চীনের ওপর ভরসা করার যুক্তি কী

প্রত্যাবাসনের জন্য তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গাদের তথ্য যাচাইয়ে কক্সবাজারের টেকনাফে আসেন মিয়ানমারের প্রতিনিধিদল
ফাইল ছবি

রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে পাঠানোর পাইলট প্রকল্পের ভবিষ্যৎ কী? সরকার কি এই উদ্যোগ থেকে সরে আসছে? নাকি চীনের সহায়তায় এই উদ্যোগ নিয়ে এগোনোকেই এখনো ঠিক মনে করছে? এ ধরনের প্রশ্ন ওঠার কারণ কিছু রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে সরকারের তরফে যে উদ্যোগ নেওয়া শুরু হয়েছিল, তা থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ।

জাতিসংঘের মিয়ানমারের পরিস্থিতিবিষয়ক বিশেষ র‍্যাপোর্টিয়ার টম অ্যান্ড্রুস বলেছেন, মিয়ানমারের রাখাইনে এখনো রোহিঙ্গাদের জীবন ও চলাচলের স্বাধীনতা ঝুঁকিতে রয়েছে। জেনেভা থেকে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ সম্প্রতি যে বিবৃতি দিয়েছে, সেখানে তিনি কার্যত অভিযোগ করে বলেছেন, বাংলাদেশ ‘বিভ্রান্তিমূলক’ এবং ‘বলপ্রয়োগের’ মতো পদক্ষেপের মাধ্যমে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে ফিরে যেতে বাধ্য করছে। মিয়ানমারের পরিস্থিতি রোহিঙ্গাদের নিরাপদে, মর্যাদার সঙ্গে স্থায়ীভাবে ও স্বেচ্ছামূলক প্রত্যাবাসনের জন্য সহায়ক নয়।

বিবৃতিতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি এখন নিষ্ঠুর এক সামরিক শাসনযন্ত্রের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যাঁরা বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলা চালাচ্ছেন এবং রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও অন্যান্য মৌলিক অধিকারকে প্রত্যাখ্যান করে চলেছেন।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর নির্দিষ্ট কোনো তারিখ না পেলেও জানতে পেরেছেন যে প্রাথমিকভাবে ১ হাজার ১৪০ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো হবে এবং এ বছরের শেষ নাগাদ আরও ৬ হাজার জনকে ফেরত পাঠানো হবে।

টম অ্যান্ড্রুস উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের এই পদক্ষেপের যাঁরা বিরোধিতা করছেন, তাঁদের গ্রেপ্তারের হুমকি, কাগজপত্র জব্দসহ নানা ধরনের প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে জাতিসংঘ র‍্যাপোর্টিয়ার বিবৃতিটি বেশ কড়া এবং অভিযোগগুলোও বাংলাদেশের জন্য বিব্রতকর।

কোনো আন্তর্জাতিক গ্যারান্টি ছাড়া চীনের পরামর্শে ও আগ্রহে সেই চুক্তি স্বাক্ষরের বিরোধিতা তখন নানা মহল থেকে করা হয়েছিল। সরকার তা বিবেচনায় নেয়নি। সেই চুক্তি আন্তর্জাতিক চাপ থেকে মিয়ানমারকে রক্ষা করেছে কিন্তু বাংলাদেশ কিছুই পায়নি। মধ্যস্থতাকারী চীন এর কোনো দায়ও নেয়নি। এটা সত্যিই বিস্ময়কর যে এরপরও বাংলাদেশ কেন আবার চীনের ওপর আস্থা রেখে ‘কিছু’ রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর পাইলট প্রকল্প নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে!

এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের মন্তব্য বাংলাদেশের অবস্থান বুঝতে আমাদের সহায়তা করবে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে পাইলট প্রকল্প নিয়ে কারও বিরোধিতা করার কোনো কারণ আছে বলে তিনি মনে করেন না। শাহরিয়ার আলমের বক্তব্য, একটি ট্রায়াল হচ্ছে। এটি বড় ধরনের কোনো প্রত্যাবাসন নয়। এটি যদি সফল না হয়, তাহলে আমরা তাদের ফেরত নিয়ে আসতে পারব। সে ক্ষেত্রে এটির বিরুদ্ধে যাওয়ার কোনো যুক্তি দেখি না। প্রতিমন্ত্রীর দাবি, রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় যাচ্ছে।

পাইলট প্রত্যাবাসনের বিরোধিতা করার কোনো যুক্তি যেহেতু পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী পাননি, তাই তাঁকে পাল্টা প্রশ্ন করতে চাই, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো নিয়ে এই ‘ট্রায়াল’ করারই–বা যুক্তি কী? জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে কার্যত উপেক্ষা করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের সঙ্গে একটি চুক্তি তো আগে বাংলাদেশ করেছিল, তা থেকে কী ফলাফল পাওয়া গেছে?

রোহিঙ্গাদের একটি প্রতিনিধিদল আরাকানে প্রত্যাবাসন পরিস্থিতি দেখতে গিয়ে তাদের যে অভিজ্ঞতার কথা ফিরে এসে বলেছে, তাতে কি মনে হয় যে তারা ‘স্বেচ্ছায়’ সেখানে ফিরে যেতে আগ্রহী? কিছু কূটনীতিকও মিয়ানমার সরকারের উদ্যোগে আরাকানে গিয়েছিলেন প্রত্যাবাসনের প্রস্তুতি দেখতে। তাঁরা সেখানে কিছু ক্যাম্প দেখেছেন। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিয়ে এসব ক্যাম্পে রাখা হবে। বোঝা যায় নিজেদের ভিটেবাড়ি থেকে উৎখাত হওয়া রোহিঙ্গাদের তা ফিরিয়ে দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা মিয়ানমার সরকারের নেই। এমন কোনো প্রত্যাবাসন কি রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় মেনে নেওয়ার কথা?

প্রতিমন্ত্রী নিজেও সম্ভবত আস্থা রাখতে পারছেন না যে এই পাইলট প্রত্যাবাসন সফল হবে। তাই তিনি বলেছেন, ‘সফল না হলে আমরা তাদের ফেরত নিয়ে আসতে পারব।’

প্রত্যাবাসনের এই পাইলট উদ্যোগ শুরুর পর থেকেই এর ফলাফল নিয়ে যৌক্তিক প্রশ্ন উঠছে। কিন্তু সব জেনেবুঝেও বাংলাদেশ যেন অনেকটা একগুঁয়েভাবে প্রত্যাবাসনের এই চীনা উদ্যোগ নিয়ে এগোনোর পথ ধরে। প্রশ্ন হচ্ছে চীনের মধ্যস্থতায় বা আগ্রহে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ফাঁদে বাংলাদেশ কেন বারবার পা দিচ্ছে?

২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধন ও হত্যাযজ্ঞের বিরোধিতায় যখন বিশ্ব সম্প্রদায় মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে, তখন মিয়ানমারকে রক্ষায় এগিয়ে আসে চীন। কৌশল হিসেবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের চুক্তির উদ্যোগ নেয় দেশটি। বলা যায়, বিশ্ব সম্প্রদায়কে কার্যত উপেক্ষা করে বাংলাদেশে চীনের পরামর্শ ও আগ্রহে মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তি করে। গত ছয় বছরে সেই চুক্তির আওতায় একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায়নি।

কোনো আন্তর্জাতিক গ্যারান্টি ছাড়া চীনের পরামর্শে ও আগ্রহে সেই চুক্তি স্বাক্ষরের বিরোধিতা তখন নানা মহল থেকে করা হয়েছিল। সরকার তা বিবেচনায় নেয়নি। সেই চুক্তি আন্তর্জাতিক চাপ থেকে মিয়ানমারকে রক্ষা করেছে কিন্তু বাংলাদেশ কিছুই পায়নি। মধ্যস্থতাকারী চীন এর কোনো দায়ও নেয়নি। এটা সত্যিই বিস্ময়কর যে এরপরও বাংলাদেশ কেন আবার চীনের ওপর আস্থা রেখে ‘কিছু’ রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর পাইলট প্রকল্প নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে!

আরও পড়ুন

চীনের স্বার্থের বিষয়টি পরিষ্কার। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পাইলট প্রকল্প বৈশ্বিকভাবে রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাদের কর্তৃত্ব ও খবরদারির বিষয়টিকে প্রতিষ্ঠিত করবে। একই সঙ্গে সামনের নির্বাচন ও যুক্তরাষ্ট্রের বার্মা অ্যাক্টকে কেন্দ্র করে মিয়ানমারের ওপর যে চাপ তৈরি হয়েছে, তা শিথিল করতে সক্ষম হবে।

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা ১২ লাখের বেশি। আশ্রয়শিবিরগুলোতে নতুন শিশু জন্ম হওয়ায় প্রতিবছর সেই সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার করে বাড়ছে। এই চাপ নেওয়া বাংলাদেশের জন্য কঠিন, তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতেই হবে। এর একমাত্র পথ মিয়ানমারের ওপর এমন বৈশ্বিক চাপ সৃষ্টি করা, যাতে তারা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। তা না করে চীনের পরামর্শে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের অবাস্তব পাইলট প্রকল্প নিয়ে এগোনোর অর্থ হচ্ছে রোহিঙ্গাদের প্রতি সহমর্মী জাতিসংঘসহ বিশ্ব সম্প্রদায়কে রুষ্ট করা। জেনেশুনে এই ঝুঁকি নেওয়ার অর্থ কী?

● এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক

[email protected]