবে।

আরও পড়ুন

মাগুরার মহম্মদপুরের একটি নাশকতার মামলায় আসামির তালিকায় থাকা পাঁচ সাংবাদিক হলেন দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার উপজেলা প্রতিনিধি ও প্রেসক্লাব মহম্মদপুরের সহসভাপতি মো. মেহেদি হাসান ওরফে পলাশ; খবরের আলো পত্রিকার উপজেলা প্রতিনিধি ও প্রেসক্লাব মহম্মদপুরের প্রতিষ্ঠাকালীন সাধারণ সম্পাদক মো. ওহাব বিশ্বাস; লোকসমাজ ও দৈনিক জনতা পত্রিকার উপজেলা প্রতিনিধি মো. তরিকুল ইসলাম তারা; নিউ নেশন পত্রিকার উপজেলা প্রতিনিধি মো. রফিকুল ইসলাম ওরফে রফিক মাস্টার এবং ভোরের দর্পণ পত্রিকার উপজেলা প্রতিনিধি ও প্রেসক্লাব মহম্মদপুরের প্রচার সম্পাদক মো. রাসেল মিয়া ওরফে রাসেল মোল্যা।

মামলার এজাহারে পুলিশ বলেছে, ১ নভেম্বর রাত পৌনে ১২টা থেকে সাড়ে ১২টার মধ্যে অনেক মানুষের জমায়েত ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। যদিও স্থানীয় লোকজন এমন কোনো ঘটনার কথা জানেন না। সাংবাদিক ছাড়াও এ মামলায় আসামি ১৯৯ জন।

তবে এর বাইরে বাসে অগ্নিসংযোগের দায়ে পুলিশ ১২-১৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। অবশ্য তাঁদের বড় অংশকেই সাধারণ মানুষ হাতেনাতে ধরে দিয়েছেন বলে পুলিশ ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। এর মধ্যে গত ২ নভেম্বর ভোরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনী সদর উপজেলার লালপুল সেতু এলাকায় চিনি বোঝাই একটি ট্রাকে আগুন দেওয়ার ভিডিও ভাইরাল হয়। তার ভিত্তিতে যুবলীগ নেতা নুরুল উদ্দিন টিপু (৩৫) কে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

এখন দেখা যাক পুলিশ কী করেনি। নাটোর ও রাজশাহীতে মুখোশ পরা লোকজন বিএনপি ও জামায়াতের ৯ নেতা-কর্মী ও সমর্থককে পিটিয়ে, কুপিয়ে, হাত-পায়ের রগ কেটে, গুলি করে গুরুতর জখম করেছে। শুধু যে রাতের অন্ধকারে হত্যা ও হামলার ঘটনা ঘটছে, তা নয়। দিনের বেলাতেও। এর মধ্যে বিএনপির গুলিবিদ্ধ নেতা সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁর মা ও কিশোর ছেলের সামনে তাঁর ওপর হামলা চালানো হয়। এসব ঘটনায় পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করেনি।

আরও পড়ুন

মহাসমাবেশের পর ঢাকার তিতুমীর কলেজের তিন ছাত্রসহ পাঁচজন নিখোঁজ ছিলেন। তাঁদের অন্তত দুজনের স্বজন প্রথম আলোকে বলেন, টানা আট দিন নিখোঁজ থাকার পর তাদের আদালতে তোলা হয়। এর বাইরে ঢাকা মহানগরের উত্তরা পূর্ব থানা ছাত্রদলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মির্জা শাকিলের পরিবারের অভিযোগ তিনি (শাকিল) নিখোঁজ রয়েছেন।

পরিবারের বক্তব্য, সাদাপোশাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ৭ নভেম্বর উত্তরার আজমপুর থেকে তাঁকে তুলে নিয়ে যায়। এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে উপস্থাপনের বাধ্যবাধকতা থাকলেও এই ছাত্রদের আদালতে তোলা হয়নি। তারা কোথায় ছিল বা কোথায় আছে? কার জিম্মায় ছিল?

রোববার ময়মনসিংহের নান্দাইলে উপজেলা আওয়ামী লীগের বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ মিছিলে অস্ত্র প্রদর্শন করে ভয়ভীতি দেখান স্থানীয় সাবেক সংসদ সদস্য মেজর জেনারেল (অব.) আবদুস সালামের জামাতা জাহিদ হাসানের দেহরক্ষী কামরুজ্জামান। এর আগে ঢাকার মিরপুরের পল্লবীতে পোশাকশ্রমিকদের বিক্ষোভে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে মাঠে নামেন ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক আওলাদ হোসেন ওরফে লাক্কু। তাদের কারও বিরুদ্ধেই পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

এক কথায় বলতে গেলে, পুলিশ যা করছে না, তা হচ্ছে জবাবদিহি। তারা প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে না। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ শীর্ষ নেতাদের ঠিক কী কারণে গ্রেপ্তার করা হয়েছে?

পুলিশকে হত্যা ও হত্যার উদ্দেশ্যে ককটেল বিস্ফোরণ; সরকারি কাজে বাধা; প্রধান বিচারপতির বাসভবনে ভাঙচুর; অগ্নিসংযোগ; পুলিশের অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়ায় তাঁদের সুনির্দিষ্টভাবে কী ভূমিকা ছিল? পুলিশ হত্যা, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে ভাঙচুরে কতজন যুক্ত ছিলেন? তাদের সংখ্যা কি হাজার পাঁচেকও হবে? না হলে এত মানুষ গ্রেপ্তার কেন? মামলার এজাহারে মৃত, প্রবাসী ও অশীতিপর বৃদ্ধের নাম কেন? গুপ্ত হত্যা ও আক্রমণের সঙ্গে জড়িত কারা?

আরও পড়ুন

বাংলাদেশের পুলিশ অত্যন্ত দক্ষ। গাইবান্ধায় যুবলীগ নেতা খুন হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই বেশ কয়েকজন আসামিকে ধরে ফেলেছে তারা। তাহলে বিরোধীদলীয় নেতা খুন হলে তাদের খুনিদের কেন পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারছে না?

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের হিসাবে, ২৮ অক্টোবর থেকে ১৪ নভেম্বর বিকেল পর্যন্ত ১৫৪টি বাস পুড়িয়েছে ‘দুর্বৃত্ত’রা। এসব মামলায় হাজার হাজার আসামি, কিন্তু ১২-১৩ জন বাদে কারও ব্যাপারে অকাট্য প্রমাণ কেন উপস্থাপন করতে পারছে না তারা? ছাত্রদলের যেসব নেতা-কর্মী নিখোঁজ ছিলেন বলে পরিবারের দাবি, তাঁরা আসলে আদালতে উপস্থাপনের আগে সপ্তাহখানেক সময় কোথায় ছিলেন?

অবরোধ চলাকালে লালবাগ অঞ্চলের এক নেতা আমিনুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয়। তিনি সাক্ষাৎকারের অনুমতি দিয়েও গ্রেপ্তারের ভয়ে নাকচ করেন। তাঁর অনুমতি নিয়ে দেখা করি তাঁর স্ত্রী বেসরকারি চাকরিজীবী মনোয়ারা সুলতানার সঙ্গে। গলায় স্পষ্ট হতাশা। আমিনুল আগস্টে একবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, অক্টোবরে বেরিয়েছেন। ২৮ অক্টোবরের পর আর বাড়ি ফেরেননি।

মনোয়ারা বলেন, বাড়ির উল্টো দিকে আওয়ামী লীগের এক নেতা আছেন। আমিনুলকে বাড়ির আশপাশে দেখলে পুলিশকে খবর দেন। রাত দুইটা-তিনটার সময় পুলিশ তাঁদের দরজা ধাক্কায়। ৮০ বছরের বৃদ্ধ শ্বশুর ও ১৫ বছরের কিশোর ছেলে জেগে বসে থাকে। রাজনীতি করলেই কেন পুলিশের কুনজরে পড়তে হবে, এমন প্রশ্ন তাঁর।

তাঁর প্রশ্ন নিয়ে দুজন পুলিশ সদস্যের সঙ্গে কথা হয়। সংগত কারণে তাঁদের নাম প্রকাশ করছি না। নয়াপল্টনে বিএনপির তালাবদ্ধ কার্যালয়ের সামনে দায়িত্বরত এক পুলিশ সদস্য বলেন, ‘সুন্দরবনে বাঘ আছে, কাছে গেলে খাইয়া ফেলতে পারে, তাহলে কি আপনি ভয়ে সুন্দরবন যাবেন না?’ আচ্ছা, তার মানে পুলিশ এখন নিজেদের বাঘ মনে করছে।

দ্বিতীয় আরেকজনের কাছে প্রশ্ন করি, বলেন তো, কেন মৃত, প্রবাসী, অশীতিপর বৃদ্ধ, বাবার পরিবর্তে ছেলেদের ধরছে পুলিশ? বললেন, ‘কী কইতাম! কিছুই কওয়ার নাই!’

  • শেখ সাবিহা আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
    [email protected]