উন্নয়ন তো হচ্ছেই, অসুখী আবার কী!

নিজের ভায়রার চেয়ে যার মায়না পাঁচ শ টাকা বেশি, জগতে সে-ই সুখী। এই ইয়ার্কিময় তুলোর মতো হালকা কথার তলে থাকা যে ওজনদার কথাটি তলিয়ে দেখা দরকার, সেটি হলো, আমরা সুখী কি না, তা বোঝার তুলাদণ্ড হলো তুলনা।

কার সঙ্গে কার তুলনা? ঠাটারীবাজারের কাটারিভোগ চালের আড়তদার মিলন বখশের সঙ্গে টুইটারের ইলন মাস্কের তুলনা চলে না। তুলনা হয় আশপাশের লোক অথবা নিজেরই অতীতের সঙ্গে। সেই তুলনাই কে কতটা সুখী, তা মাপার আসল পাল্লা-পোড়েন।

এক পাল্লায় নিজেকে, আরেক পাল্লায় আর কাউকে বাটখারা হিসেবে রাখলে সুখের ‘পরিমাণ’ বোঝা যায়। কার তুলনায় কে বেশি সুখী বা কম সুখী, তা তখন ধরা পড়ে।

আরও পড়ুন

অনেকটা সেই নিরিখে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন সমাধান নেটওয়ার্ক তাদের এ বছরের ‘ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট’-এ কোন দেশ কতটা সুখী, তার একটি তুলনামূলক তালিকা তুলে ধরেছে। সে তালিকায় গত বছরের তুলনায় ২৪ ধাপ পিছিয়ে ১৩৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১১৮ নম্বরে এসে ঠেকেছে। প্রতিবেশী নেপাল ৭৮, পাকিস্তান ১০৮, ভারত ১২৬, মিয়ানমার ১১৭ ও শ্রীলঙ্কা ১১২ নম্বরে আছে। সবচেয়ে নিচে আছে আফগানিস্তান। আর ষষ্ঠবারের মতো সবচেয়ে ওপরে, মানে এক নম্বরে আছে ফিনল্যান্ড। সোজা কথায়, বাংলাদেশ ‘সুখ সূচক’-এ পিছিয়ে গেছে।

এখন কথা হলো, কোন দেশ বালিশের ভেতরে টাকা রাখা ফরেস্ট অফিসার ওসমান গনির মতো ধনী আর কোন দেশ নিজের জমিজমা না থাকা গনি মিয়ার মতো গরিব, তা না হয় টাকাকড়ি থাকা না থাকা দিয়ে মাপা যায়। তা মাপার জন্য জিডিপি, পার ক্যাপিটা ইনকাম, রিজার্ভের মতো প্যারামিটার আছে।

কিন্তু সুখ মাপার তো কোনো মিটার নেই। সুখ তো দাঁড়িয়াবান্ধা খেলা না যে ধরা-বান্ধা রুলস-রেগুলেশনস দিয়ে স্পষ্টভাবে জেতা পার্টি-হারুপার্টির বিভাজন সম্ভব। সুখের সঠিক ও অব্যয় সংজ্ঞা নিরূপণও তো অসম্ভব। এই কারণে জাতিসংঘ সবচেয়ে সুখী দেশের যে তালিকা বানিয়েছে, তাকে বহু মানুষ সন্দেহের চোখে দেখে।

তবে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন সমাধান নেটওয়ার্ক বলছে, কোন দেশের পর কোন দেশ সবচেয়ে সুখী, তা ঠিক করার জন্য তারা ছয়টি সূচক ঠিক করেছে। এগুলো হলো: মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি), সামাজিক সহায়তা, সুস্থ জীবনযাপনের প্রত্যাশা, জীবনযাপনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা, বদান্যতা এবং দুর্নীতি নিয়ে মনোভাব ও ডিসটোপিয়া (সারাক্ষণ নজরদারির মধ্যে নাগরিকেরা বাস করে—এমন এক কল্পিত জগতে বাস করার মতো যন্ত্রণাময় অনুভূতি)।

আরও পড়ুন

কিন্তু কথা হলো এর মধ্যে জিডিপি বাদে যতগুলো বিষয় আছে, তার সবগুলোই একেক লোকের কাছে একেক রকম ঠেকতে পারে। সামাজিক সহায়তা, সুস্থ জীবনযাপনের প্রত্যাশা, জীবনযাপনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা, বদান্যতা, দুর্নীতি নিয়ে মনোভাব ও ডিসটোপিয়া—এর কোনোটারাই তো কোনো স্পষ্ট অবয়ব নেই। এগুলো পাঁচতলায় থাকা লোকের কাছে এক রকম, গাছতলায় লোকের কাছে আরেক রকম।

এই তালিকা দেখে ভায়রার চেয়ে কম কামাই করে বিমর্ষ হয়ে পড়া লোকের মতো কিছু লোকের মনে হতে পারে, বাংলাদেশ আসলেই বুঝি চরম অ-সুখে বিষাদগ্রস্ত হয়ে নেতিয়ে পড়েছে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, বিষাদ আর অ-সুখ সব সময় সমার্থক হয় না।

অনেকে আছে সীমাহীন উচ্চাকাঙ্ক্ষী। সে যা চায়, তা পায়, কিন্তু সে আরও চায়। এই লোক বিষণ্ন না, সতত অতৃপ্তিতে সে সারাক্ষণ অস্থির। সে সব সময়ই প্রতিষ্ঠার পরবর্তী ধাপে ওঠার জন্য উদ্দীপ্ত ও সতেজ। বিষাদের সঙ্গে যে নিস্তেজ আত্মমায়া থাকে, তার কাছে তার স্থান নেই। সে সুখ চায় না, জয় চায়।

দুর্যোধনের মতো সে–ও হয়তো বলে, ‘ক্ষুদ্র সুখে ভরে নাকো ক্ষত্রিয়ের ক্ষুধা’। তার কাছে সামাজিক সহায়তা, সুস্থ জীবনযাপনের প্রত্যাশা, জীবনযাপনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা, ইত্যাদির মানে একেবারে আলাদা। জাতিসংঘের সূচক ধরে তাকে অসুখী বলা যেতে পারে, কিন্তু সেই বলাটা সে কতটা মেনে নেবে, তা ভাবা দরকার।

আবার অজ্ঞানতাও অনেক সুখের উৎপত্তিস্থল। ঘরে আগুন লাগলে অবুঝ শিশু খিলখিলিয়ে সুখের হাসি হাসে। সেই বোধহীন অজ্ঞানতাজাত সর্বনাশা প্রগতিঘাতী সুখের চেয়ে সচেতনতা-জাত অ-সুখ কি ভালো নয়?

বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে হয়তো তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা আছে, বেকারত্ব নিয়ে উদ্বেগ আছে, সরকার নাগরিকদের সামাজিক নিরাপত্তা দিতে পারছে কি না, তা নিয়ে জিজ্ঞাসা আছে। আর আছে বলে দেশ ও দেশের মানুষের মধ্যে জাতিসংঘের সংজ্ঞায় পড়ে যাওয়া অ-সুখ ধরা পড়ছে। কিন্তু এই অ-সুখই যে সেই প্রবল উচ্চাকাঙ্ক্ষী লোকটির মতো দেশ ও দেশের মানুষকে পরবর্তী প্রতিষ্ঠার ধাপে পা বাড়ানোর জন্য প্রাণবন্ত করে রাখে, সেটি কি জাতিসংঘ তার গবেষণায় বলছে?

আবার অজ্ঞানতাও অনেক সুখের উৎপত্তিস্থল। ঘরে আগুন লাগলে অবুঝ শিশু খিলখিলিয়ে সুখের হাসি হাসে। সেই বোধহীন অজ্ঞানতাজাত সর্বনাশা প্রগতিঘাতী সুখের চেয়ে সচেতনতা-জাত অ-সুখ কি ভালো নয়?

ভিন্ন চোখে দেখলে বোঝা যাবে, অসুখী ও লোভীরাই উন্নয়ন ও অগ্রগতির মূল কারিগর। মাটিতে হেঁটে সুখী হতে পারেনি বলেই মানুষ উড়োজাহাজ বানাতে পেরেছে। লঞ্চ আর ফেরি পারাপারকে চরম উৎকর্ষ ভেবে সুখী হওয়ার বদলে সেতু বানানোর আকাঙ্ক্ষায় অসুখী হওয়াই যে পদ্মা সেতুর প্রধান ভিত্তি, সেটি কি কোনো গবেষণায় উঠে এসেছে?

যেহেতু একটি তীব্র ও আশ্চর্য অতৃপ্তি মানুষের মহান কীর্তির পেছনে কাজ করে এসেছে, তাই জাতিসংঘের এই তালিকা থেকে এই ধারণাও করা যায়, ‘অসুখী’ বাংলাদেশ অন্য দেশগুলোর তুলনায় হয়তো অনেক বেশি উদ্দীপ্ত ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী।

  • সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক

    [email protected]