পৃথিবীতে যদি কোনো দেশ ভেবেই রাখতে পারত যে ইসরায়েল তার ওপর কখনো হামলা করবে না, তাহলে তা ছিল কাতার। কাতার ছোট একটি দেশ এবং ইসরায়েলের জন্য কোনো হুমকি নয়। এর চেয়ে বড় বিষয় হলো, কাতার যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি এখানেই রয়েছে।
গত মাসে গাজা যুদ্ধবিরতি আলোচনার জন্য ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের প্রধান দোহায় এসে কাতারি সরকারের আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। সবকিছু মিলিয়ে মনে হতে পারে, কাতার নিরাপদ। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। কাতার কখনোই পুরোপুরি নিরাপদ ছিল না, এবং এটি এই অঞ্চলের ভিন্নধারার কোনো দেশও নয়।
ইসরায়েল আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন মানে না। তারা আন্তর্জাতিক আইন উপেক্ষা করে এবং নিজের জন্য ‘ঈশ্বরপ্রদত্ত অধিকার’ দাবি করে অঞ্চল বিস্তার করতে চায়। যারা তাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তারা তাদের শত্রু।
ইসরায়েলকে শুধু আইনভঙ্গকারী রাষ্ট্র বলা ঠিক হবে না। এটি এমন এক দেশ, যা প্রকাশ্যে সব আন্তর্জাতিক নিয়ম ও আইন প্রত্যাখ্যান করেছে। বহু বছর ধরে ইসরায়েলের নেতারা ‘গ্রেটার ইসরায়েল’ বা ‘বৃহত্তর ইসরায়েল’-এর স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। তাঁদের সেই স্বপ্নের ইসরায়েলের সীমানা ইরাকের ইউফ্রেতিস থেকে মিসরের নীল নদ পর্যন্ত বিস্তৃত। গত আগস্টে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু টেলিভিশনে এই প্রকল্পের প্রতি তাঁর অঙ্গীকার প্রকাশ করেছেন।
দুই বছর ধরে ইসরায়েল গাজাকে ধ্বংসের পথে নিয়ে গেছে। ৬৪ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি মারা গেছেন। ফিলিস্তিনের বাইরে ইসরায়েল লেবানন, সিরিয়া, ইয়েমেন ও ইরানে তার যুদ্ধযন্ত্র ছড়িয়ে দিয়েছে। লেবাননে তারা স্কুল ছুটির সময় ভিড়ভাট্টাপূর্ণ এলাকায় পেজারে বিস্ফোরণ ঘটায়।
এখন কাতারে এসে ইসরায়েল আরেক ধাপ অতিক্রম করেছে। দোহায় হামলায় হামাস কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্য এবং এক কাতারি কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। কাতার এই হামলাকে ‘কাপুরুষোচিত, অপরাধমূলক আক্রমণ’ এবং ‘শতভাগ বিশ্বাসঘাতকতা’ হিসেবে নিন্দা জানিয়েছে।
কাতারের ওপর হামলা চালানোর পরও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আরব নেতারা মুখ খুলতে পারেননি। এর মূল কারণ আরব ও মুসলিম দেশগুলোর দুর্বলতা। গাজা, পশ্চিম তীর কিংবা পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের অপরাধের বিরুদ্ধে তারা কার্যত কিছুই করেনি। বরং ইসরায়েল শিখেছে—সে যেকোনো সময় যা খুশি করবে, আরব নেতারা প্রতিবাদ করবেন না।
কাতারের ওপর হামলা চালানোর পরও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আরব নেতারা মুখ খুলতে পারেননি। এর মূল কারণ আরব ও মুসলিম দেশগুলোর দুর্বলতা। গাজা, পশ্চিম তীর কিংবা পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের অপরাধের বিরুদ্ধে তারা কার্যত কিছুই করেনি। বরং ইসরায়েল শিখেছে—সে যেকোনো সময় যা খুশি করবে, আরব নেতারা প্রতিবাদ করবেন না।
সবচেয়ে শক্তিশালী কিছু আরব দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক আরও বাড়াচ্ছে। তিন সপ্তাহ আগে মিসর ইসরায়েলের সঙ্গে বিশাল একটি গ্যাস চুক্তি করেছে। চুক্তি অনুযায়ী, আগামী ১৫ বছরে তারা ইসরায়েলকে ৩৫ বিলিয়ন ডলার দেবে।
সর্বশেষ এই হামলা কাতার ও যুক্তরাষ্ট্রকেও প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, এত বড় মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ড ঘাঁটি যদি কোনো হামলা রোধ করতে না পারে, তবে এর অস্তিত্বের অর্থ কী?
আরেকটি প্রশ্ন উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রকে ঘিরে। খবরে বলা হয়েছে, ট্রাম্প প্রশাসন সরাসরি এই হামলায় অনুমোদন দিয়েছে। তাহলে আরব দেশগুলো কি ওয়াশিংটনের বাইরে তাকাবে? তারা কি রাশিয়া, চীন বা অন্য কারও দিকে ঝুঁকবে?
আরব দেশগুলো এখন বড় এক সংকটে আছে। তারা কি এক হয়ে প্রতিক্রিয়া দেখাবে? তারা কি বুঝবে যে ‘গ্রেটার ইসরায়েল’-এর স্বপ্ন তাদের সবার জন্য হুমকি? তারা কি ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে, আমেরিকার ওপর চাপ দেবে কিংবা এমন কোনো জোট বানাবে, যেটা ইসরায়েলকে সামরিকভাবে চ্যালেঞ্জ করতে পারবে? নাকি আগের মতো চুপ করে বসে থাকবে?
কিছু দেশ হয়তো মনে করছে, কাতারের ওপর হামলা তাদের জন্য ভালো, কারণ তারা নিরাপদ আছে। যেমন সংযুক্ত আরব আমিরাত, যাকে অনেকে ইসরায়েলের উপশহর বলে ডাকে। কিন্তু এই ধারণা মারাত্মক ভুল। কাতারের ওপর হামলা প্রমাণ করেছে—কোনো জোট, কোনো কূটনীতি বা আমেরিকার সুরক্ষা আরব দেশগুলোকে ইসরায়েলের সহিংসতা থেকে বাঁচাতে পারবে না। ইসরায়েলকে থামানো না গেলে, একসময় এই অঞ্চলের প্রতিটি রাজধানীই বুঝবে, তারাও হামলার টার্গেট।
মোহাম্মদ এলমাসরি দোহা ইনস্টিটিউট ফর গ্র্যাজুয়েট স্টাডিজের অধ্যাপক
মিডল ইস্ট থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত