খুব সম্প্রতি বাংলাদেশ শ্রম আইনের অধীন প্রণীত শ্রম বিধিমালা ২০১৫–তে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী আনা হয়েছে। নতুন বিধিমালাটি সরকারি গেজেটে প্রকাশিত হওয়ার পরপরই শ্রমিকনেতাদের অনেকগুলো ফোরাম থেকে এ বিধিমালার বেশ কিছু সংশোধনীকে শ্রমিকস্বার্থের পরিপন্থী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
সংশোধনের কমিটিতে নিয়মমতো শ্রমিক প্রতিনিধি থাকলেও এ কমিটি গঠনের প্রক্রিয়াটি অস্পষ্ট এবং কমিটিতে শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধিত্ব জোরালো নয়। বিধিমালায় নারী শ্রমিকের স্বার্থ–সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সংশোধন আনা হলেও সংশোধনসংক্রান্ত কমিটিতে নারী প্রতিনিধি অনুপস্থিত।
বলা হচ্ছে, অনেকগুলো ধারাতেই এমন সংশোধন করা হয়েছে, যা শ্রম আইন ২০০৬–তে প্রদত্ত সুযোগ–সুবিধাগুলোকেও খর্ব করছে। বিশেষ করে প্রসূতিকল্যাণ–সুবিধার ক্ষেত্রে যে পরিবর্তনগুলো আনা হয়েছে, তা শ্রম আইনে একজন প্রসূতি শ্রমিকের প্রাপ্য সুবিধাকে কমিয়ে দেওয়ার সুযোগ তৈরি করেছে।
অথচ একটি আইনের অধীন বিধিমালা তৈরি হয় সেই আইনের মূলধারাগুলোর প্রয়োগ সহজ করার জন্য। আইনে যে বিষয়ের প্রয়োগ সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব হয় না, সে বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বিধিমালা তৈরির মাধ্যমে নির্ধারণ করে। অর্থাৎ কোনো আইনের সংশ্লিষ্ট বিধিমালা সেই আইনের কোনো মূল বিষয়কে পরিবর্তন বা প্রদত্ত অধিকার খর্ব করতে পারে না।
প্রসূতিকল্যাণ–সংক্রান্ত বিষয়ে বেশ কয়েকটি পরিবর্তন আনা হয়েছে এ বিধিমালায়। একটি ইতিবাচক পরিবর্তন হলো শ্রম আইনে গর্ভপাতজনিত ছুটিকে প্রসূতিকল্যাণ–সুবিধার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত না করা হলেও বিধিমালায় চার সপ্তাহের গর্ভপাতজনিত ছুটির বিধান রাখা হয়েছে।
তবে অনেকটা প্রসঙ্গবহির্ভূতভাবেই যে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনটি আনা হয়েছে, তা হলো প্রসূতিকল্যাণ–সুবিধা গণনার প্রক্রিয়াটিকে নতুনভাবে নির্ধারণ করা হচ্ছে। শ্রম আইনের ৪৮ ধারা অনুযায়ী দৈনিক মজুরি গণনার ক্ষেত্রে একজন শ্রমিকের প্রসূতিকালীন ছুটির নোটিশ প্রদানের পূর্ববর্তী তিন মাসে তাঁর প্রাপ্ত মজুরিকে তাঁর ‘প্রকৃত কাজের দিনগুলো’ দিয়ে ভাগ করতে হবে।
অর্থাৎ তিন মাসে তাঁর প্রকৃত কাজের দিন থেকে তাঁর প্রাপ্য ছুটির দিনগুলো বাদ দিতে হবে আবার মজুরি গণনার সময় ছুটির দিনে প্রাপ্ত মজুরিসহ অতিরিক্ত কাজের মজুরিও যোগ করতে হবে। কিন্তু নতুন বিধিমালায় বলা হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে সর্বশেষ প্রাপ্ত মজুরিকে ২৬ দিয়ে ভাগ করে এক দিনের মজুরি নির্ধারণ করতে হবে। অর্থাৎ তাতে করে আর ছুটির দিনগুলোকে মোট কাজের দিন থেকে বাদ দেওয়ার সুযোগ থাকছে না। কেননা এখন প্রকৃত কাজের দিনের বদলে ২৬ দিয়ে ভাগ করা হচ্ছে মজুরিকে।
অন্যদিকে একজন প্রসূতি শ্রমিক মাতৃত্বকালীন ছুটির নোটিশ দেবেন সন্তান প্রসবের সম্ভাব্য তারিখ থেকে দুই মাস আগে, অর্থাৎ নোটিশের সময় তিনি গর্ভাবস্থার শেষ তিন মাসে থাকেন এবং স্বাভাবিকভাবেই তাঁর সে মাসে অতিরিক্ত কাজ করার মতো শারীরিক সক্ষমতা থাকে না। এতে করে মোট মজুরির গণনাতেও তার প্রভাব পড়ে। অর্থাৎ এই নতুন বিধিতে খুব স্বাভাবিকভাবেই একজন প্রসূতি শ্রমিক আইনে প্রদত্ত সুবিধার থেকে এখন অনেকটাই কম পাবেন। কেননা এই নতুন হিসাবে তাঁর দৈনিক মজুরি আগের তুলনায় কমে যাবে।
গত ৫০ বছরে ক্রমবর্ধমান নারী শ্রমশক্তি বাংলাদেশের উন্নয়নপ্রক্রিয়ায় যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, সেই গতিময়তা ধরে রাখতে হলে নারীকে ঘরের বাইরে কাজ করার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। আর এ কারণেই নতুন বিধিমালাটি নারী শ্রমিকের অধিকার, বিশেষ করে মাতৃত্বকালীন অধিকারকে কীভাবে সীমিত করছে, তা বিশেষভাবে পুনরায় বিবেচনা করা আশু প্রয়োজন
আরও একটি নতুন পরিবর্তন আনা হয়েছে এই সংশোধনে। শ্রম আইনের ধারা ৪৬ বলছে, প্রত্যেক নারী শ্রমিক তাঁর মালিকের থেকে তাঁর সন্তান প্রসবের সম্ভাব্য তারিখের অব্যবহিত পূর্ববর্তী আট সপ্তাহ এবং সন্তান প্রসবের অব্যবহিত পরবর্তী আট সপ্তাহের জন্য প্রসূতিকল্যাণ–সুবিধা পাওয়ার অধিকারী হবেন এবং তাঁর মালিক তাঁকে এ সুবিধা প্রদান করতে বাধ্য থাকবেন।
আবার ধারা ৪৫ অনুযায়ী কোনো মালিক তাঁর প্রতিষ্ঠানে সজ্ঞান কোনো নারীকে তাঁর সন্তান প্রসবের পরবর্তী আট সপ্তাহের মধ্যে কোনো কাজ করাতে পারবেন না। কিন্তু নতুন বিধিতে বলা হচ্ছে, প্রসব–পূর্ববর্তী নির্ধারিত আট সপ্তাহের পর কোনো নারী শ্রমিক সন্তান প্রসব করলে ওই নির্ধারিত সময়ের পরবর্তী দিনগুলো বিধির অধীন সমন্বয় করতে হবে। এ নতুন বিধি যুক্ত করার উদ্দেশ্য এবং কীভাবে এ সমন্বয় আসলে করা হবে, সেটি স্পষ্ট না হওয়ায় এ নতুন বিধির আওতায় একজন মালিক স্পষ্ট আইনের বিধান ভঙ্গ করে প্রসব–পরবর্তী বাধ্যতামূলক আট সপ্তাহের ছুটিকে চাইলে কমিয়ে দিতে পারেন।
গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন সুবিধাসংক্রান্ত অধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে শ্রম আইনের দুর্বল প্রয়োগের বিষয়টি আলোচিত হয়েছে।
পরিপূর্ণ ছুটি আর মজুরি না দেওয়া, হয়রানিমূলক আচরণ, গর্ভবতী শ্রমিককে সন্তান জন্মের পর আবার চাকরিতে যোগ দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে চাকরি ছাড়তে চাপ দেওয়া, শ্রম আদালতে যথাযথ প্রতিকার না পাওয়া—এসব অভিযোগই অনেকবার উঠে এসেছে বেশ কয়েকটি গবেষণা প্রতিবেদনে।
এ ছাড়া মাতৃত্বকালীন ছুটির সময় বাড়ানো, প্রসব–পূর্ববর্তী ছুটিকে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে প্রসব-পরবর্তী ছুটির সঙ্গে সমন্বয় করার সুযোগ, স্তন্যপান বিরতি নিশ্চিত করা, গর্ভবতী শ্রমিকের জন্য পর্যাপ্ত চিকিৎসার সুযোগ, উপযুক্ত শিশুযত্ন সেবার ব্যবস্থা ইত্যাদি আলোচিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে, কিন্তু এ সুপারিশগুলোর একটিরও প্রতিফলন দেখা যায়নি নতুন করে করা ২০২২ সালের এ সংশোধনে।
আমাদের আইন আর নীতিমালাগুলোকে শ্রমিকের মাতৃত্বকালীন অধিকার বিষয়ে আরও বেশি সংবেদনশীল হওয়া প্রয়োজন, যাতে করে সন্তান ধারণ ও লালন–পালনের জন্য কোনো নারী উপার্জনক্ষম জনগোষ্ঠী থেকে ঝরে না পড়ে।
প্রসূতি শ্রমিকের জন্য কর্মক্ষেত্রে আরও বেশি সুযোগ সৃষ্টি করা আর শ্রম আইনে দেওয়া প্রাপ্য সুবিধার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই। গত ৫০ বছরে ক্রমবর্ধমান নারী শ্রমশক্তি বাংলাদেশের উন্নয়নপ্রক্রিয়ায় যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, সেই গতিময়তা ধরে রাখতে হলে নারীকে ঘরের বাইরে কাজ করার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে।
আর এ কারণেই নতুন বিধিমালাটি নারী শ্রমিকের অধিকার, বিশেষ করে মাতৃত্বকালীন অধিকারকে কীভাবে সীমিত করছে, তা বিশেষভাবে পুনরায় বিবেচনা করা আশু প্রয়োজন।
তাসলিমা ইয়াসমীন সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়