কে বড় ‘দলীয় কর্মী’—ডিসি না ইসি

নির্বাচন কমিশন যুক্তি দিয়ে থাকে যে ৩০০ আসনে একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ায় তাদের নিজস্ব লোকবল দিয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ করা কঠিন। তারা বাধ্য হয়ে ডিসিদের নিয়োগ দিচ্ছে।

কমিশনের এই যুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৪ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোয় লিখেছিলাম, ‘এত বিতর্কের পর ডিসিরাই কেন রিটার্নিং কর্মকর্তা’। জেলা পরিষদ নির্বাচন সামনে রেখেই কলামটি লেখা হয়েছিল। কিন্তু নির্বাচন কমিশন যে আমাদের কথায় কর্ণপাত করবে না, সেটাও জানতাম। বাংলাদেশে কেউ কারও কথা শোনে না। বলাউল্লাহরা সব সময় বলে যান। আর করাউল্লাহরা তাঁদের মতো কাজ করে যান। অন্তত পদ থেকে সরে দাঁড়ানো কিংবা সরিয়ে দেওয়ার আগপর্যন্ত তাঁরা নিজেদের সিদ্ধান্তকে স্বতঃসিদ্ধ বলে মনে করেন।

লেখাটির পটভূমি তৈরি করেছিল নির্বাচন কমিশনই। চট্টগ্রাম জেলায় নির্বাচন কমিশন (ইসি) নিয়োজিত রিটার্নিং কর্মকর্তা, যিনি ওই জেলার প্রশাসকও, মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার দিন আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সমর্থনে মোনাজাত করে বলেন, ‘আমি মনে করি, বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে যদি থাকে, তাহলে আমাদের দেশে আওয়ামী লীগ বলি, বিএনপি বলি, জামায়াত বলি—সবাই নিরাপদ থাকবে। আমি মনে করি, বিএনপি-জামায়াতেরও এখন দোয়া করা উচিত শেখ হাসিনা যেন আবার ক্ষমতায় আসেন।’

এরপর নির্বাচন হওয়া না হওয়া কিংবা কাকে রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ করা হলো, তা নিয়ে ভোটার তথা মানুষের কোনো আগ্রহ থাকতে পারে না। বিষয়টি গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার হলে নির্বাচন কমিশন রিটার্নিং কর্মকর্তার পদ থেকে চট্টগ্রামের ডিসিকে সরিয়ে দেয়। অর্থাৎ তারা মনে করছে, যিনি কোনো দলের প্রার্থীর পক্ষে প্রচার চালাতে পারেন, তাঁর হাতে নির্বাচন নিরাপদ নয়। এ রকম উদাহরণ যে শুধু চট্টগ্রামের ডিসি তৈরি করেছেন, তাই নয়। ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে যেসব তথ্য-উপাত্ত বেরিয়ে আসছে, তাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীর সংজ্ঞাটাই বদলে দিতে হয়।

শুধু রিটার্নিং কর্মকর্তা বদলালে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না, এ কথা আমরাও মানি। তাঁর এসব যুক্তি মেনে নিয়েও যে কথাটি বলতে চাই, তা হলো, যে নির্বাচনব্যবস্থাটি ভেঙে পড়েছে, সেটি পুনরুদ্ধার করতে কোথাও না কোথাও থেকে তো শুরু করতে হবে। কেউ হয়তো বলবেন, বিভিন্ন সময় সাজানো নির্বাচনের সঙ্গে আরও অনেকে যুক্ত ছিলেন। তাহলে ডিসিরা কেন ‘স্কেপ গোট’ হবেন। বিষয়টি অন্যভাবেও দেখা যেতে পারে। এ রকম কারচুপির নির্বাচনে যদি ডিসিরা যুক্ত না থাকেন, তাতে তাঁদেরই গৌরব বাড়বে।

আমার সেই লেখার পর সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার আরেকটি লেখায় পাল্টা প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর কথা ছিল, ‘শুধু রিটার্নিং কর্মকর্তা বদলালে কি সুষ্ঠু নির্বাচন হবে।’ তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তি। সাবেক সচিবদের মধ্যে যাঁদের নিরপেক্ষতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেননি, তিনি তাঁদের একজন। তাঁর প্রশ্নটি যথার্থ বলেই মনে করি। ১৯৫৪ সালে যখন নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়নি, তখন তো ডিসিরাই নির্বাচন পরিচালনা করতেন, যে নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে মাত্র সরকারি দল ৯টি এবং যুক্তফ্রন্ট পেয়েছিল ২৯১টি আসন। এ জন্য কোনো ডিসিকে চাকরি হারাতে হয়নি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকেও আমরা জানতে পারি, সেই সময় একজন আমলা কীভাবে সরকারের রোষ থেকে তাঁকে রক্ষা করেছিলেন। ওই নির্বাচনে তিনি এক জাঁদরেল মুসলিম লীগের নেতাকে হারিয়ে নিজে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এখন কি সে রকম কোনো দৃশ্য কল্পনায়ও ভাবতে পারেন?

আলী ইমাম মজুমদার যুক্তি দিয়েছেন, ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত এ দেশে অনুষ্ঠিত চারটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাঠপর্যায়ের নেতৃত্বে ছিলেন ডিসিরাই। আবার ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে একতরফা একটি নির্বাচনেও তাঁরাই ছিলেন রিটার্নিং কর্মকর্তা।

শুধু রিটার্নিং কর্মকর্তা বদলালে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না, এ কথা আমরাও মানি। তাঁর এসব যুক্তি মেনে নিয়েও যে কথাটি বলতে চাই, তা হলো, যে নির্বাচনব্যবস্থাটি ভেঙে পড়েছে, সেটি পুনরুদ্ধার করতে কোথাও না কোথাও থেকে তো শুরু করতে হবে। কেউ হয়তো বলবেন, বিভিন্ন সময় সাজানো নির্বাচনের সঙ্গে আরও অনেকে যুক্ত ছিলেন। তাহলে ডিসিরা কেন ‘স্কেপ গোট’ হবেন। বিষয়টি অন্যভাবেও দেখা যেতে পারে। এ রকম কারচুপির নির্বাচনে যদি ডিসিরা যুক্ত না থাকেন, তাতে তাঁদেরই গৌরব বাড়বে।
শনিবার জেলা পরিষদ নির্বাচন ও অন্যান্য নির্বাচন নিয়ে ডিসি-এসপিদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, নির্বাচনের মাঠে জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ সুপারদের (এসপি) দলীয় কর্মী হিসেবে নয়, সরকারি কর্মচারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। এবার নির্বাচন কমিশন (ইসি) শক্ত অবস্থানে থাকবে।

এই মতবিনিময় সভায় সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘আমরা অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চাই। সেই সঙ্গে তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ দিয়েছি, দলনিরপেক্ষ হয়ে কাজ করতে হবে। আমরা আশা করি, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকলে নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না।’

আরও পড়ুন

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, জেলা ও পুলিশ প্রশাসন নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে চেষ্টা করে। সংসদীয় ব্যবস্থা এমন যে সরকার ও দল আলাদা করা অনেক সময় কষ্টকর। অনেক সময় অলক্ষ্যে প্রভাব চলে আসতে পারে। তবে নির্বাচন কমিশন এবার শক্ত অবস্থানে থাকবে। আচরণবিধি মেনে গণকর্মচারী হিসেবে অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে হবে।

সিইসি যখন ডিসি-এসপিদের নিরপেক্ষভাবে নির্বাচনের দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিয়েছেন, তখন পুলিশ বিভাগের কাছ থেকে আরেক ধরনের নির্দেশনা গেছে। শুক্রবার বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করেছেন, সারা দেশে বিরোধী দলের জনবল সংগঠক ও অর্থদাতাদের তথ্য সংগ্রহের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ঢাকার পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ থেকে। রাঙামাটি জেলার এসপিকে পাঠানো বেতার বার্তায় সব থানার ওসিদের বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের কমপক্ষে আটজন শীর্ষ ব্যক্তি-জেলা পর্যায়ের নেতা, প্রতিটি উপজেলায় পাঁচ ব্যক্তির এবং জেলার সব পৌরসভা ও ইউনিয়নের কমপক্ষে পাঁচ ব্যক্তির তথ্য সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে। যাঁরা সরকারবিরোধী চলমান আন্দোলনে জনবল সংগঠক বা অর্থায়ন করেন কিংবা অন্য কোনোভাবে সহযোগিতা করেন, এমন ব্যক্তিদের বিস্তারিত তথ্য (যেমন ঠিকানা, মুঠোফোন নম্বর, এনআইডি নম্বর ইত্যাদি) সংগ্রহ করে তাঁর (এসপি) কাছে ই-মেইল এবং পরে হার্ড কপি পাঠাতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
রাঙামাটিতে এই বেতার বার্তা পাঠানোর খবরে পুলিশের চোর ধরা গল্পের কথা মনে পড়ল। চোর চুরি করে পালানোর সময় পুলিশ তাকে ধাওয়া করে। ধাওয়া করতে করতে একটি খালের কিনারে নিয়ে গেলে চোর লাফ দিয়ে খালে পড়ে বলে, ‘আমি এখন জল পুলিশের অধীন। এখন আর আপনি আমাকে ধরতে পারবেন না।’

বর্তমানে দেশের যে ৬১টি জেলায় নির্বাচন হচ্ছে, তাতে তিন পার্বত্য জেলা নেই। রাঙামাটি ওই তিন পার্বত্য জেলার একটি। তাই নির্বাচন কমিশনও বলতে পারে, ওই জেলায় যেহেতু জেলা পরিষদ নির্বাচন হচ্ছে না, পুলিশ যেকোনো বেতার বার্তা দিতে পারে। এ বিষয়ে সাংবাদিকেরা সিইসির দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি এ প্রশ্নের উত্তর দেবেন না বলে জানিয়েছেন। সিইসি কী বিশেষ পুলিশের বিশেষ বার্তা সম্পর্কে নির্বাচনের সময় যাঁরা তাঁর অধীনে থাকবেন, তাঁদের কাছে এ ধরনের বেতার বার্তা দেওয়া বন্ধ করতে পারবেন। যদি পারেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষীণ আশা আছে। আর যদি না পারেন, বুঝতে হবে কেবল ডিসি-এসপিরাই দলীয় কর্মী হয়ে যাননি, ইসিও একই পথের অনুসারী।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, নির্বাচনের সময় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও এর অধীন যেসব বাহিনী আছে, যাদের নির্বাচনের কাজে সংশ্লিষ্টতা থাকবে, তারা ইসির অধীন থাকবে। ইসির যেকোনো নির্দেশনা মানতে বাধ্য থাকবে। কিন্তু জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা যে তাঁদের কোনো নির্দেশই মানবেন না, তার আভাস পাওয়া গেল শনিবারের মতবিনিময় সভায়ও। নির্বাচন কমিশনার আনিসুর রহমান যখন ডিসি-এসপিদের দলীয় পক্ষপাত ও আর্থিক সততা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন, যখন তিনি তাঁদের নখদন্তহীন বলে ভর্ৎসনা করলেন, তখন তাঁরা জোর আপত্তি তুললেন। তাঁর কথা শুনতে চান না বলে হইচই শুরু করলেন। তিনি তাঁর বক্তব্যের পক্ষে তথ্য-প্রমাণ দিতে চাইলেও তা তাঁরা মানতে চাইলেন না। বক্তৃতা শেষ না করেই কমিশনার মঞ্চ থেকে নেমে গেলেন।
এই ডিসি-এসপিরা নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা মানবেন, এ কথা পাগলেও বিশ্বাস করে না।

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম–সম্পাদক ও কবি