ছাত্ররাজনীতি কি আধ–মরাদের ঘা মেরে বাঁচাতে পারবে?

দুই বড় ছাত্রসংগঠনের বাইরে নতুন এই ছাত্রজোট ছাত্ররাজনীতিতে নতুন ধারা আনতে পারবে কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন।
ছবি : প্রথম আলো

ডিসেম্বর বিজয়ের মাস। একাত্তরে যাঁরা এই বিজয় এনে দিয়েছিলেন, তাঁদের সিংহভাগ ছিলেন তরুণ। যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁদেরও বয়স ছিল ত্রিশ থেকে চল্লিশের ঘরে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনেও নেতৃত্বে ছিলেন ছাত্র-তরুণেরাই। সেই সময়ের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে না। কিন্তু ছাত্ররা ১৪৪ ধারা কেবল ভাঙলেনই না; বুকের রক্ত দিয়ে ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করলেন।

উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানেও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ছাত্র-তরুণেরা। ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যানটিনে ডাকসু, চারটি ছাত্রসংগঠন—যথাক্রমে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া), ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) ও ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফ্রন্টের (এনএসএফ) একাংশ মিলে গঠিত হলো ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। তাদের ঘোষিত ১১ দফাই পরে জাতীয় কর্মসূচিতে রূপ নেয়। আসাদ-মতিউরসহ অনেক তরুণের জীবনের বিনিময়ে গণ-অভ্যুত্থান হলো। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিয়েও আইয়ুব খান গদি রক্ষা করতে পারেননি। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান একাত্তরের পটভূমি তৈরি করে। 

স্বাধীনতার পর ছাত্র-তরুণেরা আরেকবার জেগে উঠেছিলেন আশির দশকে—স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব মাঝেমধ্যে বিভক্তি ও আপসের চোরাগলিতে হাঁটলেও ছাত্রসমাজ এরশাদ শাসনের পুরোটা সময় আন্দোলন জিইয়ে রাখে।

১৯৮৩ সালে মজিদ খান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে নিহত হন জাফর, জয়নাল, কাঞ্চন, দীপালি সাহা প্রমুখ। ১৯৯০ সালের অক্টোবরে ২৪টি ছাত্রসংগঠনের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য। এরপর ছাত্র-তরুণ, বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সম্মিলিত গণ-অভ্যুত্থানে এরশাদ পদত্যাগে বাধ্য হন। এসবই ছিল ছাত্রদের গৌরবের সমাচার।

১৯৯০ থেকে ২০২২—এই ৩২ বছরে আশির দশকের ছাত্রনেতাদের কেউ কেউ মন্ত্রী ও এমপি হয়েছেন। আবার বিরোধী দলে থাকতে অনেকে জেল–জুলুম সহ্য করেছেন। পদ–পদবির জন্য তঁারা দলবদলও করেছেন। কিন্তু আশির দশকের সেই ছাত্রনেতৃত্ব জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেননি। নব্বই-পরবর্তী জাতীয় রাজনীতির নিয়ন্ত্রকেরা ছাত্ররাজনীতিকে বিকশিত হতে দেননি, নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। এই একটি ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে চমৎকার ঐক্য আছে।

ছাত্ররাজনীতির এই দুরবস্থার আরেক কারণ ছাত্র সংসদের নির্বাচন করতে না দেওয়া। পাকিস্তান আমলে, বাংলাদেশের সেনাশাসনের সময়ও বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতো। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ‘গণতান্ত্রিক’ শাসনামলে ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ রাখা হয়। নির্বাচন হলে যোগ্য ছাত্রনেতৃত্ব তৈরি হতো এবং তাঁরা বর্তমান ও ভবিষ্যতে জাতীয় রাজনীতিকে ঋদ্ধ করতে পারতেন। উচ্চ আদালতে মামলা ও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২০১৯ সালে একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদে নির্বাচন হলেও সরকার আর ওই পথে হাঁটেনি। ডাকসু নির্বাচনে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ নামে একটি সংগঠন নতুন শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। তারা ডাকসুর ভিপি ও সমাজকল্যাণ সম্পাদকের পদ পায়। ছাত্রলীগ পায় জিএসসহ বাকি পদ। সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতে, নির্বাচনে কারচুপি না হলে ভিপি, জিএসসহ অধিকাংশ পদই ছাত্র অধিকার পরিষদ পেত।

বাম ছাত্র জোট কি জাতীয় রাজনীতির মেরুকরণ প্রক্রিয়ার অংশ? ছাত্র ফেডারেশন (গণসংহতি আন্দোলন) জোটে না থাকাও কি তাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত না মূল সংগঠনের রাজনৈতিক দিক পরিবর্তন, সেই প্রশ্নের জবাবও হয়তো শিগগির জানা যাবে। বাম ছাত্রসংগঠনের এই জোট বাঁধার একটি ইতিবাচক দিক হলো পাহাড়ি ছাত্র পরিষদকে সম্পৃক্ত করা। এর আগে জাতীয় ছাত্ররাজনীতি বা জোটে তারা পাহাড়ি ছাত্র পরিষদকে যুক্ত করেনি।

এরপর ‘মহা জনপ্রিয়’ আওয়ামী লীগ সরকার কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিতে সাহস পায়নি। ১৩ বছর ধরেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলছে ছাত্রলীগের একচ্ছত্র আধিপত্য। হলে কে থাকবেন, কে থাকবেন না, সেসবও ঠিক করে ছাত্রলীগ। অনেক ক্ষেত্রে হল প্রশাসন ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অসহায়। এই প্রেক্ষাপটে ১৩ দফা দাবি নিয়ে আটটি বাম ছাত্রসংগঠন মিলে নতুন জোট করেছে। এর আগেও বাম ছাত্রসংগঠনগুলো একাধিকবার জোট করেছিল। কিন্তু ছাত্রলীগের মার খেয়ে পিছু হটেছে। এবার কি তারা শক্ত পায়ে দাঁড়াতে পারবে?

 বাম ছাত্রসংগঠনের ১৩ দফা দাবিতে আছে, সরকারের পদত্যাগ; সর্বজনীন-বৈষম্যহীন-বিজ্ঞানভিত্তিক -গণতান্ত্রিক একই ধারার শিক্ষানীতি প্রণয়ন, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ-বেসরকারীকরণ-সাম্প্রদায়িকীকরণ-সংকোচন নীতি বাতিল এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২০ বাতিল; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করা, প্রশাসনিক তত্ত্বাবধানে আবাসিক হলে আসন বণ্টন, গণরুম-গেস্টরুম বন্ধ করা, ডাকসুসহ সব ছাত্র সংসদ নির্বাচন, শিক্ষা খাতে জাতীয় বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ করা এবং পাঠ্যসূচি থেকে ইতিহাস বিকৃতি ও প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক উপাদান বাতিল প্রভৃতি।

এই জোটে আছে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (বাসদ), সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (মার্ক্সবাদী), বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল, ছাত্র ফেডারেশন (জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল), বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলন এবং বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ রয়েছে। কিন্তু সর্ববৃহৎ বাম ছাত্রসংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের নজির-রাগীব গ্রুপ এই জোটে থাকলেও ফয়েজ দীপক অনুসারীরা নেই।  কমিউনিস্ট পার্টির এক শীর্ষস্থানীয় নেতা জানিয়েছেন, বাম ছাত্র জোটে যাওয়ার ব্যাপারে ছাত্র ইউনিয়নে কোনো গ্রুপের আপত্তি নেই।

কথা ছিল, আগে নিজেরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে জোটে যোগ দেবে। ছাত্র ইউনিয়নের দুই গ্রুপের মধ্যে ঐক্যচেষ্টার মধ্যে এ জোট ঐক্য প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করবে না স্থায়ী বিভাজনের মধ্যে নিয়ে যাবে, সেই প্রশ্নের জবাব পার্টির নেতাদের জানার কথা। কেন তাঁরা গত দুই বছরেও ছাত্র ইউনিয়নের দুই গ্রুপকে একত্র করতে পারলেন না?

আরও পড়ুন

বাম ছাত্র জোট কি জাতীয় রাজনীতির মেরুকরণ প্রক্রিয়ার অংশ? ছাত্র ফেডারেশন (গণসংহতি আন্দোলন) জোটে না থাকাও কি তাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত না মূল সংগঠনের রাজনৈতিক দিক পরিবর্তন, সেই প্রশ্নের জবাবও হয়তো শিগগির জানা যাবে। বাম ছাত্রসংগঠনের এই জোট বাঁধার একটি ইতিবাচক দিক হলো পাহাড়ি ছাত্র পরিষদকে সম্পৃক্ত করা। এর আগে জাতীয় ছাত্ররাজনীতি বা জোটে তারা পাহাড়ি ছাত্র পরিষদকে যুক্ত করেনি।

নতুন ছাত্রজোট জানিয়ে দিয়েছে, তারা ছাত্রদলের সঙ্গে জোট বাঁধবে না। দুই বড় ছাত্রসংগঠনের বাইরে নতুন এই ছাত্রজোট ছাত্ররাজনীতিতে নতুন ধারা আনতে পারবে কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন বলেছেন, ‘ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা/ ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ,/ আধ–মরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।’ এই আধমরাদের ঘা মারতে পারাটাই এখন সবচেয়ে জরুরি। সেটি ছাত্ররাজনীতির জন্য যেমন প্রযোজ্য, তেমনি জাতীয় রাজনীতির জন্যও।

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]