একবার একটা মার্কিন কোম্পানির প্রজেক্টে কাজ করছিলাম বাংলাদেশের দিক থেকে প্রজেক্ট ম্যানেজার হিসেবে। প্রজেক্টটা বেশ ঝামেলার। কারণ, এটা ছিল সিস্টেম ইন্টিগ্রেশন টাইপের। মানে লিড ইন্ট্রিগেশনের মূল কোম্পানি মার্কিন হলেও তাদের পেছনে কাজ করছিল আরও সাতটি দেশের কোম্পানি। ভেবেছিলাম অনেক কিছুই ঠিকঠাক চলবে, কিন্তু শুরুতেই ধাক্কা খেলাম। কারণ, মূল কোম্পানির প্রজেক্ট ম্যানেজার একজন ড্যানিশ, যার কাজের ধরন আর আমার দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটাই আলাদা। সারা দিন ঝগড়া, ভুল–বোঝাবুঝি চললেও প্রজেক্টের খাতিরে ধীরে ধীরে আমাদের মধ্যে একটা বোঝাপড়া শুরু হয়।
এই কাজ করতে গিয়েই আমি প্রথমবার ডেনমার্কের ‘সোশ্যাল সার্ভিস’ সম্পর্কে কাছ থেকে জানার সুযোগ পাই। তাঁর সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে আমি বুঝতে পারলাম, নর্ডিক দেশগুলো বিশেষ করে ডেনমার্ক কীভাবে ইউনিভার্সাল সার্ভিস (সর্বজনীন সেবা) দিয়ে মানুষের জীবন পুরো বদলে দেয়। ইউনিভার্সাল সার্ভিস বলতে বোঝায় এমন একটি সহায়কমূলক ব্যবস্থাপনা, যার অধীনে থাকে সব ধরনের মানুষ। ধনী-গরিব, শহর-গ্রাম, চাকরিজীবী, উদ্যোক্তা—সবাই। যেমন বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা, ভালো মানের সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা, বেকার থাকলে সেটার সহায়তা বা মা-বাবা হলে সন্তান লালন–পালনে সহায়তা।
আমি তখন ভাবতাম, একটা মানুষ যদি জানে যে বিপদে পড়লে সরকার পাশে থাকবে, তাহলে সে অনেক সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সে চাইলেই চাকরি ছেড়ে স্টার্টআপ খুলতে পারে, চাইলে এক বছরের জন্য বিশ্বভ্রমণে বের হতে পারে কিংবা পুরো সময় দিতে পারে সমাজসেবায়। কারণ, সে জানে, পেছন থেকে একটা নিরাপত্তার জাল (সেফটি নেট) তাকে ধরে রাখবে। এটাকেই বলে ট্রু ফ্রিডম বা সত্যিকারের স্বাধীনতা, যেটা শুধু নিজের ওপর নির্ভর করে আসে না, আসে রাষ্ট্রের একটা নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থাপনা থেকে।
একটা উদাহরণ দিই। ধরুন, আপনি একটা জায়গায় চাকরি করেন। কিন্তু আপনার মনে হচ্ছে, এই কাজ আপনার জন্য নয়। আপনি চাচ্ছেন নিজে কিছু শুরু করবেন, সেটি হতে পারে একটা অনলাইন বিজনেস। কিন্তু আপনি জানেন না যদি ব্যর্থ হন, তাহলে কী হবে—সন্তানের স্কুলের ফি, বাসার খরচ, চিকিৎসার খরচ—সব ঝুলে থাকবে আপনার ঘাড়ে। তখন আপনি চাকরিটা ছাড়তে ভয় পাবেন। কিন্তু যদি আপনি জানতেন যে আপনি ব্যর্থ হলেও আপনার এসব বিষয় রাষ্ট্রের তরফ থেকে দেখভাল করা হবে, তাহলে আপনি হয়তো নিজে কিছু করার জন্য আগেই ঝাঁপ দিতেন।
জায়গাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তবে এসব ব্যাপার আবার মনে এল ‘দ্য নর্ডিক থিওরি অব এভরিথিং’ বইটা পড়তে গিয়ে। লেখক দেখিয়েছেন, কীভাবে নর্ডিক দেশের সর্বজনীন সেবাগুলো মানুষকে বেশি স্বাধীন করে তুলেছে। সেখানে সরকার মানুষকে আটকে রাখে না, বরং তারা একটা মানুষকে সক্ষম করে তোলার চালিকা শক্তি। সরকার পাশে থাকে যেন মানুষ নিজের মতো করে জীবন তৈরি করতে পারে। তাই তারা চাকরি বদলে ফেলে, নতুন কিছু শুরু করে, পরিবারে সময় দেয়। কারণ, তাদের পেছনে একটা শক্তিশালী সিস্টেম আছে।
এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের দেশের জন্য কীভাবে কাজ করবে, সেটা নিয়ে লিখেছি ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় মানবিক রাষ্ট্র’ বইতে। আমরা প্রায়ই বলি, ‘নিজের চেষ্টায় সব করতে হবে’, কিন্তু সবকিছু নিজে করা কখনো সম্ভব নয়। একটা সমাজ তখনই এগোয়, যখন সবাই জানে, পেছনে কেউ আছে। সরকার, সমাজ, আইন—সব মিলেই যদি একটা সহায়তামূলক পরিবেশ তৈরি করা যায়, তাহলে মানুষ সাহস পায়, বড় সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আর সেটাই দেশের জন্যও ভালো হয়।
এই অভিজ্ঞতা আর ভাবনাগুলোই আমার মনে প্রশ্ন তোলে, আমরা কি পারি না এমন একটা সিস্টেম গড়ে তুলতে, যেখানে মানুষ জানবে তাদের পাশে কেউ আছে?
অবশ্যই পারি। সরকার চাইলে সেই সাপোর্ট দিতে রাজি আছি।
রকিবুল হাসান টেলিকম ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিষয়ক লেখক