ইসরায়েলে হামলায় হিজবুল্লাহকে কেন যুক্ত করেনি ইরান

ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি এবং হিজবুল্লাহ–প্রধান হাসান নসরুল্লাহ

ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যকার ‘ইটের বদলে পাটকেল’ মারার সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যকে সর্বাত্মক যুদ্ধের মধ্যে নিয়ে যাবে কি না, সেই উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। তবে এ ধরনের একটা পরিস্থিতি তৈরি হবে না বলেই মনে হয়। কারণ, তাতে ইসরায়েল অথবা ইরান কোনো পক্ষই লাভবান হবে না। ইসরায়েল উসকানি দিলেও, ইরান রক্ষণাত্মক অবস্থানে।

ইরানের প্রধান স্বার্থ হচ্ছে আত্মরক্ষা। ইরান দেশের ভেতরকার পারমাণবিক স্থাপনা এবং মধ্যপ্রাচ্যে তাদের যে সম্পদ আছে, সেগুলো রক্ষা করতে চায়। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে যেসব সশস্ত্র গোষ্ঠীকে তারা সমর্থন দিচ্ছে, তাদের সুরক্ষিত রাখতে চায়। ইরানের সবচেয়ে মূল্যবান প্রক্সি হচ্ছে হিজবুল্লাহ।

ইরানের নেতারা বারবার করে দাবি করে আসছেন, ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার নির্দেশনা তাঁরা দেননি, এ হামলার সম্পর্কে তাঁরা কিছু জানতেনও না। এর কারণ হলো, ইরান চায় না ইসরায়েল ও তার মিত্ররা ইরানকে লক্ষ্যবস্তু বানাক, কিংবা এমন ধরনের প্রতিশোধ নিক, যাতে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব ক্ষুণ্ন হয়।

আরও পড়ুন

হামাসের ৭ অক্টোবরের অভূতপূর্ব হামলার সঙ্গে ইরান জড়িত কি জড়িত না, সেই বিবেচনার বাইরে গিয়েও বলা যায়, ইরান হামাসের প্রধান অর্থনৈতিক ও সামরিক পৃষ্ঠপোষক। সে কারণে হামাসের কর্মকাণ্ডের আংশিক দায় ইরানের ওপরই বর্তায়। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বেশ কয়েকটি সশস্ত্র সংগঠনের পৃষ্ঠপোষকও ইরান। এর মধ্যে ইয়েমেনে হুতি, লেবাননে হিজবুল্লাহ এবং সিরিয়া ও ইরাকের অজস্র সশস্ত্র গোষ্ঠী রয়েছে। এই প্রক্সিগুলো ৭ অক্টোবর–পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে ইরানের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে ইসরায়েলবিরোধী সামরিক তৎপরতা শুরু করে।

ইসরায়েলের সঙ্গে চলমান সংঘাতে অবশ্য প্রক্সি গোষ্ঠীগুলো তাদের বড় ধরনের জনবল ও সম্পদ নিয়োজিত করেনি। এই সংঘাতে তাদের অংশগ্রহণ সীমিত মাত্রার।

হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েল সর্বাত্মক আক্রমণে (এই হামলায় গাজা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে) থাকাকালেই ইরানের অন্য প্রক্সিদের ওপর হামলা শুরু করে। কৌশলগত প্রতিশোধের অংশ হিসেবে প্রক্সিদের ওপর হামলা চালায় ইসরায়েল। হামলায় এ পর্যন্ত ৩০০ হিজবুল্লাহ যোদ্ধা নিহত হয়েছেন। সিরিয়াতে অস্ত্রাগারে ও ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল।

১৩ এপ্রিল হামলার পাল্টায় ১৯ এপ্রিল ইরানের ইস্পাহানে হামলা করে ইসরায়েল। এই হামলাকে খাটো করে দেখানোর পেছনে ইরানের উদ্দেশ্য হলো, তারা ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে চায় না। ইরান জানে যে পারমাণবিক স্থাপনার কাছে ইস্পাহানে হামলা চালিয়ে ইসরায়েল শক্ত বার্তা দিতে চেয়েছে যে তারা কী করতে পারে, কোথায় পৌঁছাতে পারে।

এই কৌশলগত প্রতিশোধের মাধ্যমে ইসরায়েল দেখাতে চায় যে সিরিয়া ও লেবাননে ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোকে দুর্বল করার জন্য সর্বাত্মক আক্রমণ করার দরকার নেই তাদের। লেবাননে, হিজবুল্লাহ কমান্ডাররা যখন গাড়িতে চড়ে যাতায়াত করছিলেন এবং গ্রামাঞ্চলে বাড়িতে সভা করছিলেন, সে সময় তাঁদের লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল।

এসব হামলার মধ্য দিয়ে ইসরায়েল ইরানকে শক্ত বার্তা দিতে চেয়েছে যে ইসরায়েল তার নজরদারি ও গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে ইরান ও তার প্রক্সিরা কোথায় আছে, তা জানতে সক্ষম। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জারি চলমান উত্তেজনাকে যুদ্ধে রূপ দেওয়ার ইরানের ইচ্ছাকে এ ঘটনা দারুণভাবে সীমিত করে দিয়েছে।

ইরানের নাজুকতা আরও বেশি মাত্রায় প্রকাশিত হয় ১৩ এপ্রিল ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সময় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ অন্য মিত্ররা ইসরায়েলের প্রতিরক্ষায় যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তার মধ্য দিয়ে।

তেহরান ও তার প্রক্সিরা মুখরক্ষায় উদ্‌গ্রীব। ৭ অক্টোবরের পর ইরান তার প্রক্সিদের কেন ইসরায়েলে হামলা চালিয়ে যেতে দিয়েছে?

আরও পড়ুন

কারণ হলো, সামষ্টিক তৎপরতার মাধ্যমে তারা ইসরায়েলের ওপর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। কিন্তু ইরান এ কাজে তাদের বিরত থাকতে বলেনি। ইরানের এই সম্পৃক্ততার পেছনে মূল প্রেরণা হলো, ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্রদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা তথাকথিত ‘প্রতিরোধের অক্ষশক্তির’ নেতা হতে চায় দেশটি।

আরেকটি কারণেও ১৩ এপ্রিল ইসরায়েলে প্রতিশোধমূলক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ইরানের জন্য মুখরক্ষার ব্যাপার। ১ এপ্রিল দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেটে বিমান হামলা চালিয়ে ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) কয়েকজন কমান্ডারসহ সাত কর্মকর্তাকে হত্যা করে ইসরায়েল।

এর আগে ২০২০ সালে ইরাকে হামলা চালিয়ে ইরানের শীর্ষ জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু সেই হত্যাকাণ্ডের পর ইরান বড় কোনো প্রতিশোধ নেওয়া থেকে বিরত থাকে। সে সময়ে ইরান কৌশলগত ধৈর্য ধারণ করেছিল এবং পরে সময় ও সুযোগমতো বদলা নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিল।

১ এপ্রিল দামেস্কে কনস্যুলেটে হামলা ছিল ইসরায়েলের দিক থেকে সবচেয়ে বড় প্ররোচনা। ইসরায়েলের উদ্দেশ্য ছিল ইরানকে আরও বড় চাপে ফেলা। তারা ভালো করেই জানত কৌশলগত ধৈর্যের অজুহাত দিয়ে এবার আর ইরান চুপ করে বসে থাকতে পারবে না।

নিজেদের সীমাবদ্ধতাকে স্বীকৃতি দিয়েই, ইরান ১৩ এপ্রিল ইসরায়েলে হামলা করে। এর মধ্য দিয়ে, ইসরায়েলকে বড় ধরনের চাপে না ফেলেই, ইরান দেখিয়ে দিতে চেয়েছে, তারা কী করতে পারে।

১৩ এপ্রিল ইরানের হামলা নিয়ে হোয়াইট হাউস যে বিবৃতি দিয়েছে, সেখানে ইরানের সঙ্গে যেসব প্রক্সি গোষ্ঠী ইসরায়েলে হামলা চালায় তার মধ্যে লেবাননের হিজবুল্লাহর নাম উল্লেখ করা হয়নি। ইরান ভালো করেই জানত, এই হামলায় যদি হিজবুল্লাহও যুক্ত হয়, তাহলে উত্তেজনা এমন পর্যায়ে পৌঁছাবে যে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ (হিজবুল্লাহ) ঝুঁকির মুখে পড়বে।

১৩ এপ্রিল হামলার পাল্টায় ১৯ এপ্রিল ইরানের ইস্পাহানে হামলা করে ইসরায়েল। এই হামলাকে খাটো করে দেখানোর পেছনে ইরানের উদ্দেশ্য হলো, তারা ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে চায় না। ইরান জানে যে পারমাণবিক স্থাপনার কাছে ইস্পাহানে হামলা চালিয়ে ইসরায়েল শক্ত বার্তা দিতে চেয়েছে যে তারা কী করতে পারে, কোথায় পৌঁছাতে পারে।

এই এপ্রিল মাসে ইরান যা করছে, সেটাকে ইসরায়েলের ওপর ইরান প্রতিশোধ নিচ্ছে—এভাবে দেখলে ভুল হবে। বড় পরিসর থেকে দেখলে দেখা যাবে যে ইরানের হাত বাঁধা।

  • লিনা খাতিব লন্ডনভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক  চ্যাটাম হাউসের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা কর্মসূচির অ্যাসোসিয়েট ফেলো
    দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত