মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ২০২১ সালের এক বক্তৃতায় আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমালোচনা করতে গিয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের একটি বিখ্যাত উক্তি উদ্ধৃত করেছিলেন। নিক্সনের কথাটি ছিল, ‘অধ্যাপকেরা আমাদের শত্রু।’
যদিও ভ্যান্স নিজে ইয়েল ল স্কুল থেকে পড়াশোনা করেছেন, এরপরও তিনি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে আমেরিকার নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে পরিচালিত ‘অভিযানে’ একজন সক্রিয় সৈনিক হিসেবে কাজ করছেন।
এই শাস্তিমূলক ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে গবেষণার জন্য অর্থ সাহায্য বন্ধ করে দেওয়া, বিদেশি শিক্ষার্থীদের প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কী পড়ানো হবে ও কীভাবে পড়ানো হবে—তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা।
‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ (মাগা) স্লোগান বাস্তবায়নের কথা বলে ট্রাম্প এখন এমন সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করতে উঠেপড়ে লেগেছেন, যেগুলো একসময় আমেরিকাকে মহান করে তুলেছিল।
প্রশ্ন হলো যেসব প্রতিষ্ঠান চিকিৎসা ও প্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতি এনেছে, সেগুলোর ওপর এত আক্রমণ চালানোর পেছনে উদ্দেশ্যটা আসলে কী?
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ‘ইহুদিবিদ্বেষের আঁতুড়ঘর’ হিসেবে করা একধরনের ধৃষ্টতা। এই মন্তব্যটি এমন একজন মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে এসেছে, যিনি মশাল হাতে ‘আমাদের ভূমিতে ইহুদিদের ঠাঁই হবে না’ বলে স্লোগান দেওয়া নাৎসিদের মধ্যেও ‘অনেক ভালো মানুষ’ আছে বলে অতীতে মন্তব্য করেছেন।
আসলে, ‘মাগা’পন্থী, অর্থাৎ ট্রাম্পের অনুসারীদের কাছে ইহুদিবিদ্বেষের সংজ্ঞা খুব সংকীর্ণ। তাঁদের মতে, যাঁরা ইসরায়েলের বর্তমান সরকার বা নেতানিয়াহুর সমালোচনা করেন, তাঁরা ইহুদিবিদ্বেষী। অর্থাৎ কেউ যদি ইহুদি রাষ্ট্রবাদের বিরুদ্ধে কথা বলেন, তবে তাঁকে তাঁরা ইহুদিদের ঘৃণা করা লোক বলেই ধরে নেন। সব সমালোচক ইহুদিবিদ্বেষী নন—এই সহজ কথাটা তাঁরা মানতে চান না।
ফিলিস্তিনপন্থী ছাত্র আন্দোলনকারীদের মধ্যে কিছু মানুষ ইহুদিবিদ্বেষী হতে পারেন; শিক্ষকদের মধ্যেও কেউ কেউ হয়তো এমন আছেন। কিন্তু এই কয়েকজনের কারণে গোটা উচ্চশিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেওয়ার কোনো যুক্তি নেই।
আইভি লিগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে (যেমন হার্ভার্ড, ইয়েল, প্রিন্সটন ইত্যাদি) ইহুদিবিদ্বেষ দূর করার যে কথা বলা হচ্ছে, তা আসলে একটি অজুহাতমাত্র। এর লক্ষ্য হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের বামপন্থী আর উদারপন্থী মানুষদের ওপর আঘাত হানা, যাঁদের অনেকে নিজেরাও ইহুদি।
জ্ঞানী-গুণী মানুষদের, বিশেষ করে বিজ্ঞানীদের প্রতি ঘৃণা চরমপন্থী জনতুষ্টিবাদী রাজনীতির পুরোনো বৈশিষ্ট্য। ১৯৩০-এর দশকে হিটলার বলেছিলেন, ‘জার্মানরা বেশি শিক্ষিত হয়ে পড়েছে। শুধু জ্ঞানকেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এসব জ্ঞানী কাজের শত্রু।’
বিজ্ঞান এমন এক জিনিস, যা সব দেশের, সব জাতির মানুষ একসঙ্গে করে। কিন্তু এই দৃষ্টিভঙ্গিকে নাৎসিরা অপছন্দ করতেন। কারণ, তাঁরা চাইতেন সবকিছুই যেন শুধু জার্মান জাতির জন্য হয়। তাই তাঁরা বিজ্ঞানকে ‘সবার জন্য’ বলে ভাবতেন না। তাঁরা বলতেন, ‘গবেষণা করতে হলে আগে দেখতে হবে তুমি কোন জাতির লোক।’
গত এক শ বছরে পশ্চিমা সমাজে, বিশেষ করে আমেরিকায়, মেধাভিত্তিক সমাজ বা ‘মেরিটোক্রেসি’ গড়ে উঠেছে। এখন শুধু পরিবার বা অর্থ নয়, বরং কে কতটা শিক্ষিত, সেটাই সমাজে উচ্চমর্যাদা পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে।
১৯৩৪ সালে জোহানেস স্তার্ক নামের এক নাৎসিবাদী জার্মান বিজ্ঞানী বলেছিলেন, ‘নাৎসি সরকারের অধীনে বড় কোনো বৈজ্ঞানিক দায়িত্বে এমন কাউকে বসানো যাবে না, যিনি জার্মান নন বা জার্মান জাতিকে ভালোবাসেন না; শুধু সেই মানুষেরাই এসব জায়গায় বসতে পারবেন, যাঁরা জার্মান এবং গর্বের সঙ্গে নিজেদের জার্মান বলে মনে করেন।’
মাগা ভাবধারার লোকেরা যে বৈচিত্র্য ও অন্তর্ভুক্তির মতো কার্যক্রমকে ঘৃণা করেন, তার পেছনে নাৎসি চিন্তার ছায়া আছে। সে কারণে আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে ‘অ্যান্টি-আমেরিকান’ বা বিরুদ্ধচিন্তার লোকদের বাদ দেওয়ার চেষ্টা চলছে। আবার বিদেশি শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধেও তাঁরা ক্ষুব্ধ। অথচ এসব বিদেশি শিক্ষার্থী আমেরিকায় শিক্ষা খাতে প্রচুর অর্থ আনেন এবং সাংস্কৃতিকভাবে নানা রকম সুফল দিয়ে থাকেন। এই বিদেশি শিক্ষার্থীদের প্রতি যে বিদ্বেষ, তা কেবল জাতিবিদ্বেষ নয়, বরং আমেরিকার সাংস্কৃতিক শক্তিকেও (সফট পাওয়ার) দুর্বল করে দেয়। শুধু জাতিবিদ্বেষ নয়, এই আক্রমণের পেছনে রয়েছে শ্রেণিদ্বেষ বা ‘ক্লাস রিসেন্টমেন্ট’।
গত এক শ বছরে পশ্চিমা সমাজে, বিশেষ করে আমেরিকায়, মেধাভিত্তিক সমাজ বা ‘মেরিটোক্রেসি’ গড়ে উঠেছে। এখন শুধু পরিবার বা অর্থ নয়, বরং কে কতটা শিক্ষিত, সেটাই সমাজে উচ্চমর্যাদা পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে।
তবে শিক্ষিত হওয়া মানে কেবল ডিগ্রি পাওয়া নয়। শিল্পকলায় রুচি থাকা, বই পড়ার প্রতি ঝোঁক থাকা এবং একাধিক ভাষায় জ্ঞান অর্জনের ইচ্ছা থাকাও এই ‘শিক্ষিত শ্রেণির’ বৈশিষ্ট্য।
ট্রাম্প অনেক ধনী এবং তিনি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়—ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার হোয়াটন স্কুল থেকে ব্যাচেলর ডিগ্রি পেয়েছেন। কিন্তু তিনি বইপত্র পড়েন না, বড় কোনো জ্ঞানেও দক্ষ নন।
আসলে মাগা ধারার লোকেরা শুধু নিজেরা অযোগ্য বলে যে শিক্ষিতদের ঘৃণা করেন, বিষয়টি এমন নয়। এর পেছনে শ্রেণিগত ক্ষোভও আছে।
শুধু ডিগ্রি বা ভালো সংগীতের রুচি থাকলেই সমাজে মর্যাদা পাওয়া যায় না। সাম্প্রতিক সময়ে সমাজে উচ্চমর্যাদা পেতে হলে জাতি, লিঙ্গ বা যৌনতা নিয়ে নির্দিষ্ট ‘প্রগতিশীল’ দৃষ্টিভঙ্গি থাকাও দরকার হয়। অনেকের কাছে এই প্রগতিশীলতা মানে কেবল বুদ্ধিবৃত্তিক উচ্চতা নয়, বরং নৈতিক উৎকর্ষের চিহ্নও হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে, যারা এই মানদণ্ডে পৌঁছাতে পারেনি বা স্বীকৃতি পায়নি, তারা এখন এই ব্যবস্থাকেই ধ্বংস করতে চায়।
আমেরিকার অনেক সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন অসহিষ্ণুতা ছড়িয়ে পড়েছে। এটি একেবারেই একাডেমিক বা শিক্ষাবিষয়ক স্বাধীনতার পরিপন্থী। রাজনীতিকে এখন অনেক সময় ধর্মবিশ্বাসের মতো করে দেখা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন এমন একধরনের পরিবেশ তৈরি হয়েছে, যেখানে কিছু কিছু শিক্ষার্থী ও শিক্ষক অন্যদের মতকে সহ্য করতে চান না। বিশেষ করে, যাঁরা রক্ষণশীল মতাদর্শে বিশ্বাস করেন বা মাগা ধারার সমর্থক, তাঁদের অনেক সময় বিপক্ষ শিবির বা নৈতিকভাবে নিচু শ্রেণির মানুষ বলে দেখা হয়।
অনেক শহুরে শিক্ষিত অভিজাত মানুষ মনে করেন, যাঁরা গ্রামে থাকেন, বন্দুক রাখেন, খ্রিষ্টধর্মে বিশ্বাস করেন বা ভালো বই পড়েন না, তাঁরা নিচু শ্রেণির মানুষ। এই শিক্ষিত শ্রেণির ধারণা রক্ষণশীলদের আহত করে; তাঁরা অপমান বোধ করেন। এ অপমানবোধ তাঁদের শিক্ষিত ও প্রগতিশীলদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন করে তোলে। এটিকেই ট্রাম্প রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগাচ্ছেন।
তবে ট্রাম্প বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে যে আক্রমণ চালাচ্ছেন, তা দিন শেষে সবার উপকারও করতে পারে। এটি মানুষকে আগের চেয়ে বেশি জ্ঞানচর্চায় উদ্বুদ্ধ করতে পারে।
ইয়ান বুরুমা ডাচ-ব্রিটিশ লেখক, সম্পাদক ও প্রাবন্ধিক
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ